× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ফিরে দেখা / ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখেছিলাম

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী

জয়ন্ত চক্রবর্তী
২৬ মার্চ ২০২১, শুক্রবার

প্রথমেই স্বীকার করে নেয়া ভালো যে, আমি পাটিগণিতের হিসাবে শুদ্ধ বাঙাল নই। আমার বাবা উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে রুটি-রুজির টানে হুগলি জেলায় থিতু হয়েছিলেন। আর মা পাবনার মেয়ে হলেও কলকাতার নারকেল ডাঙায় বড় হয়েছিলেন। তাহলে কি আমি না বাঙাল, না ঘটি অর্থাৎ বাঘ হলাম? নাকি আমি কুলীন ঘটি না হলেও ঘটি বংশের কুশীলব হিসেবে গণ্য হবো? যাক্‌গে এসব জাতের নামে যাবতীয় বজ্জাতি। বরং বলি বাংলাদেশের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্কের কথা। সেই কবে স্কুলের শেষ গণ্ডিতে পড়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আকৃষ্ট হয়েছিলাম তা আর মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি গর্জে উঠেছিল। মুজিবুর রহমান তখন আমাদের কাছে হিরো।
আনন্দবাজার আর যুগান্তর কাগজে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রোমহর্ষক বিবরণী বের হচ্ছে আর আমরা তা গোগ্রাসে গিলছি। রাতে রেডিওতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এর মন্দ্রিত কণ্ঠে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সশস্ত্র সংগ্রাম আমাদের চুল খাড়া করে দিচ্ছে। পাটন ট্যাংক, সাবার জেট, রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, মেজর জগজিৎ সিং অরোরা, ফিল্ড মার্শাল মানেকশা, জগন্নাথ হল শব্দগুলো তখনই শোনা। ওই সময় ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা আমাদের আবেগে জোয়ার তুলেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচালি মাথায় থাক। এপার বাংলার গঙ্গার কূলে বেড়ে ওঠা এক কিশোর ওপার বাংলার পদ্মাকেও যেন আপন করে নিয়েছিল। এরপর বহু রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম। কেউ কি খবর রেখেছিল সেদিন- এপার বাংলার এক অখ্যাত কিশোরের বালিশের কোল ভিজে গিয়েছিল? পঞ্চাশ বছর আগের সেই স্মৃতি আজ অনেকটাই বিবর্ণ। তবু, সেই আবেগ? সেই উন্মাদনা তা কি ভোলা যায়? প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক যেদিন তার ধানমণ্ডির বাড়িতে সপরিবারে সামরিক অভুথ্যানে নিহত হলেন? তার পরদিন খবরের কাগজ আঁকড়ে ধরে, রেডিওতে কান পেতে এক কিশোরের কান্না সীমান্ত পেরিয়ে ওপার বাংলায় পৌঁছায়নি ঠিক। কিন্তু, শেখ মুজিবুর রহমানের নিধনের কাহিনী, ছোট্ট রাসেলের খাটের তলায় লুকিয়ে বাঁচার আকুতি, শেখ কামালের ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া দেহ কি সেদিন আত্মীয় বিয়োগ ব্যথা এনে দেয়নি? বহুদিন পরে আমার পেশার সুবাদে প্রথমবার বাংলাদেশে গিয়ে দর্শন করেছিলাম ঢাকার ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, তখন যা ন্যাশনাল মিউজিয়ামে কার্যত রূপান্তরিত। সারা বাড়ির সিঁড়িতে চাপ চাপ রক্তের দাগ, টেলিফোনের কাচের ঘরে ক্রেডল থেকে টেলিফোনটি ঝুলছে, মুজিবপত্নীর পানের বাটা, এমনকি লাইব্রেরি ঘরে কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতার বুক ফুঁড়ে গুলি চলার দৃশ্যকাব্য সব অটুট রেখে দেয়া হয়েছে আধুনিক সংরক্ষণ ব্যবস্থায়। এক টুকরো ইতিহাসকে সেদিন ছুঁয়ে দেখেছিলাম বাংলাদেশে। এরপর পেশা আমাকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে সে দেশে। কখনো ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে ক্রিকেট কিংবা ফুটবল কভার করতে। কখনো সার্ক সামিট কভার করতে আবার কখনো বা নববর্ষ উৎসবে রমনা বটমূলে। বাংলাদেশের নবীন রাষ্ট্র থেকে পরিণত হওয়ার আমি সাক্ষী। নিবিড় বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়েছি ঢাকা মোহামেডানের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন মোসাব্বের রহমান আর তার স্ত্রী একদা সিরিয়াল অভিনেত্রী, বর্তমানে সফল ব্যবসায়ী চান্দা মেজবাহিনের সঙ্গে। বর্তমানে মানবজমিন পত্রিকার মালিক প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তো এক আশ্চর্য আলোক সমান আবিষ্কার। মতি ভাইকে আমি সেই সময় থেকে চিনি যখন তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সংবাদদাতা। বিদেশে বিশ্ব কাপ কভার করতে গেলেই মতিভাই আমার হোটেলের রুমমেট। কত বিনিদ্র রজনীতে রোমের রোমা টার্মিনি স্টেশনের পাশে ক্যাপিটল হোটেলের ঘরে কিংবা প্যারিসের গারে দু নর্দের হোটেলে অথবা টোকিও কিংবা সিওল-এ তিনি আমাকে মানবজমিন নিয়ে তার স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন। দুই তরুণ সাংবাদিকের প্রবাসে-পরবাসে গভীর রাত এভাবে দিনে পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বারবার গিয়েছি। ঘুরে এসেছি চট্টগ্রাম। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন অথবা ক্রোড়পত্র বের হলে কলকাতায় সম্পাদকের ঘরে আমার এত্তেলা পড়তো। আমি ঢাকার গুলশান, শ্যামলী দেখেছি, পাগলার মোহনায় দাঁড়িয়ে নিদারুণ দারিদ্রও দেখেছি, পদ্মার বুকে লঞ্চে ফকির আলমগীরের উদাত্ত কণ্ঠের গান শুনেছি, ঢাকার বিখ্যাত ইলিশ আর পাঙ্গাশ মাছ খেয়েছি, মোরগ পোলাও আমার হৃদয়কে মথিত করেছে, মরণ চাঁদ ঘোষের মিষ্টির স্বাদ আমার মুখে লেগে আছে। এলিফ্যান্ট রোডের শপিং মলে ঘুরেছি আবার বায়তুল মোকাররমের পেভমেন্টের বাজার ঘুরেছি। ঢাকা প্রেস ক্লাবের সকালের লুচি তরকারি আজও তো মুখে লেগে আছে। দেশে খবর পাঠানোর তাগিদে টিঅ্যান্ডটির কর্মীদের সঙ্গে তো বন্ধুত্বই হয়ে গিয়েছিল। আসলে বাঙাল না হলেও ঢাকাকে, বাংলাদেশকে কেন আমি সেকেন্ড হোম বলে মনে করেছি তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা অবশ্য মেলে না। কিন্তু হৃদয়ের আবেগ কি কোনো যুক্তি মেনে চলে? জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা- আমার কাছে অবশ্যই কিছু ওজনদার নাম। কিন্তু, এর বাইরেও আছে অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশের নাগরিকরা- খুলনা, যশোর, বরিশাল, সাতক্ষীরা, নড়াইল, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রামে বসে যারা একদিন অস্ত্রে শান দিয়েছিল, স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল, আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তিতে তাদের কথা ভুলি কি করে? এঁরাই তো বাংলাদেশের হৃদয়। তাই আজ সমস্বরে বলি- জয় বাংলা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলকাতা প্রতিনিধি, মানবজমিন
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর