× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

পর্যবেক্ষণ /বিচার বিভাগের মর্মান্তিক অবস্থা

মত-মতান্তর

শহীদুল্লাহ ফরায়জী
৫ অক্টোবর ২০২০, সোমবার

মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না।

সরকার বনাম চেয়ারম্যান, ১ম কোর্ট অফ সেটেলমেন্ট ও অন্যান্য মামলার রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ। যা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছে।

এই একটি রায় ডুবন্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার কৃষ্ণ কুটিল অন্ধকারে এক ঝলক আলোর উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছে। এ রায়ে আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা সত্য বয়ান মানুষের ভিতরকে জাগ্রত করবে। এ রায় গণমানুষের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা ও সংকল্পের অভিপ্রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রের মিথ্যা ভাবমূর্তি সংরক্ষণ করা হচ্ছিল, এ রায়ের মাধ্যমে মিথ্যা ভাবমূর্তির মুখোশ উন্মোচিত হলো।

আদালতের রায়ে বলা হয়েছে  দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত।
দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না। বিচার বিভাগ ব্যর্থ হলে জনগণ বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবে সেটা কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং এখন সময় এসেছে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করা; নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের দুর্নীতি একসাথে চলতে পারে না। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনের শাসন বই পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

রায়ে বলা হয়েছে, আমাদের সমাজে, বুদ্ধিজীবী মহলে, পত্রপত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য খবর, প্রতিবেদন লেখা বা ছাপা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ বিচারকদের (নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত) কিভাবে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট প্রতিবেদন লেখা বা গবেষণা দেখা যায়নি। বিচার বিভাগের সকল বিচারকদের দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হলে প্রথমেই দুর্নীতিবাজ বিচারকদের চিহ্নিত করে দ্রুততার সঙ্গে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।

এ রায় রাষ্ট্রের দুর্দশাগ্রস্থ বিচার বিভাগের অস্তিত্ব রক্ষার সর্বাত্মক ও প্রাণান্তকর প্রয়াস। এ রায় অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ রায়ের মাধ্যমে হাইকোর্ট একটি মহা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। এই বিপদ সংকেত বিচার প্রশাসন ও বিচারকদের অন্তরাত্মা দিয়ে অনুধাবন করতে হবে নতুবা ঝড়ের তাণ্ডবে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।

দুর্নীতি  ও অপশাসনের যৌথ আক্রমণে একটি রাষ্ট্র কিভাবে গভীর  সংকটে তলিয়ে যাচ্ছে  তা এ রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। বিচারপতিগণ তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও গভীর বিবেচনাবোধ দিয়ে বিচার বিভাগের অন্তর্নিহিত সত্য উন্মোচন করেছেন। বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে রায়  বিক্রি করেন--এ ধরনের উচ্চ নৈতিকতার রায় বাংলাদেশে বিরল। আত্মোপলব্ধির সর্বোচ্চ শিখরে উঠা ছাড়া এ ধরনের সত্য ভিত্তিক রায় প্রদান সর্বগ্রাসী, সর্বাত্মক ও স্বার্থান্ধ রাষ্ট্র বা সমাজে সম্ভব নয়।

এই রায়ে বিরাজমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিচার বিভাগের প্রতিকারবিহীন করুণ ও মর্মান্তিক অবস্থা প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকদের রেখে নাগরিকদের ন্যায়বিচার সুরক্ষা দেয়া সম্ভব নয়- আদালত রাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, সতর্ক করে দিয়েছে এবং রাষ্ট্রকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকগণ রায় বিক্রি করে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্থাৎ ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে হরণ করছে। বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সুতরাং, দুর্নীতিকে উচ্ছেদ করতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আদালতের এ রায় বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রের জন্য অসাধারণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

বিচার বিভাগকে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার আদালতের আকুল আকাঙ্ক্ষা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, আদালতের উপর নাগরিকের অধিকার রক্ষার দায় ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়েছে সাংবিধানিকভাবে। নাগরিকের পক্ষে আদালত ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এটাই আদালতের নিজস্ব ক্ষমতা, যা রাষ্ট্রের অন্য কোন বিভাগের নেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আদালত কিভাবে সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ- শৃংখল থেকে মুক্ত করে বিচার বিভাগকে বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জরুরি কাজটি সম্পন্ন করবে। কারণ বিচার বিভাগের রয়েছে সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা প্রদানের অধিকার। এই সাংবিধানিক ক্ষমতার কারণেই আদালতের রায় বা আইনের ব্যাখ্যা আইনের ক্ষমতা অর্জন করে। একজন নাগরিকের সংবিধান বা আইনের ব্যাখ্যা আইনের শক্তি অর্জন করতে পারে না কিন্তু নাগরিকগণ সংবিধানের বিতর্ক বা প্রস্তাবনা উত্থাপন করতে পারবেন, আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন এবং গণবিরোধী কালাকানুন বাতিল করার সংগ্রামে অংশ নেয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। আর বিচারকগণ তাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে নাগরিকের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের নির্যাস থেকে শক্তি আহরণ করে বিচার ব্যবস্থাকে শাণিত করবেন।

আদালত প্রশ্ন তুলেছেন দুর্নীতিবাজ বিচারকদের কিভাবে ছুড়ে ফেলে দেয়া যায় সে ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্ট প্রতিবেদন লেখা বা গবেষণা দেখা যায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল বিচারপতি স্বপদে বহাল থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নৈতিকতা ও বিচার-বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার পর রাষ্ট্র থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় কিনা ! কারণ কেউ কেউ কারো বিরুদ্ধে অতীতে দ্বৈত নাগরিকত্ব, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিদ্বেষ জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে বড় ধরনের খেসারতের শিকার হয়েছেন। এই রায়ের পর সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীগণ নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপন করে নিপীড়ন ও নির্যাতনের বাইরে থাকতে পারবেন কিনা যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। আদালত অবমাননার মামলার পরিণতি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সমাপ্তি ঘটবে কিনা-এ নিশ্চয়তা কে দেবে?
 
আমরা অনেকেই ভুলে যাই ন্যায়ের কন্ঠরোধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা হয় নাই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিনামূল্যের উপহার নয়, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্র। আমরা অনেকেই ভুলে যাই বিচার বিভাগও সংবিধান ও আইনের অধীন। সংবিধান ও আইনের আলোকে বিচার বিভাগকেও কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়।

 রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাধর অনেকেই এখনো উপনিবেশের অমানবিক নির্মম চৌহদ্দির ভিতর মানসিকভাবে বিচরণ করেন এবং উপনিবেশের দাসত্ব মূলক দীর্ঘস্থায়ী  ক্ষতিকর রাস্তা নির্মাণে নিজেকে  নিয়োজিত রাখেন। এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিগণ ব্যক্তিগত বা দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের বেড়া ডিঙিয়ে বৃহত্তর মানবতা বা উচ্চতম নৈতিক চেতনার সাথে যুক্ত হতে পারেন না।

বিচারপতি নিয়োগ এখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে বিশ্বাসযোগ্য বিচারব্যবস্থার বিকাশ এর পক্ষে এটাই প্রথম ক্ষতিকারক পদক্ষেপ। মেধা, দক্ষতা, নৈতিক উচ্চতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এসবকে বিচারক নিয়োগের গুণগত মানের বদলে দলবাজির মত অপ্রয়োজনীয় যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করলে পরিণতি তাই হবে।

সারা বিশ্বব্যাপী বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে Merit should be the the predominant factor. উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির ঊর্ধ্বে বিচারব্যবস্থার অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগই নাগরিকের অধিকার ও সাংবিধানিক মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখে। বিচার সংক্রান্ত কাজ খুবই মহৎ ও দক্ষতা সম্পন্ন কাজ। কিন্তু আমরা ক্ষমতায় অন্ধ হওয়ার কারণে বিচারব্যবস্থার মত প্রতিষ্ঠান সর্বোপরি রাষ্ট্রকে উপনিবেশিকতার হাতিয়ারে পরিণত করে ফেলি। ন্যায় সঙ্গত বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়া রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও  নৈরাজ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংবিধান ও বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার জরুরি।

সংবিধান ও বিচার বিভাগের  আশু সংস্কারের লক্ষ্যে
১. আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রয়োজন ও জনগণের অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে সংবিধানকে গতিশীল নির্দেশিকায় পরিণত করার জন্য সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের জন্য 'সাংবিধানিক কমিশন' গঠন;
২. বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার, বিচারক নিয়োগের নীতিমালা ও নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য 'বিচারক কমিশন' গঠন করা;
৩. প্রজ্ঞাবান ও উচ্চতম নৈতিকতার অধিকারী বিচারকদের নিয়ে 'সাংবিধানিক আদালত' গঠন করা;
৪. উপনিবেশিক আইন বাতিল করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা;
৫. রায় বিক্রিকারী বিচারকদের অপসারণ এবং দ্রুত শাস্তির আওতায় আনার জন্য সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে কার্যকর করা;
৬. বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ( কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরসহ)ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিমকোর্টের উপর ন্যস্ত করা অর্থাৎ ৭২'এর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করা।

আদালতের নির্দেশে দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের ছুঁড়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। কারণ আদালতের নির্দেশ সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। এখনই দুর্নীতি অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আওয়াজ তুলতে হবে। স্বাধীন রাষ্ট্রকে উপনিবেশিত করার চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে। রক্তে অর্জিত রাষ্ট্রকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত করার অধিকার কারো নেই।

বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত থাকার অর্থ হলো রাষ্ট্রের ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করা।

প্রদত্ত রায়ের প্রেক্ষিতে এখন রাষ্ট্র কি ভূমিকা গ্রহন করে তার উপর নির্ভর করবে বিচার বিভাগের ‘আদর্শ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত হওয়ার প্রশ্নটি। 

লেখক: শহীদুল্লাহ ফরায়জী
গীতিকার
৫ অক্টোবর ২০২০
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর