× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বহুমাত্রিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী: শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার

মত-মতান্তর

মোহাম্মদ আবু সালেহ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ - ২৯ জুলাই ১৮৯১) ছিলেন উনিশ শতকের একজন পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, লেখক, অনুবাদক, সমাজ সংস্কারক, সামাজিক উদ্যোক্তা, মানবতাবাদী ও মানবহিতৈষী। বাংলার নবজাগরণের অন্যতম সৃজনশীল ও পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আধুনিক ভারতবর্ষের অন্যতম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রূপকার ও পথিকৃৎ ছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তার।

বিধবাবিবাহ আইন বাস্তবায়ন:
যেসকল মুষ্টিমেয় বাঙালি তাঁদের স্বীয় সমাজের সামষ্টিক চরিত্র ও জাতীয় ব্যক্তিত্বের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সমাজের ঊর্ধ্বে উঠে একাই মহীয়ান হয়ে উঠেন তাদের মধ্যে বিদ্যাসাগর নিঃসন্দেহে অগ্রগামী। বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণ আমার কাছে যেটি মনে হয়- তার কথা আর কাজের মধ্যে মিল রাখা। শুধু বাঙালি চরিত্র কেন প্রায় সকল জাতিতে জাতিতে কথা আর কাজের অমিলই কমবেশি আমাদের পরিলক্ষিত হয়।
তিনি কেবল বিধবা বিবাহ আইন বাস্তবায়ন করেই ক্ষান্ত হননি বরং তাঁর ২২ বছর বয়সী আপন পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিধবার বিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর বন্ধু সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকেও বিধবার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বহুবিবাহ রোধ, অনুবাদ ও শিক্ষা সংস্কার:
বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন বিদ্যাসাগর করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কৃত শিক্ষা সংস্কার, ইংরেজি থেকে গুরুত্বপূর্ণ পাশ্চাত্য সাহিত্য অনুবাদ, বাংলা বর্ণমালা সংস্কার ও সহজিকরণ এবং বাংলা গদ্যরীতির প্রবর্তন ইত্যাদি। হিন্দু উচ্চবর্ণে সেসময় বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিল তিনি তা রোধ করেন। সমাজ সংস্কারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি বাল্য বিবাহ রোধ ও নারীশিক্ষার প্রসারে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে ও শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান ও ভূমিকার জন্য আমরা সবাই তাঁর কাছে ঋণী। ১৮৫৫ সালে রচিত 'বর্ণপরিচয়' সার্ধশত বছরেরও বেশি সময় ধরে পঠিত হয়ে আসছে। শেক্সপিয়ার প্রথম অনুবাদ তিনিই করেন। কথিত আছে, তিনি মাত্র পনের দিনে 'Comedy of Errors' অবলম্বনে 'ভ্রান্তিবিলাস' অনুবাদ করেন।

রসবোধ ও জীবনের কথকতা:
বিদ্যাসাগরের রসবোধও (Sense of humour) ছিল অসাধারণ। তাঁর জীবনের অনেক ছোট ছোট ঘটনা (Anecdotes) তাঁর জীবদ্দশায়ই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। মাতৃভক্তি ছিল তাঁর চরিত্রে অন্যতম গুণ। শোনা যায়, তাঁর মায়ের ডাকে একবার তিনি ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ দামোদর নদ সাঁতরেও পার হয়েছিলেন। নারীদের প্রতি তাঁর সম্মান ছিল অসামান্য। একবার কোলকাতার রাস্তায় এক ভাসমান রূপজীবাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তিনি 'মা জননী' সম্বোধন করে তাকে বললেন, যেন তাঁর ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়। ঐ রূপজীবা খোঁচা দিয়ে বললো, 'যেভাবে মা-জননী বলে ডাকছেন, মনে হয় যেন নিজেকে বিদ্যাসাগর মনে করেন'। ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে তাঁর গায়ের সাথে লাগলে তিনি বললেন, 'মা-জননী, একটু তফাতে!" বিদ্যাসাগরের বাড়িতে বহু সমাজ পরিত্যক্তা ও বিধবা নারী আশ্রয় নিতেন। তারপর একদিন ঐ রূপজীবা বিদ্যাসাগরের বাড়িতে বিধবাদের সভায় গিয়ে বিদ্যাসাগরকে দেখে অবাক হলেন।

দয়ার সাগর:
দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে তিনি পরিচিতি ছিলেন 'দয়ার সাগর' নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনোই তাঁর দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থ সংকটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি। ১৮৬৪ সালের ২ আগস্ট ফ্রান্সে তাঁর ঋণগ্রস্ত বন্ধু মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৭ সালে অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র খাবার সংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন এবং এখান থেকে দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। ১৮৭২ সালের ১৫ জুন বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফাণ্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। কত দরিদ্র ছাত্র তাঁর অর্থে পড়াশোনা ও খাওয়াপরা চালাত।

বাল্য বিবাহ রোধ:
সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগর বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে যে অক্লান্ত সংগ্রাম করেছেন তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। প্রায় পৌনে দুইশো বছর আগের নেয়া সেই পদক্ষেপ আজও আমাদের সমাজের জন্য কতোটা প্রাসঙ্গিক তা সবাই অনুধাবন করতে পারবেন। এখনো বাংলাদেশের আনাচেকানাচে বহু বাল্য বিবাহ হচ্ছে এবং এর অভিশাপ থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। বিদ্যাসাগরের দূরদৃষ্টির এখানেই সার্থকতা। আজও ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন বাল্য বিবাহের কুফল কী ভয়াবহ!

নারীশিক্ষা:
বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর। তিনি নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই বেগম রোকেয়া ও অন্যান্যরা পরবর্তীতে নারীশিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়টার বিটন উদ্যোগী হয়ে কোলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদেনিপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করতো। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি।

আধুনিক বাংলা গদ্যের সার্থক রূপকার:
বিদ্যাসাগর সমাজের প্রায় সকল সংস্কারের 'Pathfinder' ছিলেন। তাঁর উত্তর প্রজন্ম নারীশিক্ষা প্রবর্তনে কিংবা সমাজ সংস্কারে ও রাজনীতিতে যাঁরাই এসেছেন তাঁরা বিদ্যাসাগরের দেখানো পথই অনুসরণ করেছেন। বিশৃঙ্খল বাংলা গদ্যকে তিনি যেভাবে সুশৃঙ্খল করে গেছেন তার ফলশ্রুতিতে রবীন্দ্রনাথের মতো লেখক বাংলাকে বিশ্বের দরবারে সুউচ্চ করতে পেরেছেন। আর সে কৃতজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করে গেছেন তাঁর লেখা 'বিদ্যাসাগর-চরিত' এ।

প্রবাদপ্রতিম বজ্রকঠিন চরিত্র:
বিদ্যাসাগরের চরিত্র ছিল কঠোর ও কোমলের সংমিশ্রণ। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন প্রবল জেদী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট মাথা নত না করে কাজ থেকে অবসর নেয়া তিনি শ্রেয় মনে করতেন। ইংরেজকেও তিনি প্রভুর চোখে দেখতেন না। এটি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, সে সময় বেশিরভাগ শিক্ষিত এলিট শ্রেণি ইংরেজদের তোষামোদকারী ও সুবিধাভোগী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথ, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়সহ বহু খ্যাতিমান বাঙালির পূর্বপুরুষ (বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক) প্রায় সবাই সেসময় জমিদারি ও প্রচুর অর্থবিত্ত গড়েছেন ইংরেজদের বদৌলতে। তিনিও চাইলেই তা অনায়াসেই অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে হাঁটেননি। নাবালক জমিদারদের পড়ানোর দায়িত্বও তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। সেজন্যই তিনি ব্যতিক্রম এবং বিরল বাঙালি। বহু পণ্ডিত আসবেন যাবেন, বহু লেখক খ্যাতিমান হবেন, বহু রাজনীতিবিদ ক্ষমতাসীন হবেন কিংবা বহু সমাজ সংস্কারকও আসবেন যাবেন কিন্তু বিদ্যাসাগরের চরিত্রের যে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা যাকে আমরা বলতে পারি 'সংশপ্তক', সে-রকম বহুমাত্রিক গুণের ও চরিত্রের অধিকারী কারও পক্ষে হওয়া প্রায় অসম্ভব।

বিদ্যাসাগর শুধু সমাজ সংস্কারের বা নারীদের অধিকারের কথা বলে বা লিখে ক্ষান্ত থাকেননি বরং তা তিনি তাঁর আপন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'বিদ্যাসাগর-চরিত'- এ যথার্থই বলেছেন,

"তাঁহার মতো লোক পারমার্থিকতাভ্রষ্ট বঙ্গদেশে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া, চতুর্দিকের নিঃসাড়তার পাষাণখণ্ডে বারম্বার আহত-প্রতিহত হইয়াছিলেন বলিয়া, বিদ্যাসাগর তাঁহার কর্মসংকুল জীবন যেন চিরদিন ব্যথিতক্ষুব্ধভাবে যাপন করিয়াছেন। তিনি যেন সৈন্যহীন বিদ্রোহীর মতো তাঁহার চতুর্দিককে অবজ্ঞা করিয়া জীবনরণরঙ্গভূমির প্রান্ত পর্যন্ত জয়ধ্বজা নিজের স্কন্ধে একাকী বহন করিয়া লইয়া গেছেন। তিনি কাহাকেও ডাকেন নাই, তিনি কাহারো সাড়াও পান নাই, অথচ বাধা ছিল পদে পদে। তাঁহার মননজীবী অন্তঃকরণ তাঁহাকে প্রবল আবেগে কাজ করাইয়াছিল, কিন্তু গতজীবন বহিঃসংসার তাঁহাকে আশ্বাস দেয় নাই। তিনি যে শবসাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন তাহার উত্তরসাধকও ছিলেন তিনি নিজে।"

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা সার্ভিসের জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় বিদ্যাসাগরের অবস্থান নবম। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। কোলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন 'বিদ্যাসাগর সেতু' তাঁরই নামে উৎসর্গিত। বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে পুরো সমাজকেই বদলে দিয়েছিলেন যার সুফল তার পরবর্তী প্রজন্ম প্রত্যেকে ভোগ করেছেন। সেজন্যই বিদ্যাসাগর একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। বিদ্যাসাগরের মতো বহুমাত্রিক ও বহু গুণের অধিকারী ব্যক্তিত্বকে আমাদের অবশ্যই জানা উচিত এবং সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা উচিত।

----
লেখক: মোহাম্মদ আবু সালেহ
সহপ্রতিষ্ঠাতা, ই-স্কুল অব লাইফ
ঠিকানা:
ফ্ল্যাট: ৪বি, রাস্তা: ৩৩, বাড়ি: ৭
গুলশান-১, ঢাকা-১২১২
ফোনঃ ০১৮১৭১৮২১৭২
www.e-schooloflife.com
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর