× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠক: কী হতে পারে আমাদের পরবর্তী কর্মপন্থা?

মত-মতান্তর

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন
২৬ ডিসেম্বর ২০২০, শনিবার

বিজয় দিবসের একদিন পর ১৭ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। বৈঠকটি সামনাসামনি না হলেও একটি শীর্ষ বৈঠকের জন্য যে ধরণের প্রাক-প্রস্তুতি কিংবা আচার-আয়োজনের প্রয়োজন তার কোনটারই কমতি ছিল না। যথারীতি শীর্ষ বৈঠকের ভাব-গাম্ভীর্যেও ছিল না কোন ঘাটতি। বিজয় দিবসে অনুষ্ঠিত না হলেও এ বৈঠক বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে- মুজিব বর্ষে। তাছাড়া, মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুসারে, ১৭ই ডিসেম্বর তারিখটিরও আলাদা গুরুত্ব ও ব্যাঞ্জনা রয়েছে। ১৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জিত হলেও উনি, উনার মা, উনার বোন শেখ রেহানা, ছোট ভাই শেখ রাসেল ও ছোট্ট ৪ মাসের শিশু পুত্র জয় পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন ১৭ই ডিসেম্বর তারিখে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল  (তৎকালীন মেজর) অশোক তারার সহায়তায়।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মোটা দাগে এ বৈঠকের অর্জন হল, দীর্ঘ অর্ধশতক পর ‘৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিলাহা‌টি-হল‌দিবাড়ী রেলসংযোগ পুনরায় চালু, কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই এবং তিনটি যৌথ প্রকল্প উদ্বোধন। সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে- কৃষি খাতে সহযোগিতা, হাইড্রোকার্বনে সহযোগিতার বিষয়ে রূপরেখা, হাতির সুরক্ষায় অভয়ারণ্য নিশ্চিত করা, নয়াদিল্লি জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সহযোগিতা, হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প চালু, বাংলাদেশ-ভারত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফোরামের টার্মস অব রেফারেন্স এবং বরিশালে সুয়ারেজ প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক। প্রকল্পগুলো হলো, খুলনায় ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে বাংলাদেশ-ভারত প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে বিবেকানন্দ ভবন এবং বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি আমদানি প্রকল্প।
এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে ভারতে উৎপাদিতব্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন সরবরাহের আশ্বাস দেন। আগামী মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যোগদানের আমন্ত্রণেও তিনি সাগ্রহে সম্মতি প্রদান করেন।

বাংলাদেশ ও ভারত দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীই দীর্ঘ মেয়াদে নিজ নিজ দেশের নেতৃত্বে আছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উষ্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। স্বাভাবিকভাবেই, দু’টি দেশ পারষ্পরিক সহযোগিতার নিত্য নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ককে আরও বেগবান করবে, এটাই প্রত্যাশিত। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক অনেক জটিল সমস্যার সমাধানে বড় ধরণের ভূমিকা রেখে থাকে। যখনই হোক আর যেখানেই হোক, রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে বৈঠক মানেই অনেক বড় ব্যাপার। সবার তীক্ষ্ণ নজর থাকে বৈঠকের ঘটনা প্রবাহ ও ফলাফলের দিকে। এ ধরণের বৈঠককে ঘিরে দীর্ঘদিনের নিবিড় প্রস্তুতি কাজ করে। সবাই আশায় বুক বেঁধে থাকে, দু’ দেশের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে বিবদমান অনেক সমস্যার জট খুলবে, পারষ্পরিক সহযোগিতা ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সেই বিচারে এ বৈঠক কতটুকু অর্থবহ হল? বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বড় বড় সমস্যাগুলোর কোন সমাধান সূত্র কি এই বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসেছে?

তাহলে একটু দেখা যাক, এ মুহূর্তে দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান প্রধান ইস্যুগুলো কী? একটি প্রধান ইস্যু হল, দু’দেশের মধ্যে প্রবাহমান ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি। এসব নদীর অনেকগুলোতে উজানে ভারতীয় অংশে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে পানির সংকট দেখা দেয়। ফারাক্কা ব্যারাজের প্রভাবে পদ্মায় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসন না হলেও পানি ভাগাভাগির বিষয়ে একটি চুক্তি হওয়াতে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলেছে। অন্য নদীগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ যাতে পানির ন্যায্য হিস্যা পায়, তা নিশ্চিতকরণে চুক্তির দাবি অনেক দিনের। বিশেষ করে, দেশের আরেকটি বড় নদী তিস্তার ক্ষেত্রে একটি চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে, কয়েক বছর হল। অনেকেই আশা করছিলেন, এ বৈঠকে এ বিষয়ে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে, যেটা বাস্তবে ঘটেনি।

দু’দেশের মধ্যে আরেকটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড। পরষ্পরের সাথে অত্যন্ত উষ্ণ ও আন্তরিক বন্ধুত্বের নিগড়ে আবদ্ধ দু’টি দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে এটি যেন একটি কলঙ্কের তিলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সীমান্তে ২৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ২১ জনই নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে। পৃথিবীর সবখানেই সীমান্তবর্তী লোকদের কমবেশি আন্ত-সীমান্ত চলাচল একটি সাধারণ ব্যাপার। এখানে অনেকেই স্রেফ দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে, হাটবাজার করতে কিংবা সীমান্তের ওপারে থাকা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এপার-ওপার করেন। আবার কিছু লোক চোরাকারবারের সাথে জড়িত থাকে। সীমান্তরক্ষীরা এ ধরণের অবৈধ যাতায়াত ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, তার জন্য গুলি করে হত্যা কতটুকু প্রয়োজনীয় ও গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে? ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনসহ আরও পাঁচটি দেশের সীমান্ত রয়েছে। এসব সীমান্তে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড বলতে গেলে শুন্য। তাহলে বন্ধু দেশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই এমনটি হচ্ছে কেন? এ বিষয়টি এবার যেমন, আগেও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে উত্থাপিত হয়েছে এবং ভারতের পক্ষ থেকে বার বার দেখার আশ্বাস মিলেছে। কিন্তু, সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বছর-ওয়ারি যে পরিসংখ্যান, তাতে এটি কতটুকু দেখা হয়েছে বা হচ্ছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বাংলাদেশের দিক থেকে আরেকটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। মিয়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে রাখাইন স্টেট থেকে বিভিন্ন সময়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।  সত্তর দশকের শেষ পাদে শুরু হয়ে এ যাবৎ কয়েক দফায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এ সময় সাড়ে ৬ থেকে ৭ লাখের মত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে। বাংলাদেশ বরাবরের মতো কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ সাড়া না মেলায় শরণার্থীদের প্রত্যাবসানে দৃশ্যত কোন অগ্রগতি হয়নি। দুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীনের এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে, এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের অনুকূলেই গেছে বলে প্রতীয়মান হয়। আপাতদৃষ্টিতে, এমন মনে হতে পারে, তারা মিয়ানমারকে কে কত বেশি কাছে টানতে পারে সে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে দুটি দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, তারা এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে খুব বেশি আমলে নেয়ার প্রয়োজন মনে করছে বলে প্রতীয়মান হয় কি? তাহলে কি তাঁরা বাংলাদেশকে একটি দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে? নাকি ধরে নিয়েছে, যতই যাই ঘটুক, বাংলাদেশ  তাদের সাথে থাকতে বাধ্য। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিকপঞ্জির নাম করে ওখানে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর অংশবিশেষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার একটি পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবসান নিশ্চিত করা না গেলে এসব কুচক্রী মহল তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত বোধ করতে পারে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হল, বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ভারত থেকে  ৭ হাজার ৬৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৯৩০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ এ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৭১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। (বাংলা ট্রিবিউন, ২৬ জুন, ২০২০) জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত অনেক বড় বাজার। তাহলে, বাংলাদেশ ওখানে ভাল ব্যবসা করতে পারছে না কেন? ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদার অপ্রতুলতা? রপ্তানি করার মতো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পণ্যের অভাব? দুর্বল পণ্য বিপণন কার্যক্রম? নাকি বাংলাদেশী পণ্যের মুক্ত প্রবেশে বাধা? ব্যবসায়িক মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ অশুল্ক বাধা (ননট্যারিফ ব্যারিয়ার) এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। কারণ যাই হোক, এই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি নির্দেশ করে, ভারতীয় পণ্য বাধাহীনভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য সেভাবে ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। এ বিষয়টি বাংলাদেশ-ভারত আলোচনায় একটি নিয়মিত ইস্যু হিসেবে এসেছে। এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়েছে কিনা তা পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝা যায়।

এভাবে একে একে বলতে গেলে এ তালিকাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তবে, মোটা দাগে, এগুলোই হয়ত এ মুহূর্তের জ্বলন্ত ইস্যু। এবার বাংলাদেশের কাছে ভারতের কী কী চাওয়া-পাওয়া ছিল, সেদিকে একটু নজর বুলানো যাক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় বিদ্রোহীদের কোন ঘাঁটি থাকলে সেগুলো উচ্ছেদ করা এবং বাংলাদেশের সমুদ্র-নৌ বন্দরসমূহ এবং রোড-রেল-রিভার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে সংক্ষিপ্ত পথে পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রানজিট সুবিধা লাভ- এগুলোই ছিল বাংলাদেশের কাছে ভারতের মূল চাওয়া এবং এসব চাওয়ার প্রায় সবই পূরণ করা হয়েছে। প্রথম চাওয়াটা একটি দেশের ন্যায্য চাহিদা হিসেবে বিবেচিত হলেও ট্রানজিট সুবিধার বিষয়টি অপরিহার্য কোন চাহিদা ছিল না। কারণ, উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে যাওয়ার জন্য ভারতের কাছে বিকল্প পথ আছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের যে সব চাওয়ার কথা উপরে উল্লেখ করা হল, এর বেশির ভাগই ন্যায্য পাওনা, দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়।

এ দেশের ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে সেই ১৯৭১-এ এক অতি কঠিন মুহূর্তে ভারত অম্লানবদনে সর্বস্ব নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই, ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ়তর করাই আমাদের প্রাধিকার হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটা শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের সহযোগিতার জন্যই নয়, আমাদের চারিদিকে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবেও। ব্যক্তি জীবনে প্রতিবেশীর সাথে বনিবনা না হলে আপনি বাড়ি বদল করতে পারেন, কিন্তু একটি রাষ্ট্রের পক্ষে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বদলানোর কোন সুযোগ নেই। কাজেই, ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই আমাদের ন্যায্য পাওনাগুলো আদায় করতে হবে। প্রশ্ন হল, যেখানে বাংলাদেশ ভারতের নিকটতম বন্ধুদের অন্যতম এবং এ বন্ধুত্ব কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, সেখানে বাংলাদেশ যখন ভারতকে তার ন্যায্য পাওনার বাইরে গিয়েও অনেক বড় ধরণের সুবিধা দিচ্ছে, ভারত কেন বাংলাদেশের ন্যায্য চাওয়াগুলো পূরণে ঔদাসীন্য দেখিয়ে যাচ্ছে। এটা কি আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি ভারতের সদিচ্ছার অভাব? এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থই মূখ্য, আবেগ-অনুভূতির স্থান সামান্যই। যতক্ষণ না আপনি প্রতিপক্ষের সাথে শক্ত অবস্থান নিয়ে দরকষাকষি করতে পারছেন, আপনার ন্যায্য দাবিকে হেলা-ফেলা করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রতিপক্ষকে বুঝাতে হবে, এসব ন্যায্য পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে ক্রমাগত শৈথিল্য প্রদর্শন পারষ্পরিক সম্পর্কে ভাটার টান আনতে পারে।

এটাই হল মূল কথা। আপনার বার্গেনিং পাওয়ার কতটুকু। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ২০১৭ সালে নেপালের একজন মাত্র নাগরিক সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় নেপালের জণগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয় এবং তা প্রশমনে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ডর নিকট দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হন। তাহলে, বাংলাদেশের শত শত নাগরিক সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পরও ভারত সরকার নির্বিকার থাকে কিভাবে? এখানেই প্রশ্ন আসে, আমরা বিবদমান ইস্যুসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের আবেগ-উদ্বেগ কতটা জোরালোভাবে প্রতিপক্ষের কাছে তুলে ধরতে পারছি?

'৭১ সালে আমাদের কাছে পাকিস্তানী বাহিনী হেরে গিয়েছিল, কারণ জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। আজও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সক্ষম। বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। দেশের অধিকাংশ মানুষ নৃতাত্ত্বিকভাবে একই জাতিগোষ্ঠীভূক্ত হওয়ায় সঠিকভাবে উজ্জীবিত করা গেলে মৌলিক জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে এদের মধ্যে আবারও ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক/সামাজিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপনি দল-মত নির্বিশেষে সকলকেই অভিন্ন অবস্থানে দেখতে পাবেন। এটাই হতে পারে আন্তরাষ্ট্রীয় নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নেয়ার জন্য আমাদের শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস। কাজেই, কে ক্ষমতায় আছেন কিংবা ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছেন,  সেটাকে বড় করে না দেখে সব ধরণের মতপার্থক্য ভুলে, মৌলিক জাতীয় ইস্যুতে দেশের আপামর জনতাকে সচেতন ও উজ্জীবিত করতে  আমাদের সকলের একযোগে জোরালো ক্যাম্পেইনে অবতীর্ণ হওয়া দরকার।

আপাতত বিবদমান সমস্যাসমূহ নিরসনে একটি স্বল্প-মেয়াদী পরিকল্পনা হতে পারে, আগামী মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আবারও হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠকের যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটাকে টার্গেট করে এখনই কোমর বেঁধে নেমে পড়া। পাশাপাশি, দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যাসমূহ সমাধানে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করে যাওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারী পর্যায়ের চৌকষ, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে এক বা একাধিক বিশেষ সেল গঠন করা যেতে পারে, যারা গভীরভাবে বিবদমান ইস্যুসমূহ বিশ্লেষণ করে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে অধ্যাবসায়ের সাথে কাজ করে যাবে। এছাড়া, দেশের সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন, বেসরকারি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান এবং থিঙ্ক-ট্যাঙ্কসমূহও স্ব-উদ্যোগে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে পৃথিবীটা আজ অনেক ছোট হয়ে এসেছে। বিশ্বজনমত ও আন্তর্জাতিক চাপ এধরণের দীর্ঘ-মেয়াদি আন্ত-রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। আপনি এমন দেশ খুব কমই খুঁজে পাবেন যারা বিশ্বপরিমন্ডলে কদর্য রূপে চিত্রিত হতে চায়। কাজেই, বিশ্বপরিমন্ডলে কে বা কারা আমাদের সমব্যথী/সহযোগী হতে পারে তা বুঝে তাদের সাথে সক্রিয়ভাবে আমাদের দুঃখ-বেদনাসমূহ শেয়ার করার বিষয় সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে  প্রয়োজনমাফিক সরবে-নীরবে আমাদের উদ্বেগসমূহ তুলে ধরে জনমত সৃষ্টি করা চাই। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীরাও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। মোট কথা, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা অমীমাংসিত ইস্যুসমূহকে সামনে রেখে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক, দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্ভাব্য সবধরণের কৌশল খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই হয়তো একটি দ্রুত নিষ্পত্তি দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।
সবাই ভাল থাকুন।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর