ভেপিং অধূমপায়ীদের জন্য নয়, বরং ধূমপায়ীদের মধ্যে যারা আসক্তি ছেড়ে তুলনামূলক সুস্থ জীবন-যাপনে আগ্রহী কেবল তাদের জন্য। বৈশ্বিক বিভিন্ন গবেষণাতেও ভেপিংকে ধূমপানা ছাড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এসব বিশ্লেষণ, উপাত্ত আমলে না নিয়ে বাংলাদেশে কেবল ধারণার ওপর নির্ভর করে ভেপিংয় নিয়ে এক চেটিয়া পদক্ষেপে উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ভেপিং বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশে তামাক এবং তামাকজাত পণ্যের ক্ষতি হ্রাসের উদ্যোগকেই বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উচিত হবে বিবেচনাপ্রসূতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া, যাতে ভেপিংকে নীতিমালার মধ্যে আনা যায় এবং ধূমপানের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমানো যায়। বাংলাদেশে সম্প্রতি ১৫৩ জন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত একটি চিঠিতে দেশে ভেপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছেন। অথচ দেশে প্রচলিত সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এনাম মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মিথুন আলমগীর বলেন, বৈশ্বিক নানা গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, প্রচলিতি ধূমপানের তুলনায় ভেপিংয়ে ক্ষতির হার অনেক কম।
আর ধূমপান বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক মৃত্যু ঘটায়। এমন প্রেক্ষাপটে, প্রচলিত সিগারেট বন্ধের সুপারিশ না করে ভেপিং বন্ধের সুপারিশ অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
ভেপিং নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রতিনিয়তই গবেষণা হচ্ছে। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর প্রভাব নিয়ে কোনো গবেষণার উদ্যোগই নেয়া হয়নি। এসব গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে এমপিদের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেপিং প্রচলিত সিগারেট থেকে কম ক্ষতিকর। এটির ব্যবহার সহজলভ্য হলে, সেটা অনেক মানুষকে ধূমপান থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবে। আর বাংলাদেশে কোনো গবেষণা ছাড়াই এমপিদের উল্লেখযোগ্য অংশ ভেপিং নিষিদ্ধের সুপারিশ করে বসলেন। ভেপিং নিয়ে শঙ্কা ব্যক্ত করতে গিয়ে এক এমপি বলেছেন, ভেপিংয়ের মধ্যে যেসব রাসায়নিক বের হয়, সেটি তামাকের চেয়েও নাকি বেশি ক্ষতিকর। অথচ ২০১৫ সালে পাবলিক হেলথ অব ইংল্যান্ড তাদের সবচেয়ে সাড়া জাগানো গবেষণায় দেখেছে, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় ই-সিগারেট ৯৫ ভাগ কম ক্ষতিকর।
যুক্তরাজ্যের পাবলিক হেলথ অব ইংল্যান্ডের (পিএইচই) স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালক জন নিউটন বলেন, ২০১৭ সালে প্রায় ৫০ হাজার ধূমপায়ী ভেপিংয়ের সহায়তায় ধূমপান সফলভাবে ধূমপান ছেড়েছেন। ২০২০ সালে সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, ভেপিংকে ধূমপান ছাড়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গেল বছর ইংল্যান্ডে ধূমপান ছেড়েছেন এমন ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ ২৭ দশমিক দুই শতাংশ ভেপিংয়ের সহায়তা নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভেপিং নিয়ে কোনো পদক্ষেপের আগে এসব গবেষণা ও উপাত্ত আমলে নেওয়া দরকার ছিল বলে মত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মিথুন আলমগীরের। ভোক্তারদের পছন্দ নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া-ভিত্তিক কনজুমার চয়েস সেন্টার। তারা ৬১ দেশের ভেপিং ওপর একটি গবেষণা করেছে। গেল বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংগঠনটি বলছে, যুক্তরাজ্যের পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভেপিংকে উৎসাহিত করা হলে বাংলাদেশে ৬২ লাখের বেশি ধূমপায়ী প্রচলিত সিগারেট ছেড়ে ভেপিংয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। গবেষণাগুলো আমলে না নিয়ে অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভেপিং নিষিদ্ধ করা হলে নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অনেকে ফের প্রচলিত ধূমপানে ঝুঁকে পড়বেন।
মিথুন আলমগীরের মতে, ভেপিং নিয়ে হুট করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে, বরং বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একচেটিয়া পদক্ষেপে ভেপিং বন্ধ না করে বরং নিম্ন মানের ভেপিং পণ্য এবং ভেপিং লিকুইড যাতে দেশের বাজারে আসতে না পারে সে দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।