ধর্মে অবিশ্বাসী কিছু মানুষ আছেন, যাদের ধারণা- ধর্ম পালন করলেই বিজ্ঞানের সূত্র মানা যায় না। আসলে যতক্ষণ কোনো সূত্র সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার না করে, ততক্ষণ ধর্মের সাথে তার সংঘাত নেই। আবার যারা ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজেন, তাদেরকেও হতাশ হতে হয়। অতি-প্রকৃতিতে বিশ্বাস না থাকলে ধার্মিক হওয়া যায় না। সেইসাথে ধর্ম নৈতিকতা-আশ্রয়ী। ত্যাগের মহিমা, অন্যের আমানত সংরক্ষণ, নারী-পুরুষের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক বর্জন- এমনি হাজার আদেশ এবং নিষেধ রয়েছে ধর্মে। ধর্ম পালন করে ধার্মিক হওয়া যায়, যাতে হৃদয়বৃত্তিক শান্তি লাভ হয়। কিন্তু ধর্মশাস্ত্র অধ্যায়ন করে জীববিজ্ঞানী বা পদার্থবিজ্ঞানী হওয়া যায় না।
ধর্মকে যারা বিজ্ঞানের মুখোমুখি দাঁড় করায়, তারা কৌশলে নাস্তিকতার দিকে মানুষকে নিতে চায় ।
সোনার আংটি বেঁকে গেলে স্বর্ণকারের কাছে যাই। দা-বঁটি বানাতে কামারের কাছে যাই। তেমনি জীববিজ্ঞানী আর পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে যাই জীবজগৎ আর বস্তুজগৎ সম্পর্কে জানতে। ঠিক একইভাবে যারা কোরআন-হাদিসে বিশেষজ্ঞ তাদের কাছে যাই আত্মিক উন্নয়নের জন্য কোথায় কি অনুশাসন আছে, তা জানতে। এসব জানার মধ্যে কোনো লজ্জাও নেই, বাহবাও নেই। নিজের জীবনের প্রয়োজনে যেতে হবে। তবে বুঝে যেতে হবে- কে জ্ঞান দিতে পারবে, আর কে পারবে না। বর্তমান সীমাহীন নৈতিকতা-স্খলনের যুগে পরকালে শাস্তির ভয়, সেইসাথে ভালো কাজ করলে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি- এসব না থাকলে মানুষ খারাপ কাজ করতে ভয় পেত না, আর দান-সাদকা ও মহৎ কাজে এগিয়ে আসতো কম। উন্নত সমাজে হয়তো ধর্মীয় বিশ্বাস-বিহীন নৈতিকতা সমাজের ক্ষতি করা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে, কিন্তু পশ্চাতপদ সমাজের মানুষ যারা, তাদের বেশিরভাগ ধর্মীয় অনুশাসন থেকে উদ্বুদ্ধ হন।
পৃথিবীতে এখন ধর্ম যারা মানেন, তাদের মধ্যে ইসলাম-অনুসারীরা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন বেশি। পাশ্চাত্যের মানুষ ধর্মকে একটা পরিচিতি হিসেবে নিয়ে বিয়ে, মৃত্যু, নামকরণ, শাসকদের অভিষেক- এমন বড় বড় ঘটনায় চার্চে যায় বা ধর্মের দ্বারস্থ হয়। বাদবাকি কাজে তারা খুব-একটা ধর্মের দ্বারস্থ হয় না। সেজন্য ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের যে বিদ্বেষ ধর্মের বিরুদ্ধে, তার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে ইসলাম। ওরা অনেকসময় অন্য ধর্মের গুণ গায়, কিন্তু ইসলামকে খারাপ বলে, যদিও সব ধর্মের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। এভাবে কেউ কেউ বলেন ইহুদি-খ্রিষ্টানেরা সব আবিষ্কার করে ফেলছে, মুসলমান পারছে না, ওরা শুধু ধর্ম নিয়ে বসে আছে!
কিন্তু বুঝতে হবে, আবিষ্কারের সাথে কিংবা শিক্ষার সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। আবিষ্কারের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ আর উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। এই যে তুরস্ক থেকে জার্মানীতে অভিবাসী হয়ে যাওয়া পিতামাতার সন্তান উগুর শাহিন এবং ওজলেম ট্যুরেসি জুটি জার্মানীর বায়োএনটেক কোম্পানীর পক্ষে কোভিডের ফাইজার-বায়োএনটেক টিকা আবিষ্কার করলেন, তারা মুসলামান হয়েও তো আবিষ্কার করতে পারলেন, কোনো বাধা তো আসে নি! জার্মানিতে বসবাস করে তারা গবেষণার পরিবেশ পেয়েছেন, তাই পেরেছেন। এই পরিবেশের অভাব মুসলিম দেশগুলিতে প্রকট ।
পরিবেশের অভাব থাকার একটা ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, যা আমরা সকলেই জানি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হওয়ার পর অটোম্যান সাম্রাজ্যকে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে বিজয়ী নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুসলমানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। তার আগে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের বেশি শিকার হয় এশিয়া, আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলি। পরাধীন রেখে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয় এমনভাবে যে, আর যাতে তারা সোজা না হতে পারে। তারপর বিশ্ব-অর্থনীতির চাবিকাঠি, আন্তর্জাতিক সংস্থার মুরব্বিয়ানা, ভেটো ক্ষমতা, এসব হাতে পেয়ে এগুলির অসম ব্যবহার করেছে তারা। ফলে তারা যাদের ভালোবাসে না, তাদের অবদমিত করে রেখেছে। তারা সোভিয়েত দমাতে ধর্মের পেছনে দাঁড়িয়ে শাবাশ দিলেও ধর্মীয় উগ্রবাদের দোহাই দিয়ে অন্য দেশের উপর চড়াও হয়েছে। নিজেদের অস্ত্র সীমিত না করে তারা অন্যদের অস্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। এই দ্বৈত নীতির শিকার হয়ে কয়েকটা মুসলিম দেশ একেবারে নির্জীব হয়ে গেছে। তারা পেটের ভাত জোগাতে আর আগ্রাসন ঠেকাতেই হিমশিম খায়, গবেষণা করবে কখন!
কেউ কেউ মুসলমানদের নানা ভাগে বিভক্ত হওয়ার কথা বলেন। বিভক্তি নেই কোথায়? সর্বত্রই বিভক্তি আছে। কিছুদিন আগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে যে বিভক্তি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে, তা শিয়া-সুন্নি-কাদিয়ানী-ওহাবি এসব বিভক্তিকে হার মানিয়ে দিয়েছে। খ্রিষ্ট ধর্মের ইতিহাস যারা পড়েছেন, তারা জানেন ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট, পিউরিটান, বাপ্টিষ্ট, মেথডিস্ট, ইভানজেলিক্যাল, এংলিকান, ইস্টার্ন অর্থডক্স, ইস্টার্ন ক্যাথলিক, এমন কত ভাগে বিভক্ত এই ধর্ম। ইংল্যান্ডে ক্যাথোলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট বিতর্কে ষষ্ঠদশ শতাব্দিতে কত শত জ্ঞানী-গুণী মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সে দেশের মাটি, তা আমরা সকলেই তো জানি। তাই বলে কি জাতিগত অগ্রগতি তাদের কারো থেমে থেকেছে। নিজেদের মধ্যে বিবাদ একসময় না একসময় প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন তৃতীয় একটি পক্ষ এসে একপক্ষকে উস্কানি দেয়, ধর্মীয় বিভাজনকে পুঁজি করে তাদের স্বার্থ হাসিলের পরিকল্পনা করে। শক্তিশালী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর পক্ষে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা খুব সহজ কাজ
( গাজী মিজানুর রহমান, সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট এবং লেখক )