× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ডিবি’র দাবি সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য / পরিবার বলছে নিরীহ হকার

প্রথম পাতা

মোহাম্মদ ওমর ফারুক
২২ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার

পল্টনের ফুটপাথে পুরনো বই, ম্যাগাজিন বিক্রি করেন দেলোয়ার হোসেন। প্রতিদিন হাজার টাকা বিক্রি করলে লাভ হয় দুই, তিনশ’ টাকা। এই নিয়েই তার সংসার। পরিবারে স্ত্রী, দুই সন্তান আর অসুস্থ মা। ঘরে রয়েছে দুই মাসের নবজাতক। পুরো পরিবারটি তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাড়িতে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে থাকেন তারা। গত ১৩ই জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যায় দেলোয়ার হোসেনকে পল্টন থেকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম।
এরপর এক সপ্তাহ ধরে তিনি কারাগারে। ফলে পরিবারটিতে নেমে এসেছে অন্ধকার। মামলা চালানোর মতোও অর্থ নেই তাদের। সবার দশ-বিশ টাকার সহযোগিতায় চলছে তাদের সংসার।

পুলিশ দাবি করছে, সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতেন দেলোয়ার। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান গ্রুপ, সেভেন স্টার গ্রুপ, ফাইভ স্টার গ্রুপ নামে লোকজনদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছিল এ চক্রটি। আর এই চক্রের সঙ্গে দেলোয়ার নিজে জড়িত। তাদের টার্গেট নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর ও বরিশালের লোকজন। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। সর্বশেষ চাঁদাবাজির শিকার এক ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গত বৃহস্পতিবারে সংবাদ সম্মেলন করে ডিএমপি’র গণমাধ্যম শাখার ডিসি ওয়ালিদ হোসেন জানিয়েছেন, এ চক্রে ৮/১০ জন সদস্য রয়েছে। তারা তিন ধাপে চাঁদাবাজি করছিল। প্রথম ধাপে চক্রটি নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন জায়গা  থেকে  টেলিফোন ডায়েরি  সংগ্রহ করে।  সেই ডায়েরি থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করে। আরেকটি গ্রুপ নম্বরগুলোতে ফোন করে ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিকাশ ও নগদ নম্বরে টাকা পাঠাতে বলে। তৃতীয় ধাপে চক্রটি টাকা সংগ্রহ করে।  

এই মামলার বাদী মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, আমি কাউকে নাম উল্লেখ করে মামলা করিনি। তিনটি নম্বর থেকে আমার কাছে প্রায় চাঁদা দাবি করতো সেগুলো দিয়ে মামলা করেছি। দেলোয়ার কে- তাকে তো আমি চিনি না।

কিন্তু এতো সব ঘটনা ঘটে গেলেও কি কারণে হকার দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এই বিষয়ে তেমন একটা জানেন না পল্টনের পুরাতন বই ব্যবসায়ীরা ও তার পরিবার। দেলোয়ারের স্ত্রী আসমা আক্তার বলেন, কেন কি কারণে আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আমি কিছুই জানি না। আমার একটি সন্তান হয়েছে দুই মাস হয়েছে। আজকে এক সপ্তাহ ধরে আমার স্বামী নেই। আমরা ঠিকমতো খেতে পারছি না। পল্টনে কয়েকজন চাঁদা তুলে আমাদের হাজার দেড়েক টাকা দিয়ে গেছে। এটা দিয়ে চলছে। আমার শাশুড়ি অসুস্থ, সপ্তাহে এক হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এখন কি করবো কোনোভাবেই মাথায় আসছে না। আমাদের কাছে একটাকাও নেই। কীভাবে ছাড়িয়ে আনবো স্বামীকে।

এদিকে পল্টনে সরজমিন গিয়ে খোঁখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এখানে ব্যবসা করছেন দেলোয়ার। দেশবিরোধী বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাকে কেউ কখনো দেখেননি। নিরীহ মানুষ হিসেবেই তাকে চিনেন সবাই। পুরানা পল্টনের ব্যবসায়ী মো. হানিফ। দুই যুগ ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, এখানে আমরা পুরান বইয়ের ব্যবসা করি। পুরান বই নানান ভাবে আসতে পারে এখানে। ফেরিওয়ালা বেঁচতে পারে, পাবলিক এসে বেঁচতে পারে। শুনেছি দেলোয়ার একটি ডাইরেক্টরি বিক্রি করছেন। এটা কোনো না কোনো চক্রের হাতে পড়েছে। চক্রটা এটা নিয়ে নেগেটিভ কাজে লাগেয়িছে। সেই সুবাদে তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমরা এতদিন ধরে দেখে আসছি, সে এই চক্রের সঙ্গে থাকতে পারে না। পুলিশ তাকে সন্দেহ করে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তার তো দোষ নেই। সরজমিন গিয়ে তার দোকানটি দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন, পুরাতন দু’টি বইয়ের স্তূপ রয়েছে সেখানে। এখন পাশের একজন দোকাদার, নিজের ব্যবসার পাশাপাশি দেলোয়ারের দোকানটিও দেখছেন।

পল্টনের আরেক ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম। ১৬ বছর ধরে পুরাতন বই বিক্রি করেন এখানে। তিনি বলেন , এখানে দেলোয়ার খুবই সাধারণ মানুষ। দীর্ঘনি ধরে ব্যবসা করে। তাকে আমরা কোনোদিনই দেখিনি খারাপ কাজের সঙ্গে। কাস্টমারের কাছে আমরা পুরান বই বা ডিরেক্টরী বিক্রি করি। এটার মধ্যে কি আছে না আছে সেটা তো আমরা জানি না। আমরা মূর্খ মানুষ। আমার যেসব পুরনো বই আসে সেগুলো  এনে বিক্রি করি।

কথা হয় দেলোয়ারের গ্রামের বাসিন্দা মো. তাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। খুবই নিরীহ মানুষ। তাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। খুবই ভালো মানুষ। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। তার পরিবার চলে তার আয়ের টাকা দিয়ে। পরিবারটি খুব গরিব। তার স্ত্রী আমাদের কাছে কান্নাকাটি করে । তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় পরিবারটি কোনোরকমে চলছে। গ্রামের মানুষ তাকে সাহায্য- সহযোগিতা করছে। গ্রামের মানুষ ক’দিন সাহায্য-সহযোগিতা করবে?

 তথ্য বলছে, করোনার আগে দেলোয়ার হোসেন নিমতলীর একটি  মেসে থাকতেন।  করোনা আসার পর তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর তিনি  মেসটি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। পরে সবকিছু খুলে দেয়ার পর বাসা থেকেই নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন তিনি। গত দুই মাস আগে দ্বিতীয় সন্তানের বাবা হন  দেলোয়ার। তার আয়ের উপর নির্ভর পুরো পরিবার।

বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল হাশেম কবির বলেন, তার পরিবারের খুবই খারাপ অবস্থা। হকারদের কাছ থেকে দশ বিশ টাকা করে তুলে আমরা দেলোয়ারের বাড়িতে দুই আড়াই হাজার টাকা পাঠিয়েছি। তার রুটি-রুজি বন্ধ। কিছুদিন আগে তার একটা বাচ্চাও হয়েছে। তার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা বলছি, যদি টাকা লাগে আমরা চাঁদা তুলে আইনজীবীকে দেবো। এর মধ্যে আমরা হকার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ডিবি অফিসে গিয়েছিলাম। ওখানে আমাদেরকে ঢুকতে দেয়া হয়নি।  কিন্তু ডিবি বলছে বিষয়টি তদন্ত করে আমাদেরকে জানাবে। এর মধ্যেই তাকে কোর্টে চালান করে দিয়েছে।
কী কারণে পুলিশ তাকে ধরেছে জানতে চাইলে হকার্স ইউনিয়নের  এই নেতা বলেন, পুলিশ এসে কিছু বলেনি, তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল  ক্রাইম টিমের এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, দেলোয়ার হোসেন ওই চক্রের সহযোগী। আমরা মূল আসামিদের ধরার বিষয়ে জানতে পারি বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সমিতির ডিরেক্টরি  দেলোয়ার সাপ্লাই দিতো। তার কাছ থেকেও তারা এসব ডিরেক্টরি নিতো। তবে তার প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাইনি।

এদিকে বুধবার দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়ন ও যুব ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।

দেলোয়ারের আইনজীবী সালাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, দেলোয়ার একজন নিরীহ মানুষ। তাকে শুধু শুধু পুলিশ হয়রানি করছে। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ দেয়নি। তারা বলছে, এই গ্রুপের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা আছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর