কথা বা কাজের মাধ্যমে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করা হলে তাকে বলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড । সেভাবে মানুষ যা দেখতে বা শুনতে অভ্যস্ত নয়, তাদেরকে তা জোর করে দেখানো বা শুনানো একটা সন্ত্রাস। আমাদের দেশে এখন যেভাবে বক্তব্য-সন্ত্রাস বা ভিডিও-সন্ত্রাস চলছে, তাকে অন্য প্রকৃতির সন্ত্রাসের চেয়ে কমকিছু বলা যায় না। বড় ডাকাতের নাম কিনতে আগে মানুষকে অনেক অপেক্ষা করতে হতো! আর আজ, একটা-দুটো ভিডিও ছেড়ে শব্দ-ডাকাত হয়ে রাতারাতি ঘৃণার সিংহাসনে বসে যাচ্ছে কেউ কেউ। ছড়াচ্ছেন ঘৃণা এবং পাচ্ছেন ঘৃণা।তবু তাদের পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে, মানুষ তাদের চিনছে এটাই যেন তাদের কাছে বিরাট পাওয়া। কিন্তু তারা ক্ষতি করছে দেশ এবং সমাজের। ভব্যতা এবং শালীনতার সীমা লংঘন করে এমন সব শব্দের এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হচ্ছে, যা দেখে বাইরের দেশের মানুষের মনে হতে পারে, বাংলা ভাষা বুঝি এরকম অচ্ছুত শব্দ দিয়ে গালাগালির পৃষ্ঠপোষকতা করে!
ইউটিউব ভিডিও, ফেসবুক ভিডিও, ফেসবুক লাইভ, ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারিত এমন কিছু জঘন্য নষ্টামির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রায়ই। যারা গালাগালি ভুলে গিয়েছিলেন, তাদের আবার সেসব শুনে শিখতে হচ্ছে।
অতিসম্প্রতি ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে এবং ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে এমন কয়েকটি ভিডিও দর্শকদের উদ্দেশ্যে ছাড়া হয়েছে যা সকলকে মর্মাহত করেছে। কোনো কোনো পুরুষ যখন নারীদের গালাগালি করেন তখন কুরুচিপূর্ণ এমন এমন শব্দ অবলীলায় মুখ দিয়ে বের করেন, যা রীতিমত ভয়ঙ্কর। আবার কোনো মহিলা পোস্টদাতা আছেন, যারা নারী সমাজের একজন হয়েও যে ভাবে নিজেদের অংগ প্রত্যঙ্গ নিয়ে জঘন্য ভাষায় কথা বলেন, তা শুনে দর্শকদের আক্কেলগুড়ুম হয়ে যায়। মুখের মধুর ভাষাকে যে কি প্রকারের জঘন্য রূপ দেয়া যায়, এসব না দেখলে বা না শুনলে তা বিশ্বাস করা যায় না। এসব ভিডিও বা পোস্ট বা পোস্টের উপর মন্তব্য মুছে না ফেলা অবধি অন্তর্জালে তারা ঘুরে বেড়ায়।
জঘন্য শব্দ ব্যবহারের একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। অতিরিক্ত ক্ষুব্ধ হলে মানুষ প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে চায়, শক্তি প্রদর্শন করে। সে শক্তি হতে পারে শারীরিক, নয় তো মৌখিক। এটা হতে পারে ব্যক্তিগত বা সামাজিক শক্তি। সড়কে সড়কে ভাংচুর একরকম দলবদ্ধ সামাজিক শক্তি। সেক্ষেত্রে কটূক্তি-সন্ত্রাস হচ্ছে ক্ষোভ প্রকাশের মৌখিক শক্তির বুনো প্রদর্শনী। আবার কিছু শক্তির মহড়া আছে জেন্ডারগত— আক্রমণকারী নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন, একটা জেন্ডারের সবল স্থানে দাঁড়িয়ে অন্য জেন্ডারের দুর্বলতায় আঘাত করে। পুরুষ কটুক্তিকারীরা বেছে বেছে নারীর দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। নারীরা এই কটূক্তি-সন্ত্রাসের শিকার হয় বেশি । অন্যদিকে, নারী আক্রমণকারী অপর একজন নারীকে অন্য জেন্ডারের মানুষের দ্বারা অপমানিত বলে গালি দিয়ে খোটা দেয়। আবার পুরুষের প্রতি নারীর কটূক্তি সমূহের বেশিরভাগ স্থান দখল করে নিম্নতর প্রাণীর নাম। এসব কটূক্তি আগে মহল্লাবাসীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। ইন্টারনেটের কল্যানে কটূক্তি এখন বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে।
কটূক্তি করে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক কারণ হচ্ছে, নিজেকে বেশি জ্ঞানী আর অন্যকে কম জ্ঞানী, কম বুদ্ধিমান ভাবা। কিছু মানুষের মধ্যে হঠাৎ করে অহমিকা সৃষ্টি হয়। অহমিকা থেকে কটূক্তি জন্ম নিয়ে তা জীবনাচরণে প্রভাব বিস্তার করে। কটূক্তির আধিক্যের আর একটা কারণ হচ্ছে যে, আমাদের সমাজে ন্যায়বিচারের ঘাটতি, প্রতারণা এবং বঞ্চনার মাত্রা বেশি হওয়ার ফলে মানুষ সবসময় একপ্রকার ক্ষুব্ধ হয়েই থাকে। ক্ষুব্ধ থাকে বলেই প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় ভাষার শালীনতা ভঙ্গ করে, বিশ্রী-কুশ্রী শব্দ ব্যবহার করে বেশি। উন্নত সমাজে এই বঞ্চনা, বিশৃঙ্খলা, নৈতিক অধঃপতন কম তাই তারা অর্ধ-উন্নত সমাজের মত এত বেশি ক্ষুব্ধ হয় না, আর মুখ দিয়ে এত বেশি বাজে শব্দ ব্যবহার করে না। তাদের মুখের ভাষা তাই শালীনতার বেড়া ভাঙ্গে কম ।
কটূক্তি-সন্ত্রাসের চৌহদ্দি এত বড় হয়ে গেছে যে, অধিক শোকে পাথর হওয়ার মত অবস্থা হয়েছে। কত রকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়েছে যে, এদের এক-একটা এক-একবার হামলে পড়ে, আব্রু সামলে রাখা দায় হয়! মানহানিকর কথা, অশুভ অঙ্গভঙ্গি, সামাজিকভাবে হেয়করণ-ক্রিয়া এসবের প্রতিকার হিসেবে দেশে আইন আছে। কিন্তু তার প্রয়োগে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আবার আক্রমণকারী অনেক সময় দূরদেশ থেকে কটূক্তি-সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কখোনো তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যদি দেশে আসেন, তখন অন্যেরা তাদের টিকির দেখা পাবে, অন্যথায় নয়। তাই এসবের কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিকার নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হর্তাকর্তা যারা এগুলি মুছবে, তারা বাংলা ভাষা হয়তো ভালো করে জানে না। সেই সুবাদে এদের সরব উপস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হয় ।
এই যে রোজ এত গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে, এর ফলন কিন্তু দিনদিন বাড়ছে । সেনসর বোর্ড নেই, সম্পাদক নেই– যা আপলোড করবে, তাই সুপার হিট সিনেমা । অন্যদিকে দেখতে দেখতে চোখ সওয়া হয়ে যাওয়া সমাজেরও মানুষেরও ভয় আছে নিন্দামন্দ করে নিষেধ করতে গেলে যদি কাপড় খুলে দেখিয়ে দেয়? ওরা নিজের কাপড় খুলে প্রতিপক্ষকে দেখাতে পারবে, কিন্তু এরা পারবে না। বাবা-মায়ের শিক্ষা, স্কুল-কলেজে শিক্ষদের উপদেশ তাদেরকে বলে, দুর্জনের সাথে সুবচন দিয়ে লড়াই করা যাবে না। তাই নিজের মান নিজের কাছে জমা রেখে তারা মনে মনে প্রার্থনা করেন, ওদের সুমতি হোক ।
(গাজী মিজানুর রহমান সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট এবং লেখক)