× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ওরা অক্সিজেনের ফেরিওয়ালা / ৬ মাসে সেবা পেয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ

এক্সক্লুসিভ

মনির হোসাইন
১৬ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার

করোনার পিক আওয়ার। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। আক্রান্ত রোগীর অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা অন্যতম। কিন্তু দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের মজুত কম। এরই মধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে অক্সিজেনের দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন তরুণ শুরু করেন বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার কার্যক্রম। মাত্র ৬টি সিলিন্ডার দিয়ে শুরু হওয়া এই মানবিক কার্যক্রমের নাম দেয়া হয়- ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস’। ‘একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা’ স্লোগানে কার্যক্রম শুরু হয় ২৫শে জুন।
বিগত ৬ মাসে তাদের থেকে সেবা নিয়েছেন তিন হাজার ২৪২ জন। শুরুতে শুধু করোনা রোগীর জন্য সেবা চালু থাকলেও বর্তমানে যেকোনো রোগী চিকিৎসকের পরামর্শপত্র দেখিয়ে এই সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। এই মানবিক কার্যক্রমে সাদ’-এর সঙ্গী ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ। সেবা দিতে গিয়ে নিজেরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃদ্ধ বাবা-মাসহ সাদ’-এর পরিবারের সবাই হয়েছিলেন করোনা আক্রান্ত। কিন্তু থেমে থাকেননি তারা। মানবিক কার্যক্রমে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন এখনো পর্যন্ত। উদ্যোক্তারা জানান, ২৫শে জুন রাজধানীতে শুরু হয় এই সেবা। এরপর ২৫ ও ২৯শে জুলাই আরো দু’টি বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে কার্যক্রম শুরু করে তারা। ৬ই আগস্ট শুরু হয় কুরিয়ারের মাধ্যমে সারা দেশে আক্রান্ত রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ কার্যক্রম। ৩রা আগস্ট ফেনী জেলার মাধ্যমে শুরু হয় জেলাভিত্তিক কার্যক্রম। এরপর ৮ই নভেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলায় ও ২৬শে নভেম্বর শুরু হয় বগুড়া জেলায় অক্সিজেন সেবা পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম। বর্তমানে কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ এবং খুলনায় কার্যক্রম চালু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উদ্যোক্তারা জানান, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই মানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন। তারা ৭৬টি সিলিন্ডারের মাধ্যমে দিন- রাত ২৪ ঘণ্টা এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, সরকার লকডাউন শিথিল করে দিলে আমরা তখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ক্রাইসিস বা মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন কী হতে পারে সেটিকে প্রাধান্য দিয়ে অক্সিজেন সেবা নিয়ে ২৫শে জুন কাজ শুরু করি। শুরুতে স্বেচ্ছাসেবক পেতে কষ্ট হলেও বর্তমানে সারা দেশে আমাদের প্রায় ১২০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। এদিকে সেবা গ্রহীতারাও খুশি ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস’-এর সেবা নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক আক্তারুজ্জামান সিনবাদ বলেন, নভেম্বরে আমার চিকিৎসক ভায়রা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এ সময় তিনি বাসায় আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। একদিন রাতে হঠাৎ তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হওয়ায় তাৎক্ষণিক অক্সিজেন সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমরা কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে পারিনি। এক পর্যায়ে রাত দেড়টার দিকে জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিসের সাদ’কে ফোন দিই। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন তাদের কাছে রিফিল করা কোনো সিলিন্ডার ছিল না। কিন্তু তারা আমাকে হতাশ হতে দেয়নি। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিরপুরে গিয়ে সিলিন্ডার রিফিল করে রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমার ভায়রার ইস্টার্ন মল্লিকার বাসায় পৌঁছে দেয়। তিনি বলেন, পরের দিন ভায়রার ভাইয়েরও (করোনা রোগী) অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন পড়ে। সেদিনও তারা আরেকটি সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়। এই শিক্ষক বলেন, এই দুর্যোগে আমরা অনেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে রাখি। কিন্তু তারা যে কাজটি করছে সেটি অনেক বড়। মানবসেবায় তাদের এগিয়ে আসা নিঃসন্দেহে ভালো লাগার। তারা অনেক রোগীর কষ্ট কমিয়ে দেয়ার মাধ্যম হয়েছে। আমি চাই এমনভাবে সকলের নিজ নিজ জায়গা থেকে ভালো কাজে এগিয়ে আসুক। ফেনী সরকারি কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শরীফুল আলমও জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিস থেকে সেবা নিয়েছেন। শরীফুল বলেন, আমার মায়ের কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয় প্রতি সপ্তাহে। তাই তার অক্সিজেন সাপোর্ট লাগে। যেটি ব্যয়বহুলও বটে। আমি জয় বাংলা অক্সিজেন সার্ভিসের বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার কথা জানতে পেরে তাদের ফোন দিই। এরপর তারা অক্সিজেন দিয়ে যায়। আমার মায়ের জন্য এখন আমি নিয়মিত তাদের বিনামূল্যের এই সেবা গ্রহণ করছি। শরীফুলও বলেন, এটা অনেক মহৎ কাজ। যেটি তার ভালো লেগেছে। গত ৩রা নভেম্বর রাত পৌনে ৪টার দিকে আবিদ হাসান অমি নামে এক সেবা গ্রহীতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিগত ২ মাস ধরে আমার আম্মা ফুসফুসে রোগাক্রান্ত  হয়ে ভুগছেন। হঠাৎ আজ রাত ২টায় আম্মার অক্সিজেন লেভেল ৬৭-এ চলে আসে। এমন অবস্থায় কোথাও অক্সিজেন সিলিন্ডার পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই আমার পাশে এসে দাঁড়ায় সাদ বিন কাদের চৌধুরী। তিনি বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সাহায্য করেছেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি সিলিন্ডার পেয়ে যাই আমার আম্মার জন্য। আমি এই ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুক।’ সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছে। আমরা প্রতি মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর্থিক বিবরণীর সম্পূর্ণ হিসাব দিয়ে থাকি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা সাদ আরো বলেন, আমাদের জন্য কাজটি সহজ ছিল না। আমরা যখন শুরু করি তখনকার পরিস্থিতি বর্তমানের মতো ছিল না। মানুষের মাঝে বিরাজ করছিল করোনার মারাত্মক ভীতি। কোনো বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গেলে আশেপাশের মানুষের হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। এমনও হয়েছে অক্সিজেন নিয়ে গেলে ছেলে সামনে আসেনি। তার বাবাকে আমরাই অক্সিজেন সেট করে দিয়ে এসেছি। তিনি বলেন- বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর ছাড়াও তিনটি জেলায় আমাদের কার্যক্রম চালু রয়েছে। আরো তিনটি জেলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়াও ঢাকা থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে সারা দেশে এই সেবা আমরা চলমান রেখেছি। স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিকতায় এই কাজটি পরিচালনায় অনেক সহজ হয়েছে। জীবন এবং পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে তারা এই মানবিক কাজে আমাদের সঙ্গী হয়েছেন। তিনি বলেন, আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবারের দোয়া ও ভালোবাসা আমাদের কাজ করতে অনুপ্রাণিত করছে। আসলে মানুষের জন্য কাজ করার সময় ও সুযোগ সবসময় আসে না। যতদিন এই পরিস্থিতি চলবে ততদিন আমরা এই কার্যক্রম চলমান রাখবো।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর