করোনায় স্থবির শিক্ষাব্যবস্থা। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পাচ্ছেন অটোপাস। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সশরীরে পরীক্ষার বিকল্প পদ্ধতি অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সম্মতি দিয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররা (ভিসি)। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির তৈরি করা সফটওয়ারে এই পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব এসেছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। কারণ যত উন্নত সফটওয়ারই হোক না কেন বাসায় বসে যে পরীক্ষা দেবে সে অন্যের সহযোগিতা নিয়েছে কিনা এটি কোনোভাবেই যাচাই করা যাবে না। অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে এমন নানা প্রশ্ন আসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনাও প্রকাশ করেছে। এবার ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হবে। কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার পক্ষে। তিনি বলেন, এখনো অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে ভিসি স্যাররা এটাতে সম্মতি দিয়েছেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনলাইনে পরীক্ষার পক্ষে না। আমি মনে করি এটা দুরূহ কাজ। এর দুটো কারণ, এক বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীদের স্মার্ট ডিভাইস নেই। দুই, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং নেটওয়ার্কের সমস্যা হতেই পারে।
অনলাইনে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এ থেকে নগরের বাইরের ভর্তিচ্ছুরা বৈষম্যের শিকার হবেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত বছরের মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় না করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা। তাদের মতে যেহেতু এবার এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি তাই এই ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করলে মেধার মূল্যায়ন হবে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পরীক্ষা নেবে না। এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই কলেজগুলোতে ভর্তি করা হবে।
বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একাধিক শিক্ষার্থী তাদের শঙ্কার কথা তুলে ধরেন। নীলফামারীর প্রত্যন্ত এলাকা চিলাহাটীর শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামের বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়ছেন সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে। তাদের বাড়িতে এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছাইনি। সাইফুল বলেন, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। সেখানে স্মার্ট ফোন অকল্পনীয়। এই অবস্থায় পরীক্ষা দেয়াটা আমার জন্য কষ্টসাধ্য। আর মোবাইল নিয়ে যদি পরীক্ষার হলেও বসি এই ডিভাইসের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়াতেও সময় লেগে যাবে। তার থেকে বড় কথা আমাদের এলাকায় নেটওয়ার্কের অবস্থা এতো খারাপ মাঝে মাঝে মোবাইলে কথা বলতেও আটকে যায়।
রংপুরের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, পরীক্ষা হবে অনলাইনে এতে অনেক শিক্ষার্থী অনৈতিক সুবিধা পাবেন। এই পরীক্ষায় তো আরেক শিক্ষার্থী পাশে কয়েকজন নিয়ে পরীক্ষা দেবার সুযোগ পাবে। যার ফলে বঞ্চিত হবো আমরা।
শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবেন এই অ্যাপসের নাম ‘প্রক্টরড রিমোট এক্সামিনেশন’। এটির উদ্বোধন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর। তিনি বলেন, এ সফটওয়্যারটি মোবাইল বেইজড একটি অ্যাপস। তবে অফলাইনেও যাতে কাজ করে সেজন্য সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হচ্ছে। এতে পরীক্ষা দেবার জন্য প্রথম ও শেষ ১০ মিনিট ইন্টারনেট সংযোগের মধ্যে থাকতে হবে। অ্যাপসটি ওপেন করার পর শিক্ষার্থীর মোবাইলের ক্যামেরার কন্ট্রোল এবং সঙ্গে সাউন্ডেরও কন্ট্রোল এডমিন নিয়ে নেবে। মোবাইলের স্ক্রিন কন্ট্রোলও থাকবে এডমিনের হাতে। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে থেকে যখন অ্যাপসটি অন করবে তখন আমরা তাদের লাইভ মনিটরিং করতে পারবো। অফলাইনে থাকলে ছবি এবং সাউন্ড রেকর্ড করা থাকবে। এটা পরবর্তী সময়ে আমাদের সার্ভারে চলে আসবে। তখন আমরা বুঝতে পারবো তিনি নকল করেছে কি না। এই অ্যাপসের মাধ্যমে এমসিকিউ ও লিখিত দুই ভাবেই পরীক্ষা নেয়া যাবে।
তিনি আরো বলেন, স্ক্রিন শট নিয়ে মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ বা ভাইভার বা অন্য কোনো অ্যাপে পরীক্ষার্থী প্রশ্নগুলো পাঠিয়ে দিলে সেটা ধরা যাবে। কোনোভাবে ঐ সফটওয়্যার মিনিমাইজ করার চেষ্টা করলে তাকে ওয়ার্নিং দেয়া হবে। বন্ধ করে দিলে পরীক্ষা শেষ হবে। আর সে পরীক্ষায় প্রবেশ করতে পারবে না। অন্য ডিভাইসেও করতে পারবে না। যেহেতু তাকে প্রতিটি মুহূর্তে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ কারণে সবকিছু সার্ভারে রেকর্ড হয়ে থাকবে।
এই বিষয়ে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টার (এপিনিক)’র পলিসি চেয়ার ও ফাইবার অ্যাট হোমের চিফ টেকনোলজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির বলেন, প্রথমত সকল শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন আছে কী না? তারপর অ্যাপসের মাধ্যমে কে পরীক্ষা দিচ্ছে এটা নির্ধারণ করা কঠিন হবে। সেইসঙ্গে যেহেতু কয়েক লাখ শিক্ষার্থী একসঙ্গে পরীক্ষা দিতে বসবেন এই সময়টায় নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এটা সম্ভব তবে এর জন্য থাকতে হবে ব্যাপক প্রস্তুতি। আর অফলাইনে যাবার পরেও নিয়ন্ত্রণের বিষয় যেটি আসছে এটির জন্যও রাখতে হবে ব্যাপক প্রস্তুতি। কারণ সার্ভার যাতে ব্রেকডাউন না করে। একবার ব্রেকডাউন করলে প্রশ্ন তোলার অনেক সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর এর মাধ্যমে সঠিক মেধার মূল্যায়ন হবে না। সম্প্রতি এক জরিপে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্ট ডিভাইস নেই। আর এ থেকে অনুমেয় ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীদের সংখ্যা আরো অনেক কম। ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে পাঠদানে অংশ নিতে পারছেন। আর অনলাইনে ক্লাসে যুক্ত মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আশরাফুল আলম নামে এক শিক্ষার্থী ‘কী প্রয়োজন’ নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। পেয়েছেন সম্মাননার পাশাপাশি সুনাম। তিনি বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে অনলাইন ভর্তি পরীক্ষা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে চাই দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, করোনার কারণে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই অবস্থায় অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো ভালো উপায় নেই বলেই আমার মনে হয়। এটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে চিন্তা ভাবনা করেই নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার শুধু বলা তাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি থাকতে হবে যাতে এই পরীক্ষাটা মানসম্মতভাবে নেয়া যায়।