× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কোস্ট লাইফের ছয় মাস

চলতে ফিরতে

সৈয়দা তাহসিনা হৃদিতা
২৫ নভেম্বর ২০২০, বুধবার

প্রায় ছয় মাস চলছে বাংলাদেশের অন্যতম উপকূলীয় পর্যটন অঞ্চল কক্সবাজারে বাস করছি। ইচ্ছে ছিল প্রথমদিন থেকেই দিনলিপি লিখবো কিন্তু বাস্তবতায় তার কিছুই হয়নি। তাই ছয় মাসের সারমর্ম দাঁড় করাবার একটা চেষ্টা।

চলুন, আমার সাথে। একটু ঘুরে আসি এই অন্যতম পর্যটন জেলা থেকে। তবে পর্যটক হিসেবে নয়, একজন উদ্বাস্তু হিসেবে।  

বিশ্ব মহামারি করোনার লকডাউনের মধ্যে আমি এখানে আসি। কর্মসূত্রেই আসা। পর্যটক হিসেবে যেভাবে কক্সবাজারকে দেখে অভ্যস্ত ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখলাম এসে।
যে এলাকায় পর্যটন মৌসুম ছাড়াও পর্যটকদের ভীড় থাকে সেখানে চারদিক খাঁ খাঁ করছে বিশেষ করে সৈকত দেখার মত নীরব, জনমানবহীন। নিজের এই রূপ দেখে নিশ্চয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সমুদ্র বেচারা। মনুষ্যবিহীন বীচগুলো ক্রমেই লাল কাঁকড়াদের দখলে চলে যায়। ইচ্ছেমতো সারাদিন বালুচরে বিচরণ করে। কারণ জ্বালাতন করার কোন মনুষ্যপ্রাণী নেই। কক্সবাজার আসার আগে খুব শুনেছিলাম, ডলফিনরা নাকি মাঝে মাঝে সৈকতের আশেপাশে দলবেঁধে উঁকিঝুঁকি মেরে যায়। ভাবলাম এসে নিজের চোখে দেখবো। কপাল মন্দ সৈকতে যাওয়া হত না ঐ সময়ে, ডলফিন দেখা তো দূরে থাক। কপাল এক্ষেত্রে সুপ্রসন্ন না হলেও বাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রসন্ন হল। আমি যেই বাসায় থাকি তার বারান্দা থেকে খুব সুন্দর সমুদ্র দেখা যায়। লকডাউন থাকার ফলে বাইরে অতীব প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া হতই না। তাছাড়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার একটা আতঙ্ক তো ছিলই। সারাদিন বারান্দায় দাঁড়িয়েই সমুদ্র দেখতাম। খুব একটা কাছে না যাওয়ার আপসোস হত না যদিও। আমি পাহাড়প্রেমী মানুষ, সমুদ্র না ছুঁয়ে থাকতে পারলেও কেবল পাহাড় দেখলেই বেয়ে উঠে যেতে ইচ্ছা করে।   

বাসা থেকে কাজ করতে হতো বলে অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। উখিয়া বা টেকনাফ তখনও যাওয়া শুরু করিনি। সহকর্মীদের সাথে শুধু অনলাইনে কথা হয়। কথা বলতে মিটিং। কাউকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ নেই। আহ! প্রথম দিকের মিটিংগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও মাথা গুলিয়ে উঠে। ৯০ ভাগই মাথার উপর দিয়ে চলে যেত। ১০ ভাগ গলার স্বর দিয়ে নাম মনে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে গলার 'ইনটোনেশান' সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করে ফেলি। যদি এই বিষয়ে গবেষণা করতাম ভাল একটা জার্নালে হয়তো প্রকাশও করে ফেলতে পারতাম এতদিনে।

এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার ঘন ঘন পোস্ট করা ছবি বন্ধুমহলে যে  কিঞ্চিৎ হিংসার আগুন জ্বালায়নি তা কিন্তু নয়। এই লকডাউনে বাসায় থেকে থেকে ছেলেপেলেগুলো একেতো অস্থির তার উপর আমার ছবি দেখে তাদের জীবন একটু অতিষ্ঠ হবে খুবই স্বাভাবিক। বন্ধুরা যারা পড়ছো তাদের বলছি, আমি দুঃখিত তোমাদের জীবনের আগুনে হাল্কা ঘি ঢেলে দেওয়ার জন্য।  


রান্না করে, খেয়ে, সমুদ্র দেখে এভাবেই দিনপাত করছিলাম। এরমধ্যে এক সহকর্মী আমার বিল্ডিং এ-ই এসে উঠেছে। মেয়েটাকে প্রথমবার দেখেই বুঝে ফেললাম এই একজনই যথেষ্ট আমার কোস্ট লাইফে ঢেউ এনে দিতে। একদিন এই সহকর্মী বন্ধুকে নিয়ে একটু সৈকতে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু পুলিশের তাড়া খেয়ে চলে আসতে হল। এর কিছুদিনের মধ্যেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যাওয়া আসা শুরু হয়। খুব চমৎকার উপভোগ করার কিছু যদি জীবনে এসে থাকে তাহলে তা হল প্রতিদিন ভোরে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে উখিয়া আর টেকনাফ যাওয়া আসা। দীর্ঘ রাস্তায় এতোটুকু ক্লান্তি অনুভব হয় না। এর মাঝে একদিন খুব ভোরে উখিয়া যাওয়ার পর দেখি মেরিন ড্রাইভ বীচে মানুষের ভীড়। একটু খোঁজ করতেই জানা গেল, বীচে নাকি সোনা-রূপা পাওয়া যাচ্ছে। তাই সবাই ভীড় জমিয়েছে, যদি সোনা-রুপা কিছু পাওয়া যায়! আমি কাজ শেষে বাসায় ফিরে সহকর্মী বন্ধুটিকে নিয়ে গেলাম বীচে যদি সোনা-রুপা, মনি-মুক্তা কপালে জোটে। ভাগ্য বরাবরের মতোই খুব খারাপ। একরতি সোনা-রূপা না পেয়ে বীচ থেকে সহকর্মী বন্ধু কিছু বোতল কুঁড়িয়ে নিয়ে এলো তাতে গাছ লাগাবে বলে। তার আবার বেজায় ইনডোর গার্ডেনিং এর শখ। আমাকেও দুইটা বোতলে কি সুন্দর দুইটা গাছ দিয়ে গেলো। কিসের বোতল জিজ্ঞেস করে কেউ লজ্জা দিবেন না যেনো!

ভীড়ের এই শহর কিছুদিন নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ থেকে ধীরে ধীরে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। করোনার প্রকোপ না কমলেও ভয়ের থাবা অনেকটাই শিথিল এখন মানুষের মধ্যে। দলবেঁধে আবার পর্যটকরা আসতে শুরু করেছে। সৈকতে মানুষের ভীড়ে এখন যাওয়াই দায়। লকডাউনের সময় বেশ পরিষ্কার থাকার পর আবার আবর্জনা আর মানুষের পদচারণায় পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে আমি আবার একদিন বেলুন নিয়ে আকাশে উড়ে মানে প্যারাসেইলিং করে এলাম। দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রকে পাখির মত আকাশে ভেসে দেখার এক দারুণ অনুভূতি। অনুভুতির এক বেড়াজালে জড়িয়ে যাচ্ছি যেন দিনদিন। ইদানীং রাত বাড়লেই সমুদ্র কাছে ডাকে। সব কাজ ছেড়ে ছুড়ে সমুদ্রের কাছে যেতে ইচ্ছা করে। কিছুদিন আগেই ভরা পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নায় স্নান করলাম। এই অনুভুতির বর্ণনা না হয় আরেকদিন হবে। সমুদ্রের একটা ম্যাজিক কি জানেন- সে আপনার অহম নিমেষেই ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। কানপেতে থাকলে সমুদ্রের অট্টহাসিও শোনা যায়। সে হাসি কেমন যেন বিষন্নতায় আচ্ছন্ন করে দেয়। একবার এক বইয়ে পড়েছিলাম যারা জাহাজে কাজ করে, দিনের পর দিন সমুদ্রে ভেসে থাকে, তারা বেশিদিন সমুদ্র ছাড়া থাকতে পারে না। জানিনা আমার সাথেও কখনো এমন হবে কিনা এ জায়গা ছেড়ে চলে গেলে।  

[লেখকঃ UNV ইউএনভি চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার, UNICEF, কক্সবাজার]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর