বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর জনসংখ্যা সাত শত আশি কোটি। পৃথিবীর স্থলভাগের আয়তন ১৪ কোটি ৮৯ লাখ ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৫৫ জন মানুষের বাস । উত্তর আমেরিকা মহাদেশে প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ২০ জন। সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে আমরা ১২৬৫ জন বসবাস করি। অতএব, বুঝা যায় যে, বিশ্বে কেউ হাত পা ছড়িয়ে বাস করেন, আর কেউ ঠাসাঠাসি করে রাত-দিন গুজরান করেন। তবু ইচ্ছে হলে কেউ স্বল্পকালের জন্য অন্য একটা দেশে গিয়ে বাস করবে, খেটেখুটে উপার্জন করবে, তা পারবে না। ইউরোপ, আমেরিকা আর ওশেনিয়াতে যারা বেশি জায়গা নিয়ে আছে, তাদের ভয় –আরও মানুষ ওদের দেশে গেলে মাথাপিছু জায়গা কমে যাবে, উঠতে-বসতে-শুতে গতর খেলানো যাবে না। তাই অভিবাসন ঠেকানোর জন্য এসব এলাকার উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে নানারূপ কঠোর আইন রয়েছে ।
কিন্তু এখন সামনের প্যান্ডেমিক-পরবর্তী বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি মোকাবেলা করতে তাদের উচিত হবে অভিবাসনে কঠোরতার পরিবর্তে উদারতার নীতি গ্রহণ করা।
প্রাচীনকালে গ্রীক এবং রোমানদের প্রাধান্যের আমলে ইউরোপিয়ানরা আশেপাশের এশিয়া এবং আফ্রিকার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তারপর কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, ভাস্কো দা গামার আটলান্টিক হয়ে ভারত মহাসাগরের পথ আবিষ্কার এবং উইলেম জ্যান্সজুনের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর থেকে ইউরোপের মানুষদের উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দেশসমূহ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিন আফ্রিকায় বসতি স্থাপন চলতে থাকে। এখন এ সব দেশে সব মিলিয়ে ইউরোপিয়ান জনসমষ্টির সংখ্যা ৫১ কোটি। পক্ষান্তরে ইউরোপের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৪ কোটি ২৯ লক্ষ ৮১ হাজার । প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭২ জন বাস করে। ইউরোপের মানুষ যদি পৃথিবীর নানা জায়গায় না যেতো, তাহলে ইউরোপের ১ কোটি ১ লক্ষ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গায় তাদের কুলাতো না। কিন্তু এখন তারা এটা মনেই রাখে না, আর সাময়িক সময়ের জন্য অন্যদের ঠাঁই দিতেও তারা নারাজ । ইমিগ্রেশনের নতুন নতুন শক্ত আইন করে সম্ভাব্য অভিবাসীদের আটকানোর চেষ্টা চলে অবিরত ।
মাঝে মাঝে কোনো কোনো দেশের অভিবাসন সংক্রান্ত নীতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয় যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় গায়ের রঙ আর ধর্ম একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলে। পচ্ছন্দসই ধর্ম আর গাত্রবর্ণ না হলে অভিবাসন আইনের কড়াকড়ি দ্বিগুণভাবে প্রয়োগ করা হয়। অথচ সেই আগের যুগে, যখন তারা নিজেরা অভিবাসী হতো অন্য দেশে, তখন তাদের নিজেদের এবং ভূমির আদিবাসীদের গায়ের রঙ এবং ধর্মের সাথে কোনো মিল থাকতো না। অভিবাসীরা এই দুই সত্তাকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কালো বা পীত বর্ণের মানুষদেরকে সাদা গাত্রবর্ণ দেখিয়ে বলা হতো -আগন্তুকরা ওদের জন্য আশীর্বাদ। আবার ধর্মের প্রশ্ন উঠলে বলা হতো -অভিবাসীদের ধর্ম উন্নত এবং তারা সভ্যতা দিতে গিয়েছে ওসব দেশে। এভাবেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, ইতালি, জার্মানী –এসব ইউরোপিয়ান দেশ উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দেশসমূহ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকা এবং অন্য দেশসমূহে কলোনী স্থাপন করে। তারা মূল আদিবাসীদের হটিয়ে নিজেদের জন্য অনুকূল শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে এবং স্থায়ী আসন পাকাপোক্ত করে। এতে মূল অধিবাসীরা ক্রমে হারিয়ে যেতে যেতে ক্ষুদ্র নরগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এখন মূল আদিবাসীর সংখ্যা মাট জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ১.৩ ভাগ, অষ্ট্রেলিয়াতে ২.৯ ভাগ, কানাডায় ৫.১ ভাগ, নিউজিল্যান্ডে ৬.৯ ভাগ। আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকোতে তারা যথাক্রমে ২.৪, ৫.৭ এবং ১২ .৮ ভাগ। ব্রাজিলে, ভেনিজুয়েলা এবং কলম্বিয়াতে আদিবাসী টিকে আছে যথাক্রমে মোট জনসংখ্যার শতকরা ০.৬ , ১.২ এবং ৩.৪ ভাগ।
পৃথিবীতে সবাই ভালোবাবে বাঁচতে চায় । একজনের ভালো আবিষ্কার যেমন আরেকজনের কাজে লাগে, তেমনি একজনের বদভ্যাস অন্যের ক্ষতির কারণ হয়। গুটিকয়েক দেশের ডেকে আনা বিশ্বযুদ্ধ যে আভিশাপ বয়ে আনে, তা তো সারা বিশ্বকেই বহন করতে হচ্ছে । অধুনা উন্নত- বিশ্বের অতিরিক্ত এনার্জি ব্যবহারের কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণতা পৃথিবীতে জেঁকে বসেছে। চীনের উহানে উদ্ভূত করোনা সারা বিশ্বে কী তান্ডব ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা তো আমরা এখনো প্রত্যক্ষ করছি। এসব কথা ভেবে উন্নতবিশ্ব এবং ধনী দেশগুলির উচিত হবে কাজকর্ম করে জীবনধারণের লক্ষ্যে সাময়িক অবস্থানের জন্য ভিসা এবং অভিবাসন আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে উদারতার নীতি অবলম্বন করা। পৃথিবীটা সবার জন্যই সুন্দর করার লক্ষ্যে যার কাজ করার ক্ষমতা আছে, অন্যের বোঝা হবে না, তাকে কাজের সন্ধানে সমুদ্র এবং আকাশ পাড়ি দিতে দেয়া উচিত। এটা ভুললে চলবে না যে, উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো কোনো দেশে উন্নতবিশ্বের আরোপিত যুদ্ধের কারণে সেখানকার অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। সেই অস্থিতিশীলতা আবার অন্য দরিদ্র দেশের উপর গিয়ে প্রভাব ফেলছে। এসব জনপদের মানুষকে এখন যদি বলা হয়, তোমরা তোমাদের ঘরে থাকো, তাহলে তা কতটা অমানবিক হয়, তা কেউ বিবেচনা করে দেখেছে না!
অনেক সময় বলা হয়, অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষের কাছ থেকে অন্যদের বিপদের আশঙ্কা আছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল ইউরোপিয়ান জনগোষ্ঠির নিজেদের মধ্যে জাত্যভিমানের প্রতিযোগিতার কারণে। জাত্যভিমানীদের হিংসা এবং সন্দেহ কোনো সমাধানের বীজ আনেনি, বরং তা থেকে জন্ম নিয়েছে আরও সংকট। তাই আজ যারা উগ্র জাত্যভিমানের মন্ত্রে উজ্জীবিত, বিশ্বের অতীত ইতিহাসের দিকে তাদের তাকাতে হবে। সুমারিয়ান, আসিরিয়ান, ব্যবিলনিয়ান, ইজিপসিয়ান, পারসিয়ান, গ্রীক, রোমান, আরব, মোঙ্গল, অটোমান, ইংরেজ সাম্রাজ্য বিশ্ব-মোড়ল হিসেবে চিরস্থায়ী হয় নি। তাদের দোর্দন্ড প্রতাপ একসময় স্তিমিত হয়ে গেছে। ঠিক সেভাবে আজকের যারা বিশ্ব-মোড়ল তাদের প্রতাপের অবসান একদিন হবে, টিকে থাকবে মানবজাতিকে যদি তারা ভালো কিছু দিতে পারে সেটুকু। তাই উন্নত বিশ্বের উচিত হবে মারণাস্ত্র তৈরির খাতে খরচ কমিয়ে কর্মসংস্থান হয়, এমন খাতে তাদের অঢেল সম্পদ বিনিয়োগ করা। যুদ্ধজয় আর মারণাস্ত্রের ক্ষমতা একপ্রকার তাসের ঘর ছাড়া আর কিছুই না।
(গাজী মিজানুর রহমান, সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট এবং লেখক)