× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আইসিইউ বঞ্চিত মায়ের মৃত্যু, মোহন রায়হানের কান্না

প্রথম পাতা

স্টাফ রিপোর্টার
২০ এপ্রিল ২০২১, মঙ্গলবার

আমার মা’কে কি আমি বাঁচাতে পারবো না? মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। শ্বাস নিতে পারছেন না। আমার মা মাহমুদা খাতুন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আইসিইউতে নয়, চিকিৎসাধীন আছেন পিসিসিইউতে। তার অক্সিজেন সেচ্যুরেশন ৬৫ থেকে ৭০-এ উঠানামা করছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, এখনই তাকে আইসিইউতে না নিলে মা’কে বাঁচানো যাবে না। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর জন্য আইসিইউ’র ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমার জীবনের বিনিময়ে কেউ কি আমার মা’কে একটি আইসিইউ বেড দিতে পারেন? করোনা আক্রান্ত মায়ের জন্য আইসিইউ  চেয়ে এভাবেই ফেসবুকে আকুতি জানিয়েছিলেন কবি মোহন রায়হান। পিসিসিইউতে’ই মোহন রায়হানের মায়ের মৃত্যু হয়।
আইসিইউ সেবাবঞ্চিত মায়ের মৃত্যুর পর আবেগঘন এক স্ট্যাটাসে বিস্তারিত জানিয়েছেন মোহন রায়হান। মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে তিনি জানিয়েছেন, মায়ের জন্য আইসিইউ না পাওয়ার আক্ষেপ তাকে আজীবন কুরে কুরে খাবে। এই কষ্ট নিয়েই তাকে থাকতে হবে। মোহন রায়হানের মা মাহমুদা খাতুনের মৃত্যুর খবরে তার ছোট বোনও মারা যান একই দিনে।

মা এবং খালার মৃত্যুর বিষয়ে মানবজমিন-এর সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় কবি মোহন রায়হানের। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কবি মোহন রায়হান। তিনি বলেন, দুনিয়াতে মায়ের জন্য অনেক চেষ্টা করেও একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে পারিনি। হাসপাতালে বঞ্চিত মা, কবরে এখন শান্তির আইসিইউতে ঘুমিয়ে আছেন। এই কবি বলেন, গত ৩রা এপ্রিল করোনা টেস্টে মায়ের পজিটিভ রিপোর্ট আসে। অথচ এর আগে মা যদি করোনা আক্রান্ত হয় সেই ভয়ে নিজের বাসায় সকল আত্মীয় স্বজনদের আসতে নিষেধ করা হয়। করোনা পজিটিভ হওয়ার পরে মায়ের শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে অনেক চেষ্টা করে বন্ধুদের সহায়তায় রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আমার মা যে ক’দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, বেডে শুয়ে বারবার নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানাতেন। শেষ মুহূর্তেও আমার হাত ধরে ওই একটি আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করেছিলেন তিনি- ‘আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে’। তিনি বলেন, মায়ের হাতে ক্যানুলার কালসিটে দাগ দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। এদিকে ঢাকা মেডিকেলে এক চিকিৎসক বন্ধুর সহায়তায় যোগাযোগ করলে সেখানে আমাদের আইসিইউ বেড দেয়ার কথা বলা হয়। মা’কে হাসপাতালে ভর্তির পরও আমি জেনেছি মা’কে আইসিইউ বেডে রাখা হয়েছে। কিন্তু যখন মায়ের শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে যাচ্ছিল তখন সেখানে থাকা একজন ডিউটিরত চিকিৎসক জানান, পিসিসিইউতে থাকা অক্সিজেন সাপোর্ট তার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তার অক্সিজেন সেচুরেশন ৬৫-৭০ এ উঠানামা করছে। তাকে যতদ্রুত সম্ভব আইসিইউতে স্থানান্তর করতে হবে। এ কথা শুনে যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ, আমিতো জানতাম মা‘কে আইসিইউতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নিজে স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এর আগে আমার পিসিসিইউ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা ছিল না। মায়ের কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, মা, তুমি ক্ষমা করো তোমার এই অযোগ্য সন্তানকে। একটি আইসিইউ’র জন্য আমি যখন একবার ঢাকা মেডিকেলের ইনচার্জের রুম, আরেকবার পরিচালকের রুমে দৌড়ে ছুটে বেড়িয়েছি।  মায়ের সেই করুণ আকুতির বিস্ফোরিত চোখ ছাড়া আমার সামনে আর কোনো দৃশ্য ছিল না। অবশেষে সেই মা’কে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছি, কিন্তু হৃদস্পন্দনহীন নীরব নিথর চির ঘুমের নিস্তব্ধতায়। তাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছি। কিন্তু আমার চোখের সামনে স্থির হয়ে আছে সেই দৃশ্য, যেখান থেকে আমার আর বেরোনোর উপায় নেই। তিনি বলেন, আমার বাবা ফরহাদ হোসেন সিরাজগঞ্জের খোকসাবাড়ি ইউনিয়নে দীর্ঘদিন ধরে ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও আমৃত্যু মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। একইভাবে আমার মা আশপাশের এলাকার সব মানুষের সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সঙ্গী ও ভরসা ছিলেন। সেই মা কিনা এখন শহরের একটি হাসপাতালের হিমঘরে। জাগতিক সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যিনি সারাক্ষণ স্রষ্টার ইবাদতে নিবেদিত এক অসীম অসামপ্রদায়িক মানুষ আমার মা। পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, ঘৃণা নয়, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের ফারাক না করে কেবলই ভালবেসেছেন মানুষকে। মোহন রায়হান বলেন, আমার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তাকে শেষবারের মতো দেখতে আসার পথে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ছোট খালা সেলিনা খাতুন। পরবর্তীতে তাদের দু’বোনকে একই কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়। আমার সেই হাসপাতালের আইসিইউ বঞ্চিত মা, কবরের চিরশান্তির আইসিইউতে ঘুমিয়ে এখন।

গত শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মাহমুদা খাতুনের মৃত্যু হয়। গত ৩রা এপ্রিল মাহমুদা খাতুনের নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাস পজিটিভ আসে। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ১৬ই এপ্রিল তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

সিরাজগঞ্জের খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বড় ছেলে প্রয়াত মাহমুদ আলম মধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে রৌমারী ক্যাম্প কমান্ডার ও স্বর্ণপদকজয়ী জাতীয় ক্রীড়াবিদ। তার দ্বিতীয় ছেলে কবি মোহন রায়হান। মাহমুদা খাতুন পাঁচ ছেলে ও তিন কন্যার জননী। সিরাজগঞ্জ দিয়ারপাচিল ঈদগাহ্‌ মাঠে জানাজা শেষে খলিসাকুড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর