অনলাইন

মধ্যযুগের মুসলমান জিরিয়াব ইউরোপের শিক্ষক!

রিফাত আহমেদ

২০২১-০৪-১২

পৃথিবীর ইতিহাসে কালে কালে যত যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়, তার অধিকাংশ যুদ্ধ-সংঘাতের পেছনে ধর্মীয় কারণ মূখ্য হয়ে ওঠে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোও পেশীশক্তি, বুদ্ধিশক্তি এবং অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান হয়ে টিকিয়ে রেখেছিল নিজেদের অস্তিত্ব। অন্যথায় ধ্বংসের তান্ডবে হারিয়ে যেতে হয়েছে তাদের, সৃষ্টি হয়েছে নতুন সভ্যতার, নতুন সংস্কৃতির। বিভিন্ন সময়ে নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব মানবজাতির মাঝে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা ভুলিয়ে স্নিগ্ধ প্রাণের সঞ্চার ঘটায়।
কালের পরিক্রমায় দেখা যায়, পৃথিবীর উপর কখনো আর্যদের, কখনো খ্রিস্টান কিংবা কখনো মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

মোটামুটি ধারণা করা হয় যে, সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু হয় মুসলমানদের বিজয় যাত্রা। তারা পৃথিবীতে
বিভিন্ন ধাপে ধাপে আধিপত্য বিস্তার করে, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল কারণ ছিল তাদের ভৌগোলিক অবস্থান। তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউরোপসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে যায়। এই দীর্ঘ পরিভ্রমণকালে তাদের মধ্যে ঐসব অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি প্রভৃতি নিজেদের মধ্যে ধারণ করার প্রবণতা দেখা যায়। ঠিক ওই সময়কালের একজন প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আজ বলবো।

তিনি হলেন নবম শতকের আরব পলিম্যাথ; যার প্রকৃত নাম আবুল হাসান আলী ইবনে নাফি।তবে তার সুমধুর কন্ঠের জন্য তিনি "জিরিয়াব" তথা কৃষ্ণকোকিল নামেই বেশি পরিচিত। তিনি যে কেবল সুন্দর কন্ঠের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তা নয়; বরং তার অবদান আজও বর্তমান বিশ্বের ফ্যাশন ডিজাইন, সংগীত, কবিতা, গ্যাস্ট্রোনমি, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জ্বলজ্বল করছে।

জিরিয়াবের জন্ম আনুমানিক ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে, বর্তমান ইরাকের বাগদাদে খলিফা হারুন-উর-রশীদের সময়কালে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, জিরিয়াব আফ্রিকান অথবা কুর্দি বংশোদ্ভূত কৃতদাস ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। সেই সময় বাগদাদ ছিল বিজ্ঞান, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। খলিফা ছিলেন সঙ্গীতের অনুরাগী। তার সভার প্রধান শিল্পী ছিলেন ইসহাক-আল-মৌসুলি। আর জিরিয়াব ছিলেন ইসহাকেরই শিষ্য। জিরিয়াব ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান। তিনি শীঘ্রই সঙ্গীত প্রতিভায় নিজ গুরুকেও ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেন।

একবার খলিফার দরবারে জিরিয়াবের ডাক পড়ে। খলিফা তাকে ইসহাকের গিটারজাতীয় বাদ্যযন্ত্র "উদ" বাজিয়ে গান শোনাতে বললে জিরিয়াব তার নিজের তৈরি আরো উন্নত মানের এবং নিখুঁত সুর তৈরিতে সক্ষম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নিজের লেখা এবং সুর করা একটি গান পরিবেশন করেন।
খলিফা তার গান শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। কিন্তু একইসাথে তা তার গুরু ইসহাককে ক্ষুব্ধ করে।কারণ জিরিয়াব নিজের লেখা, সুর করা এবং বাদ্যযন্ত্র তৈরির প্রতিভার কথা তার কাছে গোপন করেছিলেন। এছাড়াও খলিফার প্রতিক্রিয়া দেখে ইসহাক বেশ বুঝতে পারছিলেন যে তার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে জিরিয়াবের জন্য। তাই ঈর্ষা এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে গুরু ইসহাক তার শিষ্যকে বাগদাদ ছাড়তে বাধ্য করেন।

বাগদাদ ছাড়ার পর জিরিয়াব তিউনিসিয়া হয়ে স্পেনের আন্দালুসিয়ার দিকে যান। সেখানে তিনি রাজদরবারে প্রধান সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত হন।ধীরে ধীরে তিনি আন্দালুসের সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সেখানে কর্দোভাতে তিনি একটি গানের স্কুল নির্মাণ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজও স্কুলটি বিশ্বের সবার জন্য উন্মুক্ত গানের স্কুল হিসেবে পরিচিত।

জিরিয়াব অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। প্রায় দশ হাজার গান তার মুখস্থ ছিল। তিনি 'নুবা' নামক এক আন্দানুসীয় সঙ্গীতের সুরের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক সুরের মিশ্রণ ঘটান যা আজও সেখানে অনুসরণ করা হয়। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতোই ২৪ ঘন্টার উপযোগী ২৪ টি 'নুবা' সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের চার্চের মিউজিককে জিরিয়াবের এই নুবাগুলো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বর্তমানে এই সঙ্গীত ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক নামে সকলের কাছে পরিচিত। আর বর্তমানের স্প্যানিশ গিটার তারই তৈরি বাদ্যযন্ত্র উদের পরিবর্তিত রূপ। তার এইসব সাফল্যের কারণে তাকে স্পেনের ইসলামিক সঙ্গীতের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
তবে শুধু গানই নয়, তার হস্তক্ষেপ ছিল স্পেনের ফ্যাশন, হেয়ারস্টাইল, লাইফস্টাইলের উপরও। তাছাড়া ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যাসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়ও তার ছিল দক্ষ পদচারণা। তিনি ছিলেন তার সময়ের তুলনায় কয়েক শতাব্দী এগিয়ে থাকা একজন সত্যিকার বিদ্বান। তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ইউরোপে দাবা খেলার প্রচলন করেন।

সেই সময় স্পেনে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো নিয়মকানুন মানা হত না। জিরিয়াবই প্রথম ফরাসিদের থ্রি-কোর্স মিল বা তিন ধাপে খাবার প্রচলন করেন। প্রথমে স্যুপ, তারপর মেইন ডিশ (মাছ বা মাংস), সবশেষে মিষ্টিজাতীয় খাবার। এই নিয়ম পরবর্তীতে ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, তিনি ডাইনিং টেবিলের সাথে চামড়ার চেয়ার, টেবিল ক্লথ ও কাচের গ্লাসের ব্যবহার শুরু করেন। তার উদ্ভাবিত আসপ্যারাগাস বা শতমূলী আজও জনপ্রিয়। ধারণা করা হয়, জনপ্রিয় খাবার জিলাপিও তার সৃষ্টি।

জিরিয়াবকে বলা হয় আধুনিক ফ্যাশনের প্রবর্তক। আগে যখন শুধু গরমকালে ও শীতকালে ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরার প্রচলন ছিল, সেখানে তিনি নানা ঋতুতে নানা রকম পোশাকের ফ্যাশন চালু করেন।শুধু ভিন্ন ধরনের পোশাকই নয়, সেইসব পোশাকের রং ও তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। যেমনঃ গ্রীষ্মকালের জন্য সাদা রঙের মসৃণ পোশাক, বসন্তকালের জন্য উজ্জ্বল রঙের সিল্ক কাপড়, আর শীতকালের জন্য চালু করেন গাঢ় রঙের উলের পোশাক। পরবর্তীতে তা ইউরোপের ফ্যাশন বলে পরিচিতি পায়।

কাপড় পরিষ্কার করতে লবণ ও পারঅক্সাইডের দ্রবণের ব্যবহার, দাঁত পরিষ্কার করার টুথপেষ্ট, শরীরের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য ডিওডোরেন্ট স্প্রে ইত্যাদি তারই সৃষ্টি। পুরুষদের জন্য তিনি কান, গলা এবং কপাল উন্মুক্ত রেখে ছোট করে চুল ছাঁটার এবং শেভ করার স্টাইল চালু করেছিলেন।আর নারীদের সৌন্দর্যবর্ধনেও তার প্রতিভার অভিনব প্রতিফলন ঘটে। মেয়েদের লম্বা চুল কান অনাবৃত করে ছোট করার ফ্যাশন তার হাত ধরেই এসেছে। নারীদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিউটি পার্লার এবং কসমেটোলজি স্কুল।

তাছাড়া তার আবিষ্কৃত বিভিন্ন সুগন্ধি ও পরিষ্কার পোশাক পরার প্রচলন মেয়েদেরকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল সেই সময়ে।
জিরিয়াবের মতো বহুমুখী প্রতিভা এবং পান্ডিত্যের অধিকারী এবং সমাজ ও মানুষের জীবনধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করা মানুষের সংখ্যা ইতিহাসে বিরল। এমন নয় যে, জিরিয়াবের সবকিছুই সম্পূর্ণ তার নিজস্ব আবিষ্কার। বরং তিনি বাগদাদ ও আন্দালুসের সংস্কৃতির সমন্বয় করে এবং সেগুলোর উন্নয়ন ঘটিয়ে সেইসব সংস্কৃতিতে যোগ করেছিলেন এক নতুন মাত্রা।

তার মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে ইউরোপের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন আন্দালুসে ছুটে আসতো, আর যাওয়ার সময় নিয়ে যেত জিরিয়াবের চালু করা অভিনব জীবনযাত্রা।

স্বাভাবিক ভাবেই জিরিয়াবের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রবল সমালোচনাও ছিল। কিন্তু কর্দোভার আমির দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকার কারণে কোনো সমালোচনা এবং বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত পাত্তা পায় নি। ৮৫২ সালে আমিরের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, ৬৮বছর বয়সে জিরিয়াব পরলোক গমন করেন। আমাদের জন্য রেখে যান তার অমর সব কীর্তি। তিনি চির অম্লান হয়ে আছেন তার তৈরি জীবনধারা, ফ্যাশন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাঝে।

আসলে তখনকার সময়ে যে জ্ঞানের বিপ্লব হয়েছিল, সেই জ্ঞানের বিপ্লব থেকে আমরা দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছি। আর হারিয়ে যাচ্ছি বলেই আবার নতুন করে বিবাদ, ধর্মে ধর্মে সংঘাত, সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণিবৈষম্য; যা এইসব বুদ্ধিদীপ্ত মানুষজন মীমাংসা করে গিয়েছিলেন, তা নতুন করে ক্ষত হয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হচ্ছে।
সুতরাং এই চরিত্রগুলোকে নিয়ে আমাদের গবেষণা করে চরিত্রগুলোর ভালো দিক সমূহ নিয়ে চিন্তা করে যুদ্ধ- সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ছেড়ে পৃথিবীতে আবার মঙ্গলময় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।

[লেখকঃ চেয়ারপারসন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ইতিহাস, বিজ্ঞান নিয়ে লেখা staycurioussis.com (বাংলা এবং ইংলিশ) ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা]
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status