× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সত্য শুভ নিরঞ্জন

মত-মতান্তর

ড. শরীফ আস্-সাবের
২৫ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার

‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ কিংবা ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এইসব উপদেশ আজ যেন শুধুই কথার কথা। সত্য কথা আজকাল অনেকেই বলতে চান না। কেউ বুঝে, কেউবা না বুঝে - কেউ স্বেচ্ছায়, কেউবা বাধ্য হয়ে মিথ্যার বেসাতি কিংবা সত্যের অপলাপ করেই যাচ্ছেন অবলীলায়, অহর্নিশ, যত্রতত্র।

মিথ্যা এখন হয়ে উঠেছে ব্যক্তি, গোষ্ঠি কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। নির্বিকার ও নিরবিচ্ছিন্ন  মিথ্যাচারিতার কারণে দেশের বুদ্ধিজীবী, সমাজপতি এবং রাজনীতিবিদদের উপর ক্রমান্বয়ে আস্থা হারাচ্ছেন দেশের জনগণ। যদিও সমাজের সকল স্তরে মিথ্যার প্রকটতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত, দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিথ্যাকে নির্মূল করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে সরকার ও রাজনীতিবিদসহ কোন মহলই তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।

দল মত নির্বিশেষে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ মিথ্যাচারকেই যেন বেছে নিয়েছেন তাঁদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। আমদের তথাকথিত ‘সুশীল’ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বুদ্ধিজীবীদের একটি বিশাল অংশও নিজেদেরকে বেঁধে ফেলেছেন একই গাঁটছড়ায়। ইনারা নির্বিকার মিথ্যা কথা বলেন, মিথ্যার তাঁবেদারি করেন এবং অন্যায় সুযোগের সন্ধানে থাকেন সর্বক্ষণ। সুন্দর পোষাকের খোলসে উচ্চশিক্ষিত এইসব ধোপদুরস্ত বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা নিয়ত ভাওতাবাজীরও আশ্রয় নেন।
তাঁরা নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কালে ভদ্রে সমাজের অসঙ্গতির কথাও বলেন এবং পূঁজি করেন জনগুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় বিষয়গুলোকে। তাঁরা পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন, বিনম্র বদনে সভা সমিতি ও টক শোতে সত্যের আদলে সাবলীল ভাষায় নির্জলা মিথ্যা কথা বলেন, আর সামান্য আর্থিক সুবিধা  কিংবা বিশেষ কোন লাভজনক পদে সাময়িক পদায়নের বিনিময়ে নিজেদের ব্যক্তিসত্বা, সম্মানবোধ ও নৈতিকতাকে বিক্রি করেন নির্দ্বিধায়। এঁরা সস্তা জনপ্রিয়তার লোভ সামলাতে পারেন না এবং এই উদ্দেশ্যে অপসংস্কৃতির চর্চা এবং এর প্রসারেও পিছপা হন না। ইতিহাস বিকৃতি থেকে শুরু করে কোন বিশেষ দল কিংবা দেশী/বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের তল্পিবাহক হতেও ইনাদের কোন আপত্তি নেই!

তবে, এই মিথ্যার বেসাতি এখন শুধুমাত্র রাজনীতি কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিতেই সীমাবদ্ধ নেই - সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে এর বিষাক্ত প্রভাব। রাজনীতিবিদ, সমাজপতি এবং ভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবীদের ছলাকলায় বিভ্রান্ত সাধারন মানুষদের অনেকেই এইসব মিথ্যাবাদী এবং তাঁদের মিথ্যাচারকে বিশ্বাস করেন অন্ধভাবে। তাঁরা ভেবে দেখেন না এবং খতিয়ে দেখতে চান না কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা। দলকানা, মতান্ধ এব বিচার-বুদ্ধিহীন এইসব নপুংসক ঘরানার মানুষ নিজের অজ্ঞাতসারেই মিথ্যাকে শক্তি এবং সমর্থন জুগিয়ে যান নিঃসংকোচে।

অপরদিকে, যারা সব কিছু জেনেশুনে মিথ্যার গুণগান গাইছেন এবং এর মাধ্যমে নানা সুবিধা আদায় করছেন, তাদের কথা তো আলাদা। এদের কেউ কেউ সন্ত্রাসী, কেউ অর্থলিপ্সু অসাধু ব্যাবসায়ী কিংবা দুর্নীতিপরায়ন আমলা । কেউ নিজেদের দুষ্কর্ম ধামাচাপা দিতে আপন স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়েছেন চিরতরে, কেউ  আবার নিছক একটি ঠিকাদারি কিংবা চাকুরির প্রত্যাশায় মিথ্যার জয়গান গাইছেন গলা ছেড়ে।

মিথ্যা এখন তার ডালপালা মেলেছে সর্বত্র। চারিদিকে তাই এখন মিথ্যার জয়জয়কার। অনেকেই মনে করেন, মিথ্যা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে যথেষ্ট পরিমাণে ধিকৃত না হওয়ায় কার্যতঃ তা পেয়েছে এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। ফলে সাধারন মানুষ আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন  না - কোনটা ঠিক কিংবা কোনটা  বেঠিক, কোনটা সত্য কিংবা কোনটা মিথ্যা, কোনটা আসল কিংবা কোনটা নকল। আপামর মিথ্যাবাদীর সুনিপুণ অভিনয় প্রতিভা প্রত্যক্ষ করে অনেক সময় মনে হয়,  ছলনা ও প্রতারণার রোমান দেবী ফ্রাউস বুঝি সশরীরে আবার ধরাধামে নেমে এসেছেন। গোয়েবল্‌স বেঁচে থাকলে অবশ্যই লজ্জা পেতেন, কারণ মিথ্যাচারের উৎকর্ষ, পারদর্শিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক গ্রহণযোগ্যতা এখন গোয়েবল্‌সের রটনা কৌশলকেও ছাড়িয়ে গেছে!


আজকাল, মিথ্যার ধুম্রজালে আড়ষ্ট হয়ে মাঝে মধ্যে আমার নিজের পঞ্চেন্দ্রিয়, বিশেষ করে চোখ কান ঠিক আছে কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ হয়। হতবুদ্ধি আমি ভেবে পাই না দেশের আপামর মানুষ এই  বিভ্রান্তির দোলাচাল থেকে বেড়িয়ে আসবে কি করে?  

যাই হউক, মিথ্যাচার একটি সামাজিক ব্যাধি। মিথ্যার হাত ধরে প্রসারিত হয় সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অনাচার এবং স্বৈরাচারের। যারা মিথ্যাকে পুঁজি করে আত্মস্বার্থ হাসিল করেন, আত্মগ্লানি কিংবা বিবেকের দংশন এদেরকে অবদমিত করে না। দেশ কিংবা জনগণের মঙ্গল কিংবা জনমতও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এই মিথ্যার ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয় সত্যি;   তবে আপনার আমার সকলের  সম্মিলিত প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও এর প্রশমণ ঘটাতে সক্ষম বলে আমি বিশ্বাস করি। রবিঠাকুর বলেছিলেন, “যথার্থ অধিকার থেকে মানুষ নিজের দোষে ভ্রষ্ট হয়।” মিথ্যা এই দোষেরই অন্যতম প্রধান আঁকর। তাই, গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে  নিজের অধিকার রক্ষায়  এই দোষের ভ্রষ্টচক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করুন - মিথ্যাকে না বলুন, মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করুন,  প্রাণপনে সত্যকে নিজের মধ্যে আঁকড়ে ধরুন এবং সত্যের অমোঘ বারতা নির্ভয়ে ছড়িয়ে দিন সর্বত্র।

জয় হউক সত্যের, দূর হউক মিথ্যাচার। সত্য শুভ নিরঞ্জন!

(ড. শরীফ আস্-সাবের শিক্ষক, কবি, লেখক ও সাবেক আমলা)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর