দুর্যোগে সবার আগে জনগণের মধ্য থেকে এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কোনো টাকা-পয়সার জন্য নয়। মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসেন তারা। জীবনকে বাজি রেখে উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন তারা। রানা প্লাজার উদ্ধার কাজে অংশ নিতে গিয়ে কায়কোবাদ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী গুরুতর আহত হন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। তবে তিনি রয়েছেন ৪৭ হাজার ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবীর মনে। স্বেচ্ছাসেবীদের ত্যাগকে স্মরণ করার জন্য বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী দিবস পালন করেছে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবীকে দেয়া হয়েছে সম্মাননা স্মারক। এদের মধ্যে ১৩ জনকে ফায়ার ফাইটিং ও ১২ জনকে সার্স অ্যান্ড রেসকিউ হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন।
কথা হয় পদকপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী ফাতেমা আক্তার দিবার সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছি। প্রথম প্রথম পরিবার থেকে সাপোর্ট করতেন না। এখন আমার পরিবারই দুর্ঘটনার খবর পেলে আমাকে আগে জানান। প্রশিক্ষণ নেয়ার পর থেকে আমার মধ্যে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়ার সাহস বহুগুণে বেড়ে গেছে। আসলে প্রশিক্ষণ নিলে অনেক সহজেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা প্রাণহানি ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন করে সদস্যের ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিং নেয়া উচিত। পদক পাওয়া আরেক স্বেচ্ছাসেবী রায়হান তুহিন কাজের স্বীকৃতি পেয়ে বেশ খুশি। তিনি বলেন, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত হইনি। তারপরেও যখন কাজের স্বীকৃতি পাওয়া যায়, তখন কাজের স্পিড আরো বেড়ে যায়। আমি আমার এই পদক মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করলাম। আর প্রতিজ্ঞা করলাম যেকোনো দুর্যোগে জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে অংশ নেবো। বন্ধু- বান্ধবদেরকেও এই কাজে যুক্ত করবো।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। আমরা বিভিন্ন দুর্যোগের সম্মুখীন হলেও এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সম্মুখীন হইনি। পৃথিবীতে সাধারণত একশ’ বছর পর পর ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ দেখা দেয়। আসাম-বাংলা অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালের দিকে। সে হিসেবে ১২৩ বছর হয়ে গেছে। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজে যাতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি আমাদের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবীরাও অংশ নিতে পারে সে লক্ষ্যে ফায়ার সার্ভিস দক্ষ স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তুলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং দ্রুত উদ্ধার তৎপতা শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সারা দেশে মোট ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তুলবো। এদের ১৮ হাজার জন থাকবে ঢাকায়। ইতিমধ্যে শুধু ঢাকা শহরের জন্য প্রায় চার হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ শেষ করেছে অগ্নি-নির্বাপক বাহিনী বা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
সূত্র জানায়, ভূমিকম্প ও অগ্নি-নির্বাপণ খাতে দেশে বর্তমানে মাত্র ছয় হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছেন। এটা দেশের যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় অপ্রতুল। তাই সরকার বেসরকারি এ স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তোলার কর্মসূচি হাতে নেয়। সিডিএমপি’র দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও জেলা শহর থেকে স্বেচ্ছাসেবী বাছাই ও নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। গোটা দেশে এ কর্মসূচির অধীনে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৬২ হাজার কর্মী গড়ে তোলা হবে। ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ২০০ জন করে ৯০ ওয়ার্ডে মোট ১৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। এসব কর্মীকে ভূমিকম্পের সময় করণীয়, পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা, উদ্ধার যন্ত্রের ব্যবহার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। একই প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীকেও। বিশেষ প্রশিক্ষণ পাওয়া কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবীরা কোনো ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নি-নির্বাপক বাহিনীকে খবর দেয়াসহ উদ্ধার তৎপরতা শুরু করবে। প্রয়োজনে প্রাথমিক চিকিৎসাও দেবে। ফলে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কমে আসবে।
প্রশিক্ষণ নেয়া নারায়ণগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবী ঝর্ণা মনি জানান, ২০১৭ সাল থেকে তিনি ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করছেন। এখানকার প্রশিক্ষণে তাদেরকে যা শেখানো হয়েছে, তাতে যে কোনো দুর্যোগের পর প্রাথমিক কাজগুলো দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবেন তারা। বিচ্ছিন্ন তৎপরতার চেয়ে দলগত প্রচেষ্টার ফলে দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণ বিভাগের সহকারী পরিচালক আব্দুল মোমেন মিয়া মানবজমিনকে বলেন, ২০১১ সালের ২৬শে জানুয়ারি স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রমটি শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এনজিও, সংস্থার সহায়তায় ৪৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। এখনো বাকি ১৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবী, যাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে চাই। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো ফান্ড নেই।