স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী

ছাত্র রাজনীতি

এখনো ছাত্ররাই আন্দোলনের ভ্যানগার্ড

মাহমুদুর রহমান মান্না

২০২১-০৩-২৬

১৯৬৮’র এক মনোরম বিকেল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এসেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলন। সেই উপলক্ষে তার আগমন। আমি তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বলে রাখা ভালো, আমি ভর্তি হবার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ছিল না। তখন চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ সিটি এবং ডিস্ট্রিক্টের ভয়াবহ গ্রুপিং। মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে সংঘর্ষ হতো। এর প্রভাব সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগতো না। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তখনো কসমোপলিটন চরিত্র পায়নি। যারা পড়েন তাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের সন্তান। অতএব চট্টগ্রামের রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরোক্ষভাবে হলেও একটা প্রভাব রাখতো।

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ব্যাচ অনার্সের ছাত্র। আমার বাড়ি বগুড়া। ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে চট্টগ্রামে গেছি অর্থনীতি পড়বো বলে। আমার মতো আরো অনেকে যারা চট্টগ্রামের নন তারাও ভর্তি হয়েছেন এবং হলে থাকেন। এদের সংখ্যা কম, কিন্তু যেহেতু হলে (তাদের সংখ্যা বেশি) আছেন অতএব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব আছে। চট্টগ্রামেরও অনেকেই আছেন যারা হলে থাকেন। এদের মধ্যে মানে চাটগাইয়া ও বহিরাগতদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রায় সব সময়ই ছিল। স্থানীয়ভাবে আমাদের এটা মানিয়ে বা সমন্বয় করে চলতে হতো। যেমন, কোনো কমিটির সম্মেলন বা নির্বাচন হলে গুরুত্বপূর্ণ পদের দু’টি দুই দিকে দিতে হতো। (সভাপতি/সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একটিতে স্থানীয় আরেকটিতে স্থানীয়দের দিতে হতো) আমি যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ- চাকসু’র সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলাম আমার সঙ্গে সহ-সভাপতি পদে একজন চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতা প্রার্থী হয়েছিলেন। এ রকমই ছিল নিয়ম। এই সহ-সভাপতি প্রার্থী মোবারক ভাই পরে ঢাকা বিভাগের কমিশনার হয়েছিলেন এবং রিটায়ার করার পরে হয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার।

আহ্বায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলন করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার উপর এবং সেই লক্ষ্যে আগের রাত্রে আমাদের সাবজেক্ট কমিটি বসেছিল। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল যা পরের দিন সম্মেলনে অনুমোদনের জন্য আমার পড়ে দেবার কথা ছিল। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুন্দর ক্যাফেটেরিয়া ছিল। তিনদিকে পাহাড় আর একদিক খোলা। দোতলা থেকে বিল্ডিংটা শুরু হয়েছিল বলে সেই খোলা দিক থেকে তাকালে মনে হতো শূন্যের উপরে একটা দালান ভাসছে। সেই ক্যাফেটেরিয়ায় আমাদের সম্মেলনের ভেন্যু ঠিক হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিন, নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে পৌঁছে দেখলাম ক্যাফেটেরিয়া ভর্তি; আর রোষ্ট্রামে বসে আছন জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি। আমি গিয়ে পৌঁছানোর পর আমাকেও মঞ্চে ডাকা হলো। আমি গিয়ে বসলাম। একজন দু’জন বক্তৃতা করবার পর আমার নাম ঘোষণা করা হলো বক্তৃতার জন্যে।
আমি খুবই কনফিউজড ছিলাম। ওখানে সম্মেলন হবার কথা ছিল সেইদিন। এবং সংগঠনের আহ্বায়ক হিসেবে আমার সেই সভায় সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। আমি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কথা বললাম। বললাম, গতকাল আমাদের সাবজেক্ট কমিটির মিটিং এর কথা। আমরা যে একটা কমিটি করেছি সেটা বললাম এবং এ-ও বললাম যে কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্দেশ দিলে আমি সেই কমিটি এখানে পাঠ করতে পারি। ঠিক সেই সময় আমার হাত ধরে কেউ টান দিলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম খোদ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী আমাকে সরে যেতে বলছেন। আমি সরে গেলাম এবং তিনি মাইক ধরে বক্তৃতা করতে শুরু করলেন।

আজ অনেকেই জানেন না জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী খুব ভালো বক্তৃতা করতেন। বাংলার আকাশ বাতাস নদী-নালা এবং তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে মিশিয়ে তিনি আবেগঘন বক্তৃতা করতে পারতেন (অবশ্য আজ এতোগুলো বছর পর আমি দেখি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী তার বক্তৃতায় সেই একই ভাষা এখনো প্রয়োগ করেন)। ঠিক সেইভাবেই তিনি আবেগ তৈরি করলেন এই বলে যে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি দেখতে যেতে পারেননি; যেহেতু তিনি জেলে ছিলেন। বক্তৃতা যখন তুঙ্গে উঠলো তখন হল এর মধ্যে কোনো একটা সমস্যা হলো। একজন আরেকজনকে ধমকালো, অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করলো। সঙ্গে সঙ্গেই কির কির করে ছুরি খোলার শব্দ হলো। কেউ একজন বিকট শব্দে আর্তনাদ করে উঠলো: ওরে বাবারে মরে গেলাম রে। মুহূর্তের মধ্যে ক্যাফেটেরিয়া খালি হয়ে গেল। অনেকে দোতলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়লো।

আমি স্বাভাবিক পথে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে লাগলাম। তখন আর একজনের আর্তনাদ শুনতে পারলাম: ও মা আর ঘাড়ের রগ খাডি হালাইয়ে। আই আর ন বাচ্চুম।
এই মানুষটার নাম ওয়াহিদুজ্জামান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছাত্রলীগের, বলা যায় সর্বশ্রেষ্ঠ মাসলম্যান। ইনি ছিলেন চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের গ্রুপিংয়ে ডিস্ট্রিক্ট এর পক্ষে। সম্ভবত তাকে হিট করার জন্য সিটি গ্রপের লোকজন সুযোগ খুঁজছিল। তারাই দলবেঁধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে এবং তার ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে দেয়। তাদের টার্গেট হয়তো শুধুই ওয়াহিদুজ্জামান ছিলেন। কিন্তু মাঝখানে হট্টগোল থামাতে গিয়ে পেটে ছুরি খান আনোয়ারুল আজিম নামে ছাত্রলীগের একজন আন্তরিক কর্মী। তিনি সিটি ডিস্ট্রক্ট গ্রুপের কোন দিকে ছিলেন বলে আমার জানা ছিল না। তিনি কেবল হট্টগোলের শুরুতে সবাইকে থামাতে গেলেন। আর তখনই তার পেটের মধ্যে ১০ ইঞ্চি ছুরির ব্লেড ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আমরা রাতে হল থেকে দলবেঁধে কর্মীরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গিয়ে রক্ত দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে গেছেন। এখন কোথায় আছেন বলতে পারি না। আর ওয়াহিদুজ্জামান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। শুনেছি তখন চট্টগ্রামে তাকে কোমরে পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। তিনি বিএনপি’র নমিনেশন পেয়ে একবার হাটহাজারীর এমপিও হয়েছিলেন। আমি আগেই বলেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে কোনো গ্রুপিং ছিল না। যা হয়েছিল তা শহর থেকে আমদানি হয়েছিল। কিন্তু এ রকম হলো কেন? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে, সেখানে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আসবেন, সেটা তো আমাদের জানবার কথা। আমি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়ক হওয়া সত্ত্বেও সভাস্থলে গিয়ে কেন তাকে প্রথম দেখবো? সেদিন রাতে এসব প্রশ্ন করবার কোনো অবকাশ ছিল না। তাছাড়া কেন্দ্রের সভাপতি যে কোথায় ছিলেন তা আমাদের জানা ছিল না। রাতভর আমরা আনোয়ারুল আজিমের জীবন বাঁচাতে সংগ্রাম করছিলাম। যাই হোক পরদিন সকালে হঠাৎ করে কে যেন আমাকে খবর দিলো আলাওল হলের নিচের তলার একটি রুমে যেতে। সেখানে জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী এসেছেন। আমি আলাওল হলের ছাত্র। কিন্তু আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমি নিচে গেলাম। আর তখনই কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করল যেন আমার দোষেই এগুলো হয়েছে। আমার তো জবাব দেবার ছিল। কিন্তু জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী এবারও আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না। তিনি নিজের থেকেই (ইংরেজিতে) বললেন, আমি তো জানতাম কোনো গোলমাল নেই। এ নিউ বেবি ইজ জাস্ট গোয়িং টু বি বর্ন। তখন ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ ইংরেজি বলার চেষ্টা করতেন বোধহয় এটা বোঝাতে যে তিনি ইংরেজি জানেন। অনেক ভুল ভালও বলতেন। কিন্তু নেতা সেটা খেয়াল করতেন না। আর কর্মীদের কি ঠেকা পয়েছে যে নেতাকে ইংরেজি শেখাতে যাবে! তারা নিজেরাও তো তেমন জানে না।

পুরো ঘটনায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ঢাকায় এসেছিলাম এবং জনাব নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। জহুরুল হক হলের রুমে আলম ভাইয়ের একটা আলমারি ছিল। তার মধ্যে অনেকগুলো সুট সাজানো, উনি আমাকে দেখিয়েছিলেন। তারপরে অনেকগুলো পারফিউম ছিল সেগুলো দেখিয়েছিলেন। একটা পারফিউম থেকে বেশ খানিকটা আমার গায়ে মেখে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি বুঝতে পেরেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর ব্যাপারটা। ওটা কিছু নয়?। সিটি ডিস্ট্রিক্ট এর গ্রপিং। যাই হোক চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছিল, কিভাবে? কিন্তু সে প্রশ্ন করতে পারিনি। কথার মধ্যেই খসরু ভাই (বীর মুক্তিযোদ্ধা খসরু ভাই- স্বাধীনতার আগে ছাত্রলীগের শক্তিশালী মাসল খসরু-মন্টু-সেলিমের অন্যতম একজন, ওরা এগারোজন এর নায়ক) এসে ঢুকেছিলেন রুমে। আলম ভাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমি তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিচতলায় শাজাহান সিরাজের রুমে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে দোতালায় রব ভাইয়ের রুমে নিয়ে গেলেন। রব ভাই তখন একটা পাটি বিছিয়ে তার উপর শুয়ে ছিলেন। কথাবার্তা হলো। সত্যি বলছি আলম ভাইয়ের চাইতে রব সিরাজের সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লাগলো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে যে একটা গ্রুপিং ছিল সেটা যারা এই দল করতেন তারা অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পরেও এটা টের পেয়েছি। চট্টগ্রামের স্থানীয়- অস্থানীয়দের আঞ্চলিকতার দ্বন্দ্ব দেখে আমি এক সময় ভেবেছিলাম আর দলই করবো না। তখন আমাকে আমারই এক বন্ধু সিরাজুল আলম খানের কথা বলেছিল। ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষের একটা কাজ আছে সেটা বলেছিল। আমি অল্পদিনের মধ্যেই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের মারা সেই গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। ৬৮’র পরে কোনো সময় হবে নাজিরহাট কলেজে ছাত্রলীগের এক সভায় চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের নেতা সাবের আহমেদ আজগরি আমাকে এ বিষয়ে বলেছিলেন।

ছাত্রলীগের মধ্যে এই গ্রুপটিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি ভ্রুণ বা নিউক্লিয়াস বলা যাবে কিনা সে বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। আমি যেহেতু ছাত্রলীগ করেছি সেই সময়কার রাজনীতি বোঝাবার জন্য এটা উল্লেখ করলাম। এই গ্রপটি কতোখানি আদর্শভিত্তিক ছিল সেটাও হয়তো একটা প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এ রকম একটা গ্রুপ যে ছিল তা তো পরবর্তী ইতিহাসও বলছে। ছাত্রলীগের বক্তব্যের মধ্যে ছয় দফা, স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা পর্যন্ত বক্তব্য এসেছিল। ‘তোমার আমার ঠিকানা: পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা: ঢাকা ঢাকা’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর: বাংলাদেশ স্বাধীন কর’- এই সব স্ল্লোগান ছাত্রলীগের মধ্যে ওই গ্রুপই চালু করেছিল। তখন যারা ঢাকায় ছাত্রলীগ করতেন তারা প্রায় সবাই একথা বলেন যে ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা, পরবর্তীকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আফতাব উদ্দিন আহমেদ জয় বাংলা স্লোগান চালু করেছিলেন। কেউ কেউ স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে জহুরুল হক হলে পাকিস্তানি হানাদারদের হামলায় নিহত চিশতী শাহ হেলালুর রহমানের কথাও বলেন।

তখনো পর্যন্ত ছাত্রলীগের কোনো সুনাম ছিল না। ছাত্রলীগ এমনকি আওয়ামী লীগও গুণ্ডাদের পার্টি এ রকম একটা ধারণা দেশবাসী ও ছাত্রদের মধ্যে ছিল। ছাত্রলীগ নাম করতে থাকে যখন তোফায়েল আহমেদ ডাকসু’র ভিপি হন। ১১ দফা আন্দোলন সবক’টি ছাত্রসংগঠন মিলেই করেছিল। সেই সংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন বড় ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে যায়। ১১ দফা আন্দোলনের জন্য একজন মুখপাত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সবাই এবং নির্বাচিত ভিপি হিসেবে জনাব তোফায়েল আহমেদকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। তোফায়েল আহমেদকে সেই অর্থে একজন ভাগ্যের বরপুত্র বলা যায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ভিপি ছিলেন না। তিনি ছিলেন জহুরুল হক হলের ভিপি। কোটা অনুযায়ী তিনি ডাকসু’র ভিপি’র দায়িত্ব পান এবং আন্দোলনের মধ্যে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক হয়ে ওঠেন। সেই আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিজয়ের সমস্ত সুফল তিনি তার নেতা আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের ওপর আরোপ করেন। তিনি বা তারাই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। সে আরেক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী ডাকসু নির্বাচন যেটা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভোটে হয়েছিল সেখানে জয়লাভ করে ছাত্রলীগের রব-মাখন পরিষদ।

ডাকসুতে ভিপি পদে জনাব আ স ম আবদুর রবের বিজয় এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তার চাইতে বেশি বিস্ময়কর হচ্ছে তার মনোনয়ন পাওয়া। ছাত্রলীগের মধ্যে, এমনকি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ওই পদে প্রিয় নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ শহিদুল ইসলাম। মধুর ব্যবহার ছিল তার। আর ধারণা ছিল তিনি একজন লেখাপড়া জানা মানুষ। কিন্তু একটু আগে যে গ্রুপিংয়ের কথা বলেছিলাম সেই গ্রুপিং তাকে সহ-সভাপতি পদে মনোনয়ন দিল না। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে যে গ্রুপটি ছিল তারা উঠেপড়ে লাগলেন যাতে আ স ম রব ওই পদে মনোনয়ন পান। যেহেতু গ্রুপিং আছে অতএব একটা সমঝোতা তো হতে হবে। রব গ্রুপ আগ বাড়িয়ে বললো তারা যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ডাকসু সহ-সভাপতি চায়। তাদের জেদ এবং লেগে থাকা কাজে লাগলো। আ স ম রব মনোনয়ন পেলেন।

বিনিময়ে অবশ্য অনেক কিছুই ছাড়তে হলো রব গ্রুপকে। তাতে কি? সহ-সভাপতিই তো ডাকসু’র অলঙ্কার। ডাকসু’র ভিপি ছিলেন বলেই তো তোফায়েল আহমেদ এতোবড় হয়েছেন। সেইদিক থেকে জনাব সিরাজুল আলম খানের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

এরপরে ডাকসু তথা রব গ্রুপ ছাত্রলীগে ইতিহাস তৈরি করলো বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখিয়ে। বলা যেতে পারে সেই সময়টাই ছাত্র রাজনীতির চূড়ান্ত উৎকর্ষের সময়। আমরা আজ যে অতীত ছাত্র রাজনীতির জন্য গর্ব করি সেতো প্রধানত ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের আন্দোলন, এবং ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের জন্যে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনও ছাত্র আন্দোলনের জন্য একটি মাইলফলক। কিন্তু আমরা আলোচনা করছি ছাত্র আন্দোলনের সেই সময়ের কথা।

আমাদের অতীতের ছাত্র আন্দোলন নিশ্চিতই সংগ্রামের উদ্ভাসে উজ্জ্বল। আমরা আমাদের অতীত আন্দোলন নিয়ে গর্ব করতে পারি। কিন্তু সেটা অবিমিশ্র ছিল না, ভালো-মন্দ মিশিয়ে ছিল। আমার মনে আছে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তোফায়েল আহমেদ পল্টনের জনসভায় বক্তৃতায় এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, যারা আমাদের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে তাদেরকে আমাদের কাছে ধরিয়ে দেবেন।
রাজনীতি কোনো সময়ে একটি মসৃণ পথপরিক্রমা নয়। এতে আঁকাবাঁকা আছে, উত্থান-পতন আছে। আছে জটিল, কুটিল সব বাঁক। যে গ্রুপটি সেই সময় থেকেই স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল তাদেরকে এইসব পথে হাঁটতে হয়েছে। ছাত্রলীগের মধ্যে গ্রুপিং ছিল, নিজেদের মধ্যেও গ্রুপিং ছিল। এই গ্রুপিং এর প্রকাশ স্বাধীনতার পরেও হয়েছে ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জেলায় জেলায় সম্মেলন করতে গিয়ে আমি এ ধরনের গ্রুপিংয়ের প্রকাশ দেখেছি। তবে এটা ঠিক যে মূল দলের নেতাদের বিশেষ করে নেতাদের নেতা সিরাজুল আলম খানের সবকিছুই রাজনৈতিকভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল।

প্রসঙ্গত ছাত্র ইউনিয়নের কথা না বললে আমাদের ছাত্র রাজনীতির অতীতে একটা বড় ফাঁক থেকে যাবে। ভালো ছাত্ররা সব ছাত্র ইউনিয়ন করতো সেই সময়, ছাত্রলীগ নয়। ছাত্র ইউনিয়ন মূলত: কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন হয়তো সে কথা স্বীকার করবে না। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি যে রাজনীতি গ্রহণ করতো ছাত্র ইউনিয়নও সেই লাইনেই তাদের রাজনীতি করতো। মূল পার্টি সম্ভবত প্রথমদিকে ছয় দফাকে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থিত কর্মসূচি মনে করতো। এইজন্যে শেখ মুজিব যখন ছয় দফা নিয়ে সারা দেশে প্রচারে বেরিয়েছেন তখন কমিউনিস্ট পার্টি তার পক্ষে কথা বলেনি। ছাত্ররা যখন ১১ দফা প্রণয়নে বসে তখন ছয় দফা নিয়ে বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্যরা ৬ দফাকে একটি দফায় বিধৃত করে গ্রহণ করতে রাজি হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছয় দফার আন্দোলন তথা বাঙালিদের স্বাধিকারের আন্দোলন আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে চলে গেছে। ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারতো। ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব ছাত্র ইউনিয়নের কাছে আসতেও পারতো।? কিন্তু তারা মূল পার্টির লাইন অনুসরণ করতে গিয়ে সেই স্বাধিকারের আন্দোলনে উদ্যোগী হয়ে আসেনি। আন্দোলনে থেকেছে, ছাত্রদের অস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার জন্যে ব্রিগেডও করেছে। কিন্তু আন্দোলনে নেতৃত্বের জায়গায় আসতে পারেনি।

এই সময়: এক
এই সময়টা কবে থেকে ধরবো তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সাধারণভাবে সেই সময় বললে স্বাধীনতার আগের স্বর্ণালি সময়ের কথা বলা হয়। কিন্তু সেইভাবে ধরলে এই সময়ের বয়স ৫০ হয়ে যায়। এটাকে স্বাধীনতার ঊষালগ্ন বা এই সময় বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পর এদেশের মানুষ এক অসাধারণ ছাত্র আন্দোলন প্রত্যক্ষ করে। সারা দেশে তখন শেখ মুজিবের নামে বাতাসে কাঁপন জাগে, সাগরের ঢেউ ওঠে। বিরোধীদল বলতে কিছু ছিলনা। যাও বা ছিল তারা কার্যকরভাবে এমনকি সরকারের সমালোচনাও করতো না। তখন ধীরে ধীরে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে জাসদ ছাত্রলীগই হয়ে ওঠে সরকারের সবচাইতে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ। ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ৭২ সালে। কিন্তু এই বিভক্তির বীজ বপিত হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। তখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্রলীগের মধ্যে দু’টি গ্রুপ কার্যকর ছিল। এই নিয়ে লম্বা ইতিহাস লেখা যাবে। কারণ ছাত্রলীগের এককালের সাধারণ সম্পাদক জনাব সিরাজুল আলম খানসহ তার অনুগামীরা দাবি করেন যে- ৬২ সালে তারা স্বাধীনতার পক্ষে একটি নিউক্লিয়াস গড়ে তোলেন এবং সেই নিউক্লিয়াস ছাত্রলীগের মধ্যেও কার্যকর ছিল। আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের বেশিরভাগ নেতা সেটা স্বীকার করেন না। কিন্তু এই কথা ঠিক, বিভক্তি একটা ছিল এবং সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে। ছাত্রলীগের এই অংশটি ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা- মেঘনা-যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে: বাঙালি বাঙালি’ ‘পিণ্ডি না ঢাকা: ঢাকা ঢাকা’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর: বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগান শুরু করে দিয়েছিল এবং সেটা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ধ্বনিত হতো। বিপরীত পক্ষে আরেকটি গ্রুপ স্লোগান দিতো, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো: পাতি বিপ্লবীদের খতম কর। ‘মজার ব্যাপার এই উভয় গ্রুপই শেখ মুজিবকে নেতা মানতো এবং বলতো শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে আছেন। রব সিরাজ গ্রুপ এ-ও বলতো যে শেখ মুজিব একজন সাংবিধানিক নেতা। তিনি তো আর সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলতে পারেন না। তাই তিনি তাদেরকে অর্থাৎ ছাত্রলীগ (রব-সিরাজ গ্রুপ) কে দিয়ে স্বাধীনতার কথা বলাতেন। হয়তো এটা সিরাজুল আলম খানের একটা কৌশল ছিল। হয়তো এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। কিন্তু সেই বিতর্কে না গিয়ে এটা বলা যা, ছাত্রসংগঠনের এই চাপ এবং বিরামহীন রাজনৈতিক তৎপরতা শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে এটা বলতে প্রণোদিত করেছিল, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এটি স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল কিনা সে বিতর্কে যাওয়ার দরকার মনে করছি না। কিন্তু এ কথা বলতে হবে, মূল রাজনৈতিক দলটি যখন স্বাধীনতার ধারে কাছ দিয়ে নেই, প্রধান নেতা যখন স্বাধীনতার কথা বলছেন না বা বলতে পারছেন না তখন একটি ছাত্রসংগঠন তাদের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় দেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধের দরজায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। যেকোন দেশের ছাত্র রাজনীতির বিবেচনায় এ এক অমূল্য অর্জন। আজ এতগুলো বছর পর কেউ কেউ বিতর্ক করছেন কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া এই কাজটি কি হঠকারিতা নয়। আমি সে বিতর্ক পাশে রেখে বলবো, কিন্তু দেশ তো স্বাধীন হলো। এই স্বাধীনতাকে কি আমরা স্বাগত জানাই না? বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং এর পরিণতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল নায়ক নিশ্চয়ই শেখ মুজিব। কিন্তু এটা ঠিক, একটি ছাত্র সংগঠনের অনবদ্য ভূমিকা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।

যাই হোক, স্বাধীনতা পর্যন্ত এইভাবে চলা হয়তো সম্ভব ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে পট বদলে গেল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও ছাত্রলীগের এই বিভেদ চলছিল। নেতারা মানিয়ে চলছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে যখন সবাই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলেন তখন নূরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হলো তারা মুজিববাদে বিশ্বাস করে। এখন থেকে তারা দেশে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করবে। আর রব-সিরাজ গ্রুপের পক্ষ থেকে মুজিববাদকে একটি সোনার পাথর বাটি বলে উল্লেখ করে বললো দেশে সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ছিলেন। তিনি দেশে ফিরলেন ৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। তখনো তিনি বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু তিনি এসে তার ছাত্র সংগঠনের বিভেদকে দূর করবার চেষ্টা করলেন না, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেন না। ছাত্রলীগ ভেঙে গেল। ৭২-এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ দু’টি প্যানেল দিলো।

এই ডাকসু নির্বাচনে রবপন্থি ছাত্রলীগ ডাকসুতে একজন মহিলা সদস্য (মমতাজ বেগম) এবং হলে টুকটাক দুটো একটা জায়গায় জিতলো। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল মিছিল করে বাংলার মানুষের নেতা শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসভবনে গিয়ে দেখা করলো। সেখানে ছাত্রলীগের তৎকালীন উদীয়মান নেতা (পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি এবং তিয়াত্তরের ডাকসু নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদপ্রার্থী) জনাব আ ফ ম মাহবুবুল হক সাধারণ ছাত্রদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের কাছে আবেদন জানালেন; এক নদী রক্ত পেরিয়ে যে দেশ স্বাধীন হলো সেই দেশে এখন সামাজিক বিপ্লব দরকার; সমাজ বদলানোর প্রয়োজন। তিনি শেখ মুজিবের কাছে জানতে চাইলেন, শেখ মুজিব এখন কোনপথে এগোবেন? বিশ্বের যে সমস্ত দেশ সংগ্রাম করে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাদের পথে নাকি আপসকামীতার পথে। শেখ মুজিব কোনো জবাব দিলেন না। মাঝে মাঝে মাথা নাড়লেন। স্মিত হাসলেন। মনে হলো যেন তিনি বক্তৃতাটি খুব উপভোগ করছেন এই ভাবে বললেন, ভালোই তো বলতে শিখেছিস রে। ’৭২ সালের সম্ভবত জুলাই মাসে ছাত্রলীগ আলাদা আলাদা কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডাকলো। মুজিববাদীরা ডাকলো রেসকোর্সে। আর রব গ্রুপ ডাকলো পল্টন ময়দানে। রব গ্রুপ প্রচার করে যে শেখ মুজিব তাদের সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পল্টনে এলেন না, তিনি গেলেন মুজিববাদীদের ওখানে-রেসকোর্সে। তখন রব-সিরাজ গ্রুপ পল্টন ময়দানের সম্মেলনে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব স্পষ্ট করে তোলে।
স্বাধীনতার পরে ছাত্রলীগের এই বিভক্তি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে আমি মনে করি। পল্টনে ছাত্রলীগ এমন কিছু ঘোষণা দেয় যা একটি ছাত্র সংগঠনের জন্য খুব স্বাভাবিক নয়, কিন্তু ছাত্রদের জন্য উদ্দীপক। তারা মুজিববাদকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে এবং ঘোষণা করে ‘আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য’। পরবর্তীকালে তারা শ্রেণিসংগ্রামের ঘোষণা দেয় এবং ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।

তাদের বুঝ অনুযায়ী তারা একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে। তার বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। তবে এইকথা এখানে বলা জরুরি যে স্বাধীনতার পরপরই রব গ্রুপের এই বিদ্রোহ জনসমর্থন পেয়েছিল। ৭২ সালের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন জিতেছিল বটে, কিন্তু ৭৩ এ সারা দেশের সমস্ত্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড় কলেজগুলোতে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণাকারী রব গ্রুপ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ছাত্র সমাজের কাছে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ’৭৩ এর নির্বাচনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী মাহবুব-জহুর প্যানেলকে ঠেকাতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন জোট গঠন করে লেনিন- গামা প্যানেল ঘোষণা করে। কিন্তু তারপরেও তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বিশাল বিজয়কে ঠেকাতে পারেনি। অবশেষে তারা সেই নির্বাচনের ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটাই প্রথম ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা। শুধু তাই নয়। অল্পদিন পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে ব্যাপক কারচুপি করতে হয়। দাউদকান্দি আসনে আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জাসদের রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে পরাজিত হন। স্থানীয়ভাবে তা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই আসনের সমস্ত ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসে। এখানে পুনর্গণনা হয় এবং তাতে খোন্দকার মোশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। কিন্তু এটাকে শুধু ব্যর্থতা বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। বস্তুত স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি। দ্রব্যমূল্য বাড়তে বাড়তে মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। ’৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকার, বিশেষ করে সরকারি দলের লোকজন রিলিফ দ্রব্য, রিলিফের কম্বল চুরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা যে নগ্ন লুটপাট করে তাতে দেশব্যাপী তাদেরকে রিলিফ চোর ও কম্বল চোর বলে আখ্যায়িত করা হয়। শেখ মুজিব নিজে বলেন যে আমার চারপাশে সব চাটার দল। কম্বল বিতরণে লুটপাটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের কম্বলটি পর্যন্ত পাননি।

শেখ মুজিব একবার রিলিফ এর মালামাল ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী নামিয়েছিলেন। কিন্তু দুইদিন যেতে না যেতেই তাদেরকে তিনি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। যেহেতু এই অপারেশনে ধরা পড়ছিল সব তারই দলের লোক।
দুঃখজনক হল সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো সমালোচকদের বিরুদ্ধে লাল ঘোড়া দাবড়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। সরকার রক্ষীবাহিনী নামে এক সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে। তারা রাজপথের আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিরোধীদলের কর্মীদেরকে ঘরে বাইরে নির্যাতন করে; এমনকি হত্যা পর্যন্ত করে। সিরাজ শিকদার নামে তখনকার বামপন্থি নেতাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংসদ নির্বাচনে যেখানে তাদের তিন দলীয় সরকারি জোটের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিল। এবং এই হাইজাকের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র।

আগেই বলেছি স্বাধীনতার পরপরই সাড়ে তিন বছরের এই দুঃশাসনের সময় বিরোধীদল বলে কার্যত কিছু ছিল না। মূল বিরোধী শক্তি ছিল ছাত্ররাই। এবং তারা ছিল ছাত্রলীগের নেতৃত্বে। ’৭২ সালের অক্টোবর মাসে অবশ্য জাসদ গঠিত হয়েছিল। সেই জাসদও গঠিত হয়েছিল মূলত উক্ত ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসা নেতৃত্বের সমন্বয়ে। কেবলমাত্র মেজর জলিল ছিলেন সভাপতি আর জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির বাকি আর প্রায় সবাই ছাত্রলীগের প্রক্রিয়া থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব।

আমার জানামতে এই উপমহাদেশে কেবলমাত্র অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন একটি ছাত্র সংগঠন যা রাজ্যভিত্তিক একটি আন্দোলন করে জয়যুক্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সরকারও গঠন করে। জাসদ ছাত্রলীগ সরকার গঠন করার গৌরব অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু সাড়ে তিন বছর তারা অসাধারণ সাহসিকতায় বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করে।

চুয়াত্তর সালের মার্চ মাসের পর থেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ তাদের রাজনীতির গণলাইন পরিত্যাগ করে সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন গ্রহণ করে। বাংলাদেশ চীন নয়। চীনের লাইন এখানে খাটবে না। গণলাইন ছেড়ে জাসদ একটি হঠকারী লাইন নেয়। ছাত্রলীগের উপরেও তার প্রভাব পড়ে। ফলে ছাত্রলীগ একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে আর তেমন ক্রিয়াশীল থাকেনি; সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরের চেষ্টা করতে থাকে এবং এইভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
’৭৫ এর শুরুতেই আওয়ামী লীগ সমস্ত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করে। কিন্তু এতে করে তারা শেষ রক্ষা করতে পারেনি। ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর একটি অংশ শেখ মুজিবকে হত্যা করে। খোন্দকার মোশতাক দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। পর্যায়ক্রমিক ক্যু-পাল্টা ক্যুর মধ্যে দিয়ে অবশেষে জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসেন।

আওয়ামী সরকারের পতন এবং শেষে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের মধ্যে দিয়ে দেশের রাজনীতিতে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। যে জাসদকে আওয়ামী রাজনীতির বিকল্প শক্তি বলে ভাবতে শুরু করেছিল মানুষ, সেই জায়গা ধীরে ধীরে জিয়াউর রহমান দখল করে নেন। সবাই জানেন, জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন এবং তার অঙ্গ সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। শুরুতে ছাত্রদল ছাত্রসমাজের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। কিন্তু জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় হতে শুরু করেন এবং তার জনপ্রিয়তার জোয়ারে ছাত্রদল ভাসতে শুরু করে। সত্যিকথা ছাত্রদল নিজস্ব করে কিছু গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীকালে বেগম জিয়ার জনপ্রিয় ইমেজের পক্ষপুটে ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করে। নব্বই-এ এরশাদ বিরোধী যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যা শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর গণআন্দোলনে রূপ নিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল তাতে ছাত্রদল তথা ডাকসু ভূমিকা পালন করেছিল।

দুই
এই সময়টাকে আমি বলছি অতি বর্তমান সময়। এটা শুরু হয়েছিল প্রধানত ঊনিশ শ’ একানব্বই সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। যেখানে সবার প্রত্যাশা ছিল এখন থেকে ধীরে ধীরে একটা গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠবে, সংস্কৃতি গড়ে উঠবে; সেখানে শেখ হাসিনা সেই নির্বাচনকে একপ্রকার প্রত্যাখ্যান করে বললেন, সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে এই নির্বাচনের ফলাফলকে বদলে দেওয়া হয়েছে। তখন থেকে ধীরে ধীরে সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হলো; তৈরি হলো বিদ্বেষের সংস্কৃতি। শেখ হাসিনা এই বিদ্বেষের বীজ বপন করেছিলেন। তিনিই এতে সার দিলেন, পানি দিলেন। এই বীজ অঙ্কুরিত হলো। ধীরে ধীরে তা এখন বড় গাছে পরিণত হয়েছে।

শিক্ষাঙ্গনে এর সরাসরি প্রভাব পড়লো। বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চর দখলের সংস্কৃতি চালু হলো। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকবে তখন সে দলের ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং হলে থাকবে। অন্য কেউ বিশেষ করে মূল প্রতিপক্ষ দল থাকতে পারবে না। এটা যেন একটা অলিখিত আইন হয়ে গেল। দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। ফলে তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একক দখলদারিত্ব কায়েম করে ফেললো। মূল প্রতিপক্ষ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রতিবাদ করতে পারলো না। তারা বরং মানে মানে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে গেল।

বস্তুত ক্যাম্পাসগুলোতে গত এক যুগ কোনো বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছিল না। কিছু কিছু বামপন্থি সংগঠন এর মধ্যেও কাজকর্ম করেছে। কিন্তু সেটা কোনো বিরোধী রাজনীতির ধারা তৈরি করতে পারেনি। দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের দখলদারিত্ব কায়েম হয়েছে। অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে, গুম, খুন কোনো ব্যাপার নয়। সরকারের দায়িত্ব ছিল এগুলোর প্রতিকার করা। তারা বরং তা না করে যাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাদেরকে দায়ী করে বলেছে, হয়তো কোনো ব্যক্তিগত কারণে আত্মগোপন করে আছে। এক সময় ফিরে আসবে। আগেই বলেছি, বিরোধী ছাত্র রাজনীতির মাঠ প্রায় ফাঁকা ছিল- এই দীর্ঘ সময় ধরে। এত বড় জুলুম নির্যাতনের মুখেও ছাত্রসমাজ কোনো প্রতিবাদ করছে না! অথচ এই ছাত্র এদেশে ইতিহাস গড়েছে। এখন কী হলো তাদের? ভয় পেয়েছে? নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সুবিধাবাদের চোরাবালিতে, গলিতে আটকে গেছে? ব্যক্তিগত আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা গ্রাস করেছে? এই সমস্ত সমালোচনা বেশি করে জায়গা পেয়েছে। ব্যাপারটা ভাববার মতো।

সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন এই সময়ের মধ্যেই দেশে অন্তত তিনটি বিশাল আন্দোলন হয়েছিল। এবং তিনটি আন্দোলনেই সরকারপক্ষ নতি স্বীকার করেছিল। এরমধ্যে প্রথমত ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন যেটা প্রধানত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা করেছিল তার উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয়ত উল্লেখ করা উচিত নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা যা শুরু হয়েছিল এক কলেজের শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। সপ্তাহব্যাপী ঢাকার সড়কসমূহ তখন ছাত্ররা নিজেরাই ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছিল। নিরাপদ ট্রাফিক নিশ্চিত করার একটা ডেমোনেস্ট্রেশন হিসেবে তাদের স্লোগান ছিল- রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হবে। সবাই জানেন, এই আন্দোলন সফল হয়নি। সবাই আন্দোলনের যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছে। সরকার এই আন্দোলনের মধ্যে উদ্দেশ্যমূলক উস্কানি খুঁজে পেয়েছে এবং নির্দয়ভাবে সে আন্দোলন দমন করেছে। মজার ব্যাপার হলো, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিম্বা সাধারণভাবে পথচারী ও নাগরিকদের মধ্যে কোনো ব্যর্থতার গ্লানি জন্ম নেয়নি।

তৃতীয়ত: এবং সর্বশেষ হিসেবে আমি কোটা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করবো। আমি মনে করি বর্তমান ছাত্র আন্দোলনকে বুঝতে হলে এই কোটা আন্দোলনকে আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। প্রথমেই বলি, যারা বর্তমান ছাত্র আন্দোলন কিংবা গণআন্দোলনকে বায়ান্ন, ষাট, বাষট্টি, ঊনসত্তর বা নব্বইয়ের আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝতে চান তারা ভুল করছেন। এখনকার পরিস্থিতি সেই সময় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীনতার আগের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও এরশাদের সময় পর্যন্ত যে পরিস্থিতি ছিল তার চাইতে এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। এখন দেশে একটি নৃশংস ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত এবং এটি প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের সবচাইতে প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। এবং যে দলের শিকড় এখনও তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের রয়েছে ইতিপূর্বে এক দলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা। অনেকে হয়তো ভাবতেই পারেনি এই আওয়ামী লীগ এতখানি নৃশংস হতে পারে। এখন যারা আন্দোলন করছে, আমি শিক্ষার্থীদের কথা বলছি, তাদের অনেকেই স্বাধীনতার পরের দুঃশাসন, স্বৈরশাসন সম্পর্কে জানেও না। অতএব, তারা যখন আন্দোলন শুরু করেছিল তখন তাদের প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকতো ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তারা তাদের মাকে খুঁজে পেতে চেয়েছে। এসবই অভিজ্ঞতার অভাব। তারা আওয়ামী লীগের বিকল্প কোনো বিরোধীদলকে পছন্দ করতে পারেনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। ফলে তাদের এতবড় আন্দোলন আর যাই হোক গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন ছিল না; সরকার পরিবর্তনের কথা ছিল না। এখন হয়তো তারা সেটা ভাবে। কিন্তু তখন যদি ভাবত তাহলে আমরা হয়তো আন্দোলনের ভিন্ন একটা মোচড় দেখতে পারতাম।

যারা বলেন, যে ছাত্র-যুবক বায়ান্ন, ষাট-বাষট্টিতে, ঊনসত্তরে ছিল তারা এখন নেই; তারা এখন সবাই ব্যক্তিগত স্বার্থের ধান্ধায় ব্যস্ত; তাদের উদ্দেশ্যে বলবো- ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তো নিশ্চয়ই সবাই করবে। আর নেটের জগতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের সুযোগ হয়েছে অনেক। কিন্তু তার পরেও ছাত্রসমাজ এই ফ্যাসিবাদ পছন্দ করে না। তার প্রতিবাদ করার কোনো সংগঠন বা মাধ্যম না পেলে তারা কীভাবে করবে? কিন্তু যখন ডাকসু নির্বাচন এসেছে তখন তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা কী চায়? সরকার কিন্তু সেটা ঠিকই বুঝেছে এবং সেই জন্যই আর কোনো নির্বাচনের পথে এগোয়নি।

আজও গণতন্ত্রের পক্ষে, নির্যাতন, দমন নীতি, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ নিরলস প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ চেষ্টা করছে আশার আলো দেখতে। দৃশ্যত এখনো ছাত্রদেরকেই দেখছি আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে। এই প্রচণ্ড স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও আমি আশার আলো তাদের মধ্যে দেখতে পাই।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status