× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

চি‌কিৎক‌দের হেনস্তা নয়

অনলাইন

ডাঃ কাওসার আলম
(৩ বছর আগে) এপ্রিল ১৯, ২০২১, সোমবার, ৫:৩৫ অপরাহ্ন

গতবছর ঠিক এইসময় করোনার প্রকোপ বেড়ে চলছিল । সারা পৃথিবীতে নেমেছি‌লো বিপর্যয়। ইতালিতে তখন প্রতিদিনে ৪০০/৫০০ মানুষ মারা যাচ্ছে।মানুষ মারা যাচ্ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কিন্তু মৃত্যুর অন্তঃর্নিহিত কারণ কি কেউ জানেনা। চারদিকে আতংক আর মৃত্যু ভয়। লকডাউন দেওয়া হয়েছে সারা দেশজুড়ে । বিজ্ঞানীরা জানেনা, গবেষকরা জানেনা, ভাইরোলজিস্টরা জানেনা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে। নতুন এই ভাইরাস ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসকদেরও সম্যক ধারণা ছিলনা ।সবাই জানে মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখতে হবে, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। এসব নিয়েও নানা মুনির নানা মত।
কেউ বলে করোনা গ্রীষ্মের দাবদাহে মারা যাবে, কেউ বলে করোনা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যাবে। কেউ বলে চিকিৎসকদের পিপিই লাগবেনা, কেউ বলে পিপিই ছাড়া চলবেই না। এসব অনিশ্চয়তার মধ্যেই তখন সবাই ঘুরপাক খাচ্ছে। খোদ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একবার বলে শুধু করোনা রোগীরা মাস্ক পরিধান করলেই হবে, সাধারণ মানুষের মাস্ক পরার কোন প্রয়োজনীয়তা নাই । সকালে বলে এক কথা, বিকালে বলে আরেক কথা। সিডিসি একবার বলে শুধু ড্রপলেটের মাধ্যমে করোনা ছড়ায়, আবার একদিন পর বলে করোনা বাতাসে ছড়ায়। এভাবেই অনিশ্চয়তা ও অজানার মধ্যেই চলতে থাকে সবার অভিযাত্রা। করোনা ভাইরাস তো রোগী, ডাক্তার, ধনী, গরিব আলাদা করতে পারেনা। তাই রোগী থেকে চিকিৎসক যেমন আক্রান্ত হতে পারে ঠিক তেমনি চিকিৎসক থেকেও রোগীদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই ইমারজেন্সী চিকিৎসা সেবা ছাড়া সকল প্রাইভেট চেম্বার ঐসময় বন্ধ করা হল।

তখন প্রশাসন কি করল?  সকল প্রাইভেট হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে কোন চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বার করছে না, কার চেম্বারে তালা ঝুলছে তা খুজে খুঁজে তার লিস্ট করলো। যেসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চেম্বার করছে না তাদের রীতিমতো হেনস্তা করা শুরু করল। অনেক সাহসী, মানবিক চিকিৎসকরা তখন অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে ঢাল তলোয়ার ছাড়াই যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, ফলশ্রুতিতে কয়েক মাসের মধ্য প্রায় একশত জন চিকিৎসককে হারালাম। জাতি হারিয়েছে তার অমূল্য চিকিৎসকদের, আমরা হারিয়েছি আমাদের শিক্ষক আমাদের গুরুজনদের আর স্বজনরা হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনদের। একটি অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আগে অবশ্যই তার গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হয়। শুধু পেশিশক্তি দিয়ে বা সৈনিকের সংখ্যা দিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। যুদ্ধে জয়লাভের প্রধান অস্ত্র কৌশল। সেই কৌশলের রপ্ত করার জন্য চিকিৎসকরা কিছুদিন অপেক্ষা করছিল। তখন চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে এবং প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিল। অপ্রয়োজ‌নে হাসপাতালে আসা বন্ধ করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। একজন চিকিৎসক বেঁচে থাকলে শত শত রোগীদের বাঁচাতে সক্ষম হবে। এটাই যুদ্ধকালীন সময়ে অমোঘ সত্য ও চরম কঠিন বাস্তবতা।

দ্বিতীয় লকডাউন। এবার চিকিৎসকরা প্রস্তুত। প্রাইভেট চেম্বার করতে যাচ্ছে, নিজেদের ডিউটিতে যাচ্ছে। কিন্তু এবারের লকডাউনটা ব্যতিক্রম। চিকিৎসকরা প্রাইভেট চেম্বারে যাচ্ছে সেখানে তাদের গাড়ি আটকে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি চিকিৎসকরা তাদের কর্মস্থলে যাবে সেখানে মুভমেন্ট পাশের নামে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তাররা জনগণের সেবা করতে যায়, সরকারি কাজ করতে যায় সেখানে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাহলে কি এইবারের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসকদের সেবা ছাড়াই সুস্থ হয়ে যাবেন? প্রথম লকডাউনে চিকিৎসকদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে প্রাইভেট চেম্বার করিয়েছেন, সংক্রমণের চেইন দীর্ঘ করেছেন আর এইবার লকডাউনে চিকিৎসকদের সরকারি হাসপাতালে ডিউটি করতে দিতে চাচ্ছেন না। কারণটা কি এখনো বোধগম্য হচ্ছে না?
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার এ্যাপ্রোনে দেশের সর্বোচ্চ মেডিক্যাল বিদ্যাপীঠের লোগো অংকিত আছে, তার গাড়িতে প্রতিষ্ঠানের লোগো আছে। সে নিজে পরিচয় দিয়েছে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাকে আপনারা আইডি কার্ডের দোহাই দিয়ে আটকে রেখেছেন। একজন চিকিৎসক এই করোনা মহামারীতে তার নিজের জীবন, পরিবারের সবার জীবনবাজি রেখে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে যায়। তার চলাচলে রাষ্ট্র কখনো বাধা দিতে পারেনা, রাষ্ট্র তার চলাচল নির্বিঘ্নে করার নিশ্চয়তা দিবে। যুদ্ধাবস্থায় একজন চিকিৎসকের গতিরোধ করার নিয়ম নেই, আর আপনারা পরিচয় পাওয়ার পরেও আদিখ্যেতা আর পেশাগত দম্ভ দেখানোর জন্য তার গতিরোধ করেছেন। একজন মুমূর্ষু রোগী যখন অক্সিজেনের অভাবে কাতরাতে থাকে তখন চিকিৎসক নিজের জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে রোগীর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দেয়। যখন মরণাপন্ন রোগীকে ফেলে রোগীর স্বজনরা পালিয়ে যায়, তখনো একজন চিকিৎসক সেই রোগীর পাশে থাকে। মহামারীর এই পরিস্থিতিতে ও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসকরা সবচেয়ে সম্মুখ সারীর যোদ্ধা।চিকিৎসক ছাড়া বাকি সব ক্যাডার কোভিড পরিস্থিতিতে প্রণোদনা পেয়েছে, ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, সুযোগ সুবিধা পেয়েছে।চিকিৎসক কি পেয়েছে? কিছুই পায়নি। একজন চিকিৎসক সেবা করেন দায়িত্ববোধ থেকে, মানবিকতা থেকে, দেশপ্রেম থেকে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় সে সেবার ব্রত নিয়ে এই পেশায় আসে না। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের উচিত ডাক্তারদের গাড়ি দেখে তাদের স্যালুট দেওয়া। তাদের চলার পথ মসৃণ করা। তাদের নিরাপদে হাসপাতালে পৌছে দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করা। এই স্যালুট দেওয়া মানে পুলিশের ছোট হয়ে যাওয়া নয়, এই স্যালুট দেওয়া মানে চিকিৎসক বড় হয়ে যাওয়া নয়। এই স্যালুট দেওয়া মানে আপনি চিকিৎসকদের কাজে উৎসাহ প্রদান করছেন, পরোক্ষভাবে জনগণের সেবা করছেন।
আমরা সবাই বাঙালি, আমরা সবাই এদেশের নাগরিক, আর সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা সবাই মানুষ। একজন চিকিৎসক যেমন চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে জনগণের সেবা করেন ঠিক তেমনি পুলিশ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণের সেবা দিয়ে থাকেন।

এই ক্রান্তিকালে একজন কোভিড যোদ্ধাকে ডিমোরালাইজড করা মানে এই যুদ্ধে অনেক পিছিয়ে যাওয়া। আমরা সবাই মিলে এই যুদ্ধে জয়ী হবো। চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, প্রশাসন সবাই মিলে আমাদের এই যুদ্ধে জয় লাভ করতে হবে। আবার আলো আসবে। অমানিশার কালো অন্ধকার যতই গভীর হোক, আবার পৃথিবী হাসবেই।


লেখক
ডাঃ কাওসার আলম
মেডিক্যাল অফিসার ও রেসিডেন্ট
কার্ডিওলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর