সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অধিক বিস্তৃত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভারতীয় কূটনীতি চলছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোতে বাংলাদেশের সাড়া দেয়ায় সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কে যে টানাপড়েন চলছিল তা সহজ হয়ে গেছে। উপরন্তু, আমদানি বাণিজ্য/যৌথ উদ্যোগে বাণিজ্যে ভারতের ওপর বাংলাদেশ আগে যতটা নির্ভর করতো, তা দ্রুত কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এটা এমন একটা বৈশিষ্ট্য, যার জন্য আওয়ামী লীগ অবিচ্ছিন্নভাবে সমালোচিত হতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো একটি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। আগের মতো উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া দেয়ার চেয়ে বড় অর্থনৈতিক/রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অধিক গঠনমুলক পরিবেশ আছে।
এমন প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলার আগে, এটা বলে নেয়া দরকার যে, দিল্লি বা ঢাকার মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি বিবৃতি, বাংলাদেশি পত্রিকাগুলোর সম্পাদকীয়, সম্পাদকের কাছে চিঠি কলাম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে টুইটই হলো দেশটির বেশির ভাগ ইস্যুতে প্রকৃত ভাবধারা ও ধারণার ইঙ্গিতবাহক। সাম্প্রতিক বাংলাদেশি মিডিয়ার বিশ্লেষণ/মন্তব্য এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিভিন্ন প্যানেলের আলোচনার দিকে নিয়মিত দৃষ্টি রাখলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, আগের চেয়ে ভারতের পূর্ব দিকে তার নিকটতম প্রতিবেশি আঞ্চলিক ইস্যুতে অধিক পরিমাণে আত্মনির্ভরতার দিকে ঘুরে গিয়েছে।
ভারতের জন্য সরাসরি তাৎপর্যপূর্ণ এই বিষয়টি। পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে ভারতকে কৃতীত্ব দিতে হয়। কিন্তু উপযুক্ত নীতিমালায় সাড়া দেয়ার মতো কাছাকাছি অবস্থানে নেই তারা।
কিভাবে ভারতের সুপরিচিত নেতাদের ক্ষতি করার ইচ্ছা না থাকলেও তাদের ক্ষতিকর মন্তব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রকাশ পায় তা বাংলাদেশের মিডিয়ার দিকে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। নেতাদের এমন বক্তব্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কখনো তা আক্রমণাত্মক হয়। সব মিলিয়ে বিষয়টি স্পর্শকাতর।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হতে পারে আসামে সন্দেহজনক কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কঠোরভাবে ‘ঘুণপোকা’ বা উইপোকা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মনে হয় বাড়িয়ে বলা হবে না যে, শুধু দুর্ভাগ্যজনক এই একটি শব্দের ব্যবহার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় ক্ষতি করেছে। তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে ভারতের গড়িমসি নিয়ে যতটা না, তার চেয়ে এই শব্দের কারণে বাংলাদেশিদের ক্ষুব্ধ করেছে বেশি।
দুঃখজনক হলো, এটাকে শুধু একটি ক্ষতিকর মন্তব্য বলে ডিসমিস করে দেয়া যায় না। পক্ষান্তরে ২০১৯ সালে আসামে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় এটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে থাকতে পারে। সর্বোপরি, নির্বাচনপূর্ববর্তী বাকবিত-াকে আক্ষরিক অর্থে নেয়া উচিত নয়। কিন্তু ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তারা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। কিন্তু তাতে স্থানীয় পর্যায়ে ভারতে কথা বলা বন্ধ হয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশিদের সুনাম ফেরাতে চেষ্টা করেছে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামিপন্থি শক্তিগুলো এক সময় ভারত বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে।
সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আসামের নির্বাচন ও সংশ্লিষ্ট বিষয় ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সর্বোচ্চ পর্যায়ে- হতে পারে সেটা দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা, ভারত বার বার ঢাকাকে আশ্বস্ত করেছে যে, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) অথবা নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) আধুনিকায়ন করার ফলে বাংলাদেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি হবে না।
নিকট পূর্বে অবস্থিত প্রতিবেশীদের বোঝাতে ভারতীয় নেতারা বিব্রতকর মন্তব্য করতে গিয়ে মর্মপীড়ায় ভোগেন না। ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মধ্যে যে বড়ভাইসুলভ নীতি অচেতনভাবে গৃহীত হয়েছে সেটাই সমস্যা সৃষ্টি করছে। সেটা সামান্য হলেও।
তাৎক্ষণিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট টিমকে ভারতীয় ক্রিকেটের ভাষ্যকাররা বার বার অবমাননা করার কারণে বেশির ভাগ বাংলাদেশি ক্ষুব্ধ। শক্তিশালী ভারতীয় টিমের কাছে বাংলাদেশ জেতার চেয়ে হেরেছে বেশিবার। প্রকৃতপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে অনেক পরে। আগের চেয়ে তারা ভাল ফাইট দিচ্ছে। অনেক প্রতিযোগিতার ফল খুব কাছাকাছি নিয়ে আসে তারা। কিন্তু তাদেরকে যথেষ্ট স্বীকৃতি দেয়া হয় না। আরো খারাপ বিষয় হলো, খুব কম সময়ে এমনকি জুনিয়র লেভেলে বাংলাদেশ যখন ক্রিকেটে জয় পায় তখন ভারতের বেশির ভাগ ভাষ্যকার উষ্মার সঙ্গে দেখেন তা।
ঢাকার একটি মিডিয়ায় একবার একজন প্রতিনিধি লিখেছিলেন, ভারতীয় একজন নারী ভাষ্যকার এমনভাবে কথা বলেছেন, তাতে মনে হয় যে, ক্ষুদ্র বাংলাদেশের কাছে ভারত হেরে যাওয়া ভারতের জন্য অপমানের। পৃথিবীতে কেন এটা ঘটবে? প্রতিটি খেলায় হার-জিত আছে। অনেক দিন পরে যখন বাংলাদেশ একবার বিজয় পায় তখন কেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ে?
করোনা ভাইরাস মহামারীকালে মাথাপিছু জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ভারতকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ উপরে উঠে যাচ্ছে এমন রিপোর্টে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে দেখা গেছে জঞ্জাল জাতীয় ভাবধারা। বাংলাদেশিদের প্রশংসা করা হয়নি এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। উপরন্তু আইএমএফ এবং অন্য সূত্রগুলো বলেছে, ২০২৪ অথবা ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এই ধারা অব্যাহত রাখবে।
একজন নাগরিক মন্তব্য করেছেন যে, আবারও দেখা গেল ভারতে তারা যেভাবে কথা বলেন- হোক সেটা বিশ্লেষণ বা নেতা, তা দেখে মনে হয় দুনিয়াতে ভারতের সুযোগ ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশের পিছনে পড়ে যাচ্ছে। এই নাগরিকের মন্তব্যকে সমর্থন করেন অনেকে। তিনি আরো বলেন, আমরা ১৬ কোটির মানুষের দেশ অনেক খাতে যে অগ্রগতি করেছি ভারতের তা প্রশংসা করা উচিত। গত দুই দশকে আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা আর বাড়াতে চাই না। অনেক বড়, শক্তিশালী ভারতে নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান, শিশু স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে আছি। সম্ভবত এর কারণ, আমরা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করিনি, বেশির ভাগ ভারতীয় এই সত্যটি সম্পর্কে হয়তো ওয়াকিবহাল নন। আমরা সব সময় স্বীকার করি, ভারত অনেক বড়। তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না। এটাই জনগণের প্রতিক্রিয়া।
এই কলামে এর আগেই বলা হয়েছে, আজকের বাংলাদেশ উচ্চাভিলাষী একটি পরিকল্পনার দিকে যাচ্ছে । তারা ওয়াগন, সিগন্যাল সরঞ্জাম, লোকোমোটিভ বা উচ্চ প্রযুক্তির যোগাযোগ, নজরদারি সামগ্রি কিনতে বেছে নেবে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীনকে। কিন্তু আগের মতো সব সময় এক্ষেত্রে তারা ভারতমুখী হবে না।
ঢাকাভিত্তিক কর্মকর্তারা ঢাকাকে দেয়া রেলওয়ে ইঞ্জিন এবং ভারতে তৈরি যাত্রীবাহী বাস দেয়াকে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে দেখছেন। কিন্তু একটি নীরব সমালোচনা আছে। তা হলো, বলা হচ্ছে, এর মধ্যে বেশ কিছু যানবাহন স্পষ্টত আগে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশকে যেগুলো দেয়া হয়েছে তা একেবারে নতুন নয়। এসব কথা স্থানীয় প্রেসেও এসেছে। শেষ কথা হলো শুভেচ্ছার এই সম্পর্ককে আরো যতেœর সঙ্গে লালন করা উচিত ভারতের। বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা বাদ দিয়ে এটা করা উচিত। আত্মতুষ্টির কোনো স্থান নেই।
তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে একটি সমাধানের জন্য বহু বছর অপেক্ষার পর ঢাকা চূড়ান্তভাবে চীনের কাছ থেকে বড় প্রযুক্তি/আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করেছে প্রস্তাবিত ৩০ কোটি ডলারের সমন্বিত প্যাকেজের অধীনে। এর ফলে শীতের সময় চার মাসে খরা মৌসুমে পানির সঙ্কট সমাধান হয়ে যাবে। ওদিকে করোনা মহামারির সময় ঢাকা বলেনি যে তারা ভারতে তৈরি কোনো টিকা নিতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ইঙ্গিত দিয়েছে যে, তারা চীন, রাশিয়া, বৃটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের টিকার বিষয়ে পর্যালোচনা করছে।
বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা পয়েন্ট আউট করেন যে, ভারতের কাছে পরিষ্কার করতে হবে যে, তিস্তা বা অন্য যেকোনো বিষয়ই হোক তার সমাধানের জন্য ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে অফুরন্ত সময় অপেক্ষা করবে না ঢাকা। এতে দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্পর্কিত। প্রয়োজনে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তারা চীনের সহযোগিতা নেবে। একইভাবে তারা কখনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে, ভারতের সব অফারই তারা বিনাশর্তে গ্রহণ করবে- হোক সেটা করোনার টিকা বা রেলওয়ের যন্ত্রপাতি। তারা সেটাই কিনবে, যেটা তাদের জন্য বেশি উপযুক্ত হয়।
ঢাকা চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কেনার বা রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দুটি বিষয় মিস করা হয়েছে এটা স্পষ্ট। ঢাকার পর্যবেক্ষকদের এই সত্য নিয়ে উদ্বেলিত হওয়া উচিত নয় যে, লাদাখে চীনের বিরুদ্ধে ভারতের যখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তখন ভারতের প্রতি কোনো সমর্থন প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ এবং দীর্ঘদিন গ্যাপ থাকার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে ঢাকা। এ বিষয়গুলোকে অবশ্যই নোট রাখতে হবে দিল্লিকে।