‘১০০১ রাত্রি’ বা ‘আরব্যরজনীর’ গল্পের মধ্যে আলাদিনের চেরাগের কথা আমরা সবাই জানি। একটা বাতিকে ঘষলে এক বিরাট দৈত্য এসে হাজির হতো, আলাদিন সাহেব যা চাইতেন, তাই হাজির করতো সে দৈত্য। এমন বিস্ময়কর চেরাগ এখন মানুষের হাতে হাতে। চেরাগ নামটাও মানানসই, কারণ বাটন চেপে এতে বাতিও জ্বালানো যায়। তবে এটা আসল জিনিস হাজির করে না, হাজির করে ভিডিও ক্লিপ, ছবি এবং তথ্য। তাই একে যাদুর আয়না বলাই ঠিক। এই আয়নায় তেল-পড়া দিলে, অর্থাৎ ইন্টারনেট সংযোগ দিলে, প্রতিফলিত হয় গোটা পৃথিবী। এটা আর কিছু নয়, মোবাইল ফোন সেট।
যাদুর আয়নায় বোতাম টিপতে টিপতে প্রায় সবাই এখন একপ্রকার মোবাইল-বিশারদ। এমন অনেকে আছেন, লেখাপড়া বলতে গেলে কিছুই জান্নে না, 'ঢাকা' লেখা বানান করে পড়তেও পারেন না, কিন্তু ইংরেজিতে নিজের মোবাইল নম্বর হড়হড় করে বলে যান- জিরো, ওয়ান সেভেন.. ইত্যাদি। শুনে অবাক হতে হয়। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা নানা দেশে তাদের আত্মীয় বন্ধু রয়েছেন।
ছবি পাঠাচ্ছেন, ভিডিও পাঠাচ্ছেন, পচ্ছন্দের গান পাঠাচ্ছেন, বড় বড় মানুষদের বক্তব্যের অডিও-ভিডিও ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আবার প্রতি-উত্তরে অনেক কম-পড়ালেখা জানা লোকেরাও জবাব দিয়ে দিচ্ছেন। লিখতে না জানলেও জবাব দিতে অসুবিধা নেই, বহু সাংকেতিক ছবি আছে, তার একটা পছন্দ করে পাঠিয়ে দিলেই হলো। প্রযুক্তির থলে থেকে সক্রিয় ছবির বিড়াল, কিংবা খরগোশ বের হয়ে তখন লাফঝাঁপ দেয়, তালি বাজাতে থাকে। ওদিকের বন্ধু জানতে পারেন, তার বন্ধুটি খুশি হয়ে তোফা পাঠিয়েছেন। দুঃখের কথা জানাতে গম্ভীর মুখের বাঁকাতেড়া কান্নাভেজা মুখের ছবিও আছে ।
যাদুর আয়নার কল্যাণে এখন শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে দেশ-বিদেশের করোনার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে পারছেন। ফেসবুকের খাতায় একটা নাম উঠানো থাকলে বন্ধুরা যেসব পোস্ট শেয়ার করেন এবং কাছের বন্ধুরা যে-সব ছবি বা তথ্যপূর্ণ বক্তব্যে লাইক দেন- সেসব এসে হাজির হয়। আবার কোনো ছবি বা ভিডিও ভাইরাল হলে তা চলে আসে, কারণ বন্ধুদের কেউ না কেউ তাতে লাইক দেন । এভাবে কত কি যে এলো আর গেলো, তার হিসেব রাখা ভার। যাদুর আয়না বলতে পারবে, কবে কার পোস্ট কত হাজার বুড়ো আঙ্গুল পেয়েছে, আর কতজনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু উপকারী তথ্য তো রয়েছেই। করোনার সময় কত পরামর্শ পেয়েছে মানুষ, কি খেলে কি হবে, কিভাবে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, কেমন করে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে, ইত্যাদি। খাদ্যবস্তুর ক্ষেত্রে করোনার ওষুধ হিসেবে উপকার হোক আর না হোক, সুষম খাদ্যবস্তু যদি হয়ে থাকে , তা খেলে শরীরে ক্যালরি তো হয়েছে , রোগ প্রতিরোধ-ক্ষমতা বেড়েছে। যাদুর আয়নাকে তাই ধন্যবাদ দিতেই হয়।
তবে যাদুর আয়না যে দুচারটা আজগুবি তথ্য বয়ে আনে না , ভয়ংকর ছবি দেখায় না, মিথ্যে গুজব দিয়ে বিভ্রান্ত করে না, তা বলা যায় না । সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে রেশারেশি সৃষ্টি করে না, তাও কি বলতে পারি ? সবই যাদুর আয়নার দপ্তরের আওতাভুক্ত কাজের মধ্যে পড়ে। সবচেয়ে ভীতিকর হচ্ছে , অতিরিক্ত দল-প্রীতির কারণে ফেসবুকে যেসব মল্লযুদ্ধ হয় তা। এটা লঙ্কাকা- ছাড়িয়ে যায়। মুখের মধ্যে কুৎসিত শব্দভাণ্ডারের কত বড় মাল্টি-ন্যাশানাল চেইন-শপ আছে, তা তখন বুঝা যায়। আদি-পিতা আদম এবং আদি-মাতা হাওয়া পৃথিবীতে আসার পর মানবসমাজে যত প্রকারের অশ্রাব্য কথা বা কটূক্তির অপসৃষ্টি হয়েছে, তার সবগুলি এখানে প্রাধান্য পায়। বিশ্বাস না হলে ইন্টারনেটে ভেসে বেড়ানো এমন দুচারটে পোস্ট বা ভিডিও খুলে দেখুন, কত প্রকারের দ্বিমুখী গালাগালির তীর ছোড়াছুড়ি চলে সেখানে তার প্রমাণ পাবেন।
তবে একটা কথা সত্য যে, যাদুর আয়নার জন্য এখন চুপিচুপি কিছু করা প্রায় অসম্ভব। অতীতকালে এমন ছবি তুলে আর খবর শেয়ার করে তোলপাড় তোলার সুযোগ ছিল না ! ছবি তুলে মন্তর পড়ে একটা ফুঁ দিয়ে সাত সমুদ্দুর পার করা যেত না। আগেকার দিনে একদিন একটা খবর একটা-দুটো কাগজে উঠলে বা টিভিতে দেখালে দুই-একদিন তার রেশ থাকতো। যাদের হাতে যাদু-বিনাশী তাবিজ থাকতো, তারা উল্টো- দিকে কড়ি-চালান দিয়ে দিত, সব হই-চই যেতো থেমে। এখন যাদুর আয়না সব ভাইরাল করে দেয়। সপ্তাহ ধরে, মাস ধরে ছবি, ভিডিও বা খবর ভেসে বেড়ায়। কুমিরের বাচ্চা হজম করতে পারা শেয়ালদের জন্য তাই একটু কঠিন হয়েছে। লেখাপড়া না শিখিয়ে নদীর ঘাটে গিয়ে কুমিরকে এসে বলা কঠিন যে, দেখো বাপু, তোমার ছেলে শিক্ষিত হয়ে মানুষ হয়ে চাকরি-বাকরি করে খাচ্ছে, আমার পাটশালায় নেই। যাদুর আয়না খুঁজে খুঁজে কুমিরের বাচ্চাদের হাড়ের ছবি তুলে কুমির-মাতাকে দেখিয়ে শেয়ালের ঘুম হারাম করে দেয়। দেশে বসে না পারলে, বিদেশে বসে চ্যানেল খুলে যাদুর আয়না এসব দেখিয়ে দেয় । ওদিকে শেয়ালও বসে থাকে না, তারও পালটা চ্যানেল আছে। কথা দিয়ে কথা কাটাকাটি, ছবি দিয়ে ছবি কাটাকাটি খেলা চলে। সাবাস তোমাকে যাদুর আয়না! কত খেলা দেখালে যে তুমি!
(গাজী মিজানুর রহমান, সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট ও লেখক )