প্রথমত, দেশের ভেতর থেকে অনেক চাপ থাকা স্বত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী তথা বাংলাদেশ সরকার টিকাটিকে সবার জন্য এখনো বিনামূল্যে রেখেছেন। এটাকে প্রাথমিক সাফল্য বলা যায়। নয়তো ইতিমধ্যে শাহেদ-সাবরিনার মতো অনেক প্রতারকের দেখা মিলতো।
দ্বিতীয়ত, অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের কারণে মানুষ ঘরে বসেই কম্পিউটার বা সেলফোনের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করে টিকা গ্রহণের তারিখটিও সহজে জেনে যাচ্ছেন।
তৃতীয়ত, যে কোন ভাবেই হোক বাংলাদেশ খুব দ্রুত দেশে টিকা নিয়ে আসতে পেরেছে এবং বলা চলে সম অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে।
চতুর্থত, খুব অল্প সময়ে সরকার উপজেলা পর্যায়ে টিকাদানে প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছে এবং টিকা সেখানে পৌঁছেও দিতে পেরেছে।
সাফল্যের পরই জানতে চাওয়া হয় সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতার খবর। এক্ষেত্রে ড. জিয়া কিছু পরিসংখ্যান সহ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেনঃ
শুরুতে ৫৫ বছর নির্ধারণ করলেও কিছুদিন পরই সরকার জানালো যে, যাদের বয়স অন্তত ৪০ বছর হয়েছে তারাও টিকার নিবন্ধন করতে পারবেন। এতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম ধাপে টিকা গ্রহণে অগ্রাধিকার প্রাপ্তদের বয়সের ক্ষেত্রে মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটেছে। এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতেও ৫০ বছরের বেশি বয়স্কদের - বিশেষত যাদের আগে থেকেই কোনও না কোনও অসুস্থতা রয়েছে, টিকা দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারের টিকাদান পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যার অর্থ এ বছর শেষ হবার আগেই ১৪ কোটি মানুষকে সরকার টিকা দিতে চায়। জানুয়ারির শেষদিকে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লক্ষ লোককে টিকা দেয়া গেছে। অর্থাৎ দিনে প্রায় এক লক্ষ মানুষ টিকা নিয়েছে। এই মাত্রায় সপ্তাহে ৭ দিন করে টিকা দেয়া হলেও সরকারি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে।
তাছাড়া, টিকা দেয়া হয় একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য। এক্ষেত্রে নিয়ম হলো, প্রথম যাকে টিকা দেয়া হবে তার উপর টিকার প্রভাব থাকতে থাকতেই দেশের সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দিতে হবে। কারণ টিকার প্রভাব শেষ হয়ে গেলে সেই ব্যক্তি দ্বারা অন্যরা (টিকা না দেয়া) আক্রান্ত হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে টিকা দেয়ার সুফল পাওয়া যাবে না।
এগুলো বাদ দিলেও আরো সমস্যা আছে। এ পর্যন্ত টিকা দেয়া ৩৫ লক্ষের মধ্যে নারী মাত্র ১১ লক্ষ। তাছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে টিকা দেয়ার প্রবণতা নেই বললেই চলে। তারা মনে করে, করোনা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আবার উক্ত ৩৫ লক্ষের একটা বড় অংশই ঢাকাসহ কয়েকটি বড় বড় শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত শ্রেণীর।
এসব কিছু সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে, সাফল্যের কথা বলা হচ্ছে তা নিয়ে ভাববার কতোটা অবকাশ রয়েছে। এক বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে যদি পাঁচ বছর লেগে যায় তাহলে এই সাফল্য কতটুকু ধরে রাখা যাবে সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।
ড. জিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়, এসব সমস্যা সমাধানে কিংবা সংকট থেকে উত্তরণে তার পরামর্শ। উত্তরে তিনি বলেনঃ
আমার নিজের ব্যক্তিগত কিছু পরামর্শ রয়েছে। এছাড়া আমি উপজেলা পর্যায়ে অনেকের সাথে কথা বলেছি। তাদেরও কিছু পরামর্শ রয়েছে।
প্রথমত, কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ৩২.৫ শতাংশ মানুষ টিকা দিতেই চান না। বাকি যারা টিকা দিতে আগ্রহী তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশের উপরে টিকা দেবেন কি দেবেন না এ নিয়ে দ্বিধান্বিত। যেখানে ভারতে মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ টিকা দিতে চান না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পিছিয়ে আছে। তাই টিকা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
উপজেলা পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচীতে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ খুব কম। সেখানে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের অনেকেও টিকা দিতে চাচ্ছেন না। টিকা গ্রহণে এই যে একটা বিরূপ মনোভাব, তা থেকে সরে আসতে না পারলে; দল-মত নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে সরকার যদি দেশব্যাপী প্রচারণা চালিয়ে এর পক্ষে জনমত তৈরী করতে না পারে তাহলে সরকারি লক্ষ্যমাত্রায় টিকাদান কর্মসূচি সফল করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি ভালো। কিন্তু বয়স্ক, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগী অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর টিকা নিশ্চিত করতে এ পদ্ধতির উপর নির্ভর করা যাবে না। উপজেলা পর্যায়ে যেসব কমিটি করা হয়েছে সেখানে ডাটাবেইজ করে এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে টিকার আওতায় আনতে হবে। যারা বয়স্ক, চলাচলে অক্ষম তাদের যাতায়াত ভাতা প্রদান করতে হবে। তাদের দ্বিতীয় ডোজের কথাও ভালোভাবে মনে করিয়ে দিতে হবে। তা না হলে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না এবং টিকার যে মূল উদ্দেশ্য হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সেটাও সম্ভবপর হবে না।