× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ভাসানীর তুলনা ভাসানী নিজেই

মত-মতান্তর

আতিকুর রহমান সালু
১৬ অক্টোবর ২০২০, শুক্রবার

মূল কথায় যাওয়ার আগে মওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলন সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কাগমারীতে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি ৮, ৯ ও ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সম্মেলন। উক্ত সম্মেলন ডাকা হয়েছিল ‘শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক’ সম্মেলনের নামে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে উক্ত সম্মেলন এতদঅঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষে রাখে এক অসাধারণ ভূমিকা। এই সম্মেলনই ইতিহাসে ‘ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন নামে খ্যাত’। উক্ত সম্মেলনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান সহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং দেশ-বিদেশের বরণ্য ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সহ লাখো মানুষের সমাগম হয়। আমার মরহুম পিতা নূরুর রহমান খান ইউসুফজাই ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের বঙ্গীয় শাসনতান্ত্রিক পরিষদের সদস্য ও মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষক। যিনি বরাবরই মওলানা ভাসানীর দেশপ্রেমের প্রশংসা করতেন।
সম্মেলনের দিন পিতার হাত ধরে সেই সম্মেলনে যোগদানের সুযোগ হয়। সে এক হৈ হৈ কা- ও রৈ রৈ ব্যাপার। সম্মেলনে আগমনের পথে পথে নির্মিত হয় অসংখ্য তোরণ। মওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, মওলানা শওকত আলী তোরণ, মহাত্মা গান্ধী তোরণ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তোরণ, শহীদ তীতুমীর তোরণ সহ অসংখ্য তোরণ। এছাড়া ছিল অসংখ্য দোকানপাট, চুড়ি, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, চায়ের স্টল ও খাবারের দোকান। এই সম্মেলনে বিশাল বিশাল ডেকচি করে চাল-ডাল, গোস্ত ও সবজি দিয়ে রান্না হতো সুস্বাদু খিচুড়ি। যা হুজুর ভাসানীর খিচুড়ি নামে এখনও বিখ্যাত। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, এত তোরণ তার মধ্যে হুজুর ভাসানীর নামে কোনো তোরণ ছিল না। কারণ হুজুরের নিষেধ ছিল তার জীবদ্দশায় তার নামে কোনো তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। ভারতের ধুবড়ি, আসাম, ভাসানচরে, টাঙ্গাইলের, সন্তোষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়ার মহীপুর, পাঁচবিবিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন যত মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার কোনোটিতেই তিনি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের নাম ব্যবহার করেননি। যথার্থ অর্থেই তিনি ছিলেন নির্লোভ ও দুর্লভ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। ছিল না কোনো ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা। সেই অবস্থায় কাগমারীর মতো অজপাড়াগাঁয়ে এই ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করা সহজসাধ্য ছিল না।
ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন করে হুজুর ভাসানী সেই অসাধ্য সাধনই করেছেন। এই সম্মেলনেই তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মানুষের উপর, শোষণ, জুলুম ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বর শাসক গোষ্ঠীকে বলেছিলেন ‘আস্সালামো আলাইকুম’। সেই বক্তৃতা এখনও কানে বাজে। পশ্চিম পাকিস্তানের বিজাতীয় শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের জনসভায় বলেন, ‘অনেক সংগ্রাম-আন্দোলন করে ও রক্ত দিয়ে বৃটিশকে তাড়িয়ে পাকিস্তান আমরা আনলাম তার মূল উদ্দ্যেশই ছিল এই অঞ্চলের মানুষ তাদের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে, পাবে অর্থনৈতিক মুক্তি, কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় আমাদের এই অঞ্চলের মানুষকে তোমরা স্বায়ত্তশাসন দেয়া তো দূরের কথা, ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ করলা, ছাত্র পাবলিক হত্যা করলা। ১৯৫৪ সনের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েও মন্ত্রিসভা গঠন করার পরপরই ৯২ ‘ক’ ধারা জারি করে পার্লামেন্ট ভেঙে দিলা। আমাদের স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার এইভাবে যদি ক্ষুণœ করতে থাক এবং এই শোষণ-জুলুম ও বেইনসাফী কাজ-কারবার যদি চলতে থাকে তবে জেনে রাখ আমি তোমাদের ‘আস্সালামো আলাইকুম’ দিতে বাধ্য হবো। সে ছিল এক অসাধারণ বক্তৃতা।
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণাঞ্চলে ১৫ লাখ আদম সন্তানের মৃত্যু হয়। হুজুর মৃত্যুশয্যা থেকে পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় কিছুটা সুস্থ হয়ে ঘূর্ণিদুর্গত এলাকা সফর করেন। ঐ সফরে আমিও তার সঙ্গে ছিলাম। পাকিস্তানি জান্তারা আগে ভাগে কোনো সতর্কীকরণ বার্তা প্রদান করে নাই। ঝড়ের পরেও দেখতে কেউ আসে নাই। হুজুর উপদ্রুত এলাকা সফর করে ১৯৭০ এর ৪ঠা ডিসেম্বর আবার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে করেন এক বিশাল জনসভা। সেই জনসভায় মওলানা ভাসানী তার বক্তৃতায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর উদ্দেশে বলেন, ‘১৯৫৭ সালে আজ থেকে ১৩ বছর পূর্বে কাগমারী সম্মেলনে আমি বলেছিলাম যে, পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের প্রতি তোমাদের শোষণ, জুলুম ও বেইনসাফী কার্যকলাপ বন্ধ না হলে আমি ‘আস্সালামুআলাইকুম’ দিতে বাধ্য হবো। সর্বনাশা ঝরে লক্ষ-লক্ষ লোক মরলো, তোমরা কেউ দেখতে আসলে না। ঝড়ের আগাম খবর দিলা না। গাছের ডালে, ঘরের চালে, ক্ষেতে খামারে দেখে আসলাম শুধু লাশ আর লাশ ও শত শত মৃত গবাদি পশু। মানুষের ঘর-বাড়ি নাই ঝড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আজ আমি চূড়ান্তভাবে তোমাদের জানাচ্ছি ‘আস্সালামুআলাইকুম’। বলছি ‘লাকুম দ্বীনিওকুম ওয়ালিয়াদ্বীন- তোমাদের সঙ্গে আর আমাদের সমাজ জামাত করা যাবে না। এরপর তিনি বলেন, ‘আজ তাই একদফা, স্বাধীনতার দফা আমি উত্থাপন করছি। এই বক্তৃতা আমার মতে হুজুর ভাসানীর সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। আমি সেদিন মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলাম। দেখি পাশেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান বক্তৃতা শুনছেন। মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা শুনে জনসভায় উপস্থিত অনেককেই হু-হু করে কাঁদতে দেখেছি। এই বক্তৃতা শুনেই কবি শামসুর রাহমান লেখেন, হুজুরকে নিয়ে় তাঁর ঐতিহাসিক ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা। ১৯৬৯ সনের ছাত্রদের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের কথা সর্বজন বিদিত। সেই সভার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানীর বজ্রনিঘোষ ঘোষণা এখনও কানে বাজে। অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে জেলের তালা ভেঙে তাকে মুক্ত করা হবে। এই ঘোষণার পরপরই শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচন মওলানা ভাসানী বর্জন করেন। তিনি জেনে-বুঝেই এই সিদ্ধান্দ গ্রহণ করেন। তিনি তখন সংকল্পবদ্ধ ছিলেন পাকিস্তান ভেঙে এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব স্বাধীন আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি জানতেন, নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ, ২০/৫০টি সিট পেলে আর পাকিস্তান ভাঙা সহজ হবে না। অনেক সাহস নিয়ে আমি সেদিন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম হুজুর আওয়ামী লীগকে ‘ব্ল্যাং’ চেক দিলেন। হুজুর একটু রাগতভাবে বললেন, ‘বেশি বোঝ, পরক্ষণেই মৃদুহেসে বললেন, ‘তোমরা না দেশ স্বাধীন করবা, বিপ্লব করবা, যাও কাজ কর, কাজ কর, এখন কাজের সময়।’ আমি এখনও ভেবে অবাক হই যে, মওলানা ভাসানী জেনে-বুঝেই পাকিস্তান ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েই নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ যাতে স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আগুয়ান হয় এই জন্যেই কৌশলী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কি যথার্থ অর্থেই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন। দলকানা ও অর্বাচীন যারা তারা অনেক সময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার তুলনা করতে উদ্যত হয়। ইতিহাসের সত্য এই যে, শত বৈরীতা সত্ত্বেও ভাসানী-মুজিবের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের। আর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ও তার উপস্থিতিতেই টাঙ্গাইলের সন্তোষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্নেহধন্য হিসেবে এবং তাকে কাছ থেকে দেখার যে সৌভাগ্য হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলবো যে, ভাসানীর তুলনা ভাসানী নিজেই। মরেও তিনি অমর তার কর্মে। মৃত ভাসানীর চেয়ে জীবিত ভাসানী অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। মৃত্যুর ৬ মাস আগে ১৯৭৬ এর ১৬ই মে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ এখনও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। দেয় উৎসাহ-উদ্দীপনা। মাথা উঁচু করে কি করে বাঁচতে হয়। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মওলানা ভাসানী তাই যুগে যুগে জোগাবে শক্তি-সাহস ও অনুপ্রেরণা।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর