রক্তে ‘মুড ডিজঅর্ডার’ সংশ্লিষ্ট ‘বায়োমার্কার’ পর্যবেক্ষণ করতে ব্যবহার শুরু হয়েছে নতুন একটি পদ্ধতি। আর তার মাধ্যমেই মানুষের বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও ম্যানিয়ার মতো অন্যান্য মেজাজ-সংশ্লিষ্ট ব্যাধির মাত্রা সনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। আর এর ফলে এই ধরণের মানসিক জটিলতার চিকিৎসায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়েই রোগ শনাক্ত ও মাত্রা পরিমাপ করার কাজ শুরু হবে। সম্প্রতি মেডিক্যাল সাময়িকী মলিউকুলার সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটা জানান বিজ্ঞানীরা। এ খবর দিয়েছে সায়েন্স এলার্ট।
খবরে বলা হয়, নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রোগীর রক্তে ২৬টি বায়োমার্কার চিহ্নিত করেছেন যেগুলো বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও ম্যানিয়াসহ বিভিন্ন মুড ডিজঅর্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উল্লেখ্য, বায়োমার্কারের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে রোগ সনাক্ত করা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, মানবদেহের তাপমাত্রা বিবেচনা করে জ্বর নির্ণয় করা হয়।
কয়েকশ বছর ধরেই বিষণ্নতাকে রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এ রোগে আক্রান্ত কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু এই ব্যাধি সনাক্ত করার কোনো সুনির্দিষ্ট মেডিক্যাল পদ্ধতি নেই। চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট ও সাইকিয়াট্রিস্টরা বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল মূল্যায়নের মাধ্যমে এটি নির্ণয় করে থাকেন। গবেষকরা বলছেন, রক্ত পরীক্ষা এসব স্বাস্থ্য মূল্যায়নে সহায়ক হতে পারে। পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা যেতে পারে, বিষণ্ণতার উপসর্গগুলো পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা। তবে এসব মূল্যায়ন বস্তুনিষ্ঠ ও স্বতন্ত্রভাবে বিষণ্নতা নির্ণয় করতে ক্লিনিক্যাল চর্চায় ব্যবহৃত হয় না। তবে নতুন গবেষণা বলছে, ভবিষ্যতে রক্ত পরীক্ষাকেও বিষণ্ণতা সনাক্তে ও মাত্রা পরিমাপে ব্যবহার করা সম্ভব।
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রিস্ট ও নিউরোসায়েন্টিস্ট আলেকজান্ডার বি নিকুলেসকু বলেন, যেসব ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব বক্তব্য বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মীর ক্লিনিক্যাল মূল্যায়ন সবসময় নির্ভরযোগ্য হয় না, সেগুলোর ক্ষেত্রে রক্তের বায়োমার্কারগুলো গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
নিকুলেসকু বেশ কয়েক বছর ধরে এই বিষয়ে গবেষণা করছেন। রোগীদের আত্মহত্যার প্রবণতা নির্ধারণ, তীব্র ব্যথা নির্ণয়, এবং পিটিএসডি-র মাত্রা নির্ণয় করতে রক্তের বায়োমার্কার-ভিত্তিক পরীক্ষা করেছেন। নিকুলেসকু বলেন, এই রক্ত পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে প্রত্যেক রোগীর জন্য যথোপযুক্ত ও সুনির্দিষ্ট ওষুধ নির্ধারণের পথ সুগম হয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে বিষন্নতা দূরীকরণে চিকিৎসাপদ্ধতির কার্যকারিতাও বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ মিলতে পারে।
নতুন গবেষণাটি করা হয়েছে চার বছর ধরে। গবেষকরা ইন্ডিয়ানাপোলিসের রিচার্ড এল. রৌদেবুশ ভিএ মেডিকেল সেন্টারে কয়েক শতাধিক রোগীকে নিয়ে কাজ করেছেন। মুড ডিজঅর্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, রক্তে জিনের বিকাশ সংশ্লিষ্ট এমন বায়োমার্কার সনাক্ত ও নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা চালান।
পরীক্ষার প্রতি সেশনে গবেষণায় অংশ নেওয়া হতাশায় ভোগা রোগীদের মেজাজের মাত্রার (নিম্ন থেকে উচ্চ) হিসাব রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছে। ওই নমুনাগুলো মানব জেনেটিক্স, জিন বিকাশ ও প্রোটিনের বিকাশ সম্পর্কিত ১৬০০টি গবেষণার উপাত্তের সঙ্গে তুলনা করে গবেষকরা মুড ডিজঅর্ডারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৬টি বায়োমার্কার সনাক্ত করেছেন।
পরবর্তীতে, এই বায়োমার্কারগুলো বিষণ্ণতা ও ম্যানিয়ার মতো মুড ডিজঅর্ডার সনাক্ত করতে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা তা নির্ধারণ করতে কার্যকর কিনা তা নিশ্চিত করতে আরও একদল রোগীর উপর পরীক্ষা চালান। সবশেষে গবেষকরা জানান, মোট ১২টি বায়োমার্কারের সঙ্গে বিষণ্ণতার, ছয়টির সঙ্গে বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও দুইটির সঙ্গে ম্যানিয়ার জোরালো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
গবেষকরা জানান, তাদের এই পদ্ধতিতে বিষণ্নতার ও মেজাজ-সংশ্লিষ্ট ব্যাধীর প্রবণতা সনাক্ত করা সম্ভব নয়। তবে এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে কী কী ওষুধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে তা নির্ধারণ করা সম্ভব। একইসঙ্গে বিদ্যমান অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট বা বিষণ্নতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি ওষুধের ব্যবহার নিয়ে আরো চিন্তাভাবনা করা উচিৎ বলেও তারা মত দিয়েছেন।