× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আমার স্মৃতিতে ম্যারাডোনা

প্রথম পাতা

মতিউর রহমান চৌধুরী
২৭ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার

কে বিশ্ব সেরা? পেলে না ম্যারাডোনা? ফুটবল দুনিয়া এ নিয়ে বিভক্ত। তবে ম্যারাডোনার দিকেই পাল্লা ভারী এতে কোনো সন্দেহ নেই। পেলের খেলা মাঠে দেখিনি। সুযোগও হয়নি। টিভিতে দেখেছি অবশ্য। ম্যারাডোনার খেলা মাঠে দেখেছি। কথা বলেছি । সাক্ষাৎকার নিয়েছি।
দু’টি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দেখেছি। একবার দেখেছি আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে। ৯০ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ইতালিতে। সেই আসরে আমি একমাত্র বাংলাদেশি সাংবাদিক। আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকে কূটনৈতিক রিপোর্টার। ফুটবলের প্রতি নেশা জেগেছিল টিভিতে ৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার জাদু দেখে। ইচ্ছে জাগলো- খেলা কভার করার সুযোগ যদি পেতাম। সরাসরি চলে গেলাম আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কাছে। ইত্তেফাকের অন্যতম কর্ণধার মঞ্জু ভাই তখন এরশাদের মন্ত্রী। সচিবালয়ে তার অফিস কামরায় প্রবেশ করতেই বললেন কি মতি এই সময়ে সচিবালয়ে। ইচ্ছের কথা বললাম। ভাবনা-চিন্তা না করেই বললেন কি করতে হবে? আমার তো অ্যাক্রিডিটেশন নেই। ইতালি দূতাবাসকে বলতে হবে। ঠিক আছে বলে দিচ্ছি। একজন ব্যবসায়ীকে বললেন ফোনে। আমার রিপোর্টার ইতালি যাবে। ভিসা প্রয়োজন। ভদ্রলোকও সঙ্গে সঙ্গে বললেন পাঠিয়ে দিন। একদিনে ভিসা হয়ে গেল। টাকার কথা বলতে হয়নি। ইত্তেফাকের হিসাব বিভাগকে মঞ্জু ভাই আগেই বলে দিয়েছেন। মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার মজাই আলাদা। ’৮৭ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরেও তার সহযোগিতায় প্রথম বাংলাদেশি সাংবাদিক ছিলাম। সৌভাগ্য কাকে বলে। ইতালি পৌঁছে রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমানের কাছে যেতেই বললেন, আমি শুনেছি আপনি আসছেন। দূতাবাস কি করতে পারে বলুন। একটা চিঠি লিখে দিতে হবে যাতে করে অ্যাক্রিডিটেশন পেয়ে যাই। আসলে এভাবে নিয়ম নয়। ফিফা’র মাধ্যমে আগেই অ্যাক্রিডিটেশন নিতে হয়। বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিক যেহেতু খেলা কভার করতে যেত না সেজন্য খবরটা অজানা ছিল। রাষ্ট্রদূতের চিঠি নিয়ে ফিফা’র মিডিয়া সেন্টারে যখন পৌঁছলাম তখন বিকাল হয়ে গেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপস্থিত নেই। অপেক্ষার পালা। দু’ঘণ্টা বাদে যখন অফিসার এলেন তখন চিঠি নিয়ে হাজির হলাম। অফিসার হতবাক। কারণ প্রথম কোনো বাংলাদেশি সাংবাদিক খেলা কভার করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। পাসপোর্ট দিতে বললেন। এবার অপেক্ষার পালা। আধাঘণ্টার মধ্যেই কাজ শেষ। আমার গলায় ঝুলে গেল অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। কি যে শান্তি। ভাবখানা আমি রাজা হয়ে গেছি। আবেগ এতোটাই কাজ করেছিল। মিডিয়া সেন্টারে কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হলো। এর মধ্যে জয়ন্ত চক্রবর্তী অন্যতম। জয়ন্ত তখন যুগান্তরে কাজ করে। আমিও এক সময় যুগান্তরে কাজ করেছি। এরপর এক সঙ্গে সংবাদ প্রতিদিনেও কাজ করেছি। এখন সে মানবজমিন-এর কলকাতা প্রতিনিধি।

যাকগে, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ম্যারাডোনাকে কাছ থেকে দেখতে হবে। প্রথমেই হোঁচট। ম্যারাডোনা প্রথম খেলাতেই হেরে গেলেন। ক্যামেরুনের রজার মিলারের গোল আজও চোখে ভাসে। চোখের জলে বুক ভেসে গেছে। ফুটবল বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল ফুটবল সম্রাটের পরাজয় দেখে। অঘটন ঘটে গেল। তাই বলে ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লো না। সবাই অপেক্ষায়- পরে কি হয়? আর্জেন্টিনা ফাইনালে গেল ঠিকই। পশ্চিম জার্মানি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। বিতর্কিত পেনাল্টি গোলে হেরে গেল আর্জেন্টিনা। মেক্সিকান রেফারির ভুল সিদ্ধান্তে পাল্টে গেল ইতিহাস। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে ভূমিকম্প হয়ে গেছে। গ্যালারির চেহারাও বদলে গেল। মিডিয়া সেন্টারে পৌঁছে রিপোর্ট লেখার চেষ্টা করছি। লেখা হচ্ছে না। তখন ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠাতে হতো। লাইন খারাপ থাকতো বেশির ভাগ সময়। ফোনে খবর দিতাম। খবর পাঠানোর সময় ভিড় হয়ে যেত আমার চিৎকারে। অপর প্রান্তে সারওয়ার ভাই। প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ার তখন ছিলেন বার্তা সম্পাদক। খেলাপাগল এই মানুষটি ইত্তেফাকের চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন। আমি সত্যিই ভাগ্যবান। ২৬ দিন টানা ইত্তেফাকে প্রধান শিরোনাম হয়েছিল ফুটবল। এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা।

ইতালি বিশ্বকাপেই ফুটবল জাদুকরের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। এক সকালে পৌঁছে গেলাম আর্জেন্টিনার ট্রেনিং মাঠে। শতাধিক সাংবাদিক। সবাই ম্যারাডোনার সঙ্গে কথা বলতে চান। স্প্যানিশ ভাষা জানি না। কারো সঙ্গে পরিচয় নেই। শুনেছিলাম ম্যারাডোনার সেক্রেটারি ইংরেজি জানেন। লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধাক্কা খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম ফুটবলের এই বরপুত্রের কাছাকাছি। তবে মুখোমুখি নয়। সেক্রেটারিকে বললাম, আমি বাংলাদেশের সাংবাদিক। শুনে কিছুটা হতবাক। কোথায় সেটা। ম্যারাডোনাকে যখন বাংলাদেশের কথা বললেন তখন আরো বিস্ময়। বললাম ইন্ডিয়ার পাশে। ইন্ডিয়া সম্পর্কে তার ধারণা আছে। ’৮৬ বিশ্বকাপেই একজন ভারতীয় ফটো সাংবাদিক তাকে পাঞ্জাবি পরিয়ে ছবি তুলেছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষের আবেগ আর ভালোবাসার কথা জানালাম। খুশি হলেন। বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ফিফা’র র‌্যাঙ্কিয়ে বাংলাদেশ তখন ১৬২ নম্বরে। অবাক হলেন। মন্তব্য করলেন না। সাক্ষাৎকারটি ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। 

মুডি ম্যারাডোনাকে নিয়ে উরুগুয়ের সাংবাদিক এডওয়ার্ডো যথার্থই লিখেছিলেন। তার ভাষায় ম্যারাডোনা হচ্ছেন ঈশ্বরের সেরা মানব। চার বছর পর ’৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ভিন্ন এক ম্যারাডোনাকে দেখলাম। নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন। এর আগে প্রথম পর্বের তিনটি ম্যাচের দু’টি খেলে বিদায় নেয়াটা ছিল ফুটবল ইতিহাসে এক দুঃখজনক অধ্যায়। ম্যারাডোনা নেই, বিশ্বকাপও যেন শেষ হয়ে গেছে। ম্যারাডোনা এক বাড়তি আকর্ষণ। বল যেখানে ম্যারাডোনা সেখানে। পায়ে না জানি কি ছিল। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ অন্য কোনো ফুটবল তারকার আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। জবাব পাবেন না। ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ভিন্ন পরিচয়ে। গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি নেই। এবার তিনি কোচ। আর্জেন্টিনা মাঝপথেই হোঁচট খেল। ম্যারাডোনা নিজ দেশেই হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন। তার কি করার ছিল। এটা ঠিক একজন ভালো ফুটবলার ভালো কোচ হবেন- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ম্যারাডোনাও হননি। ম্যারাডোনা অধ্যায়ের শেষ হলো। কিন্তু ম্যারাডোনা রয়ে গেলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে। ম্যারাডোনা তাই অমর। ফুটবল যতদিন থাকবে ততদিন ম্যারাডোনাও থাকবেন।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর