× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

রিকশাচালকদের দুর্দিন

এক্সক্লুসিভ

স্টাফ রিপোর্টার
২৩ এপ্রিল ২০২১, শুক্রবার
সংগৃহীত

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে যাত্রীর অপেক্ষায় রিকশাচালক মো. কামাল হোসেন। রাজধানীর ধানমণ্ডি লেক সংলগ্ন এ এলাকায় অন্যান্য রিকশাচালকরা যাত্রীর জন্য হাঁকডাক পাড়লেও তিনি নীরব। তার কাছে যেতেই বললেন, কই যাবেন? শ্যামলীর ভাড়া ৫০ টাকা বলাতেই রাজি হলেন। যেখানে অন্যান্য রিকশাচালকরা ৭০ টাকাতেও রাজি হননি। আলাপচারিতায় জানা যায়, নীলক্ষেতের ব্রাদার্স পাবলিকেশন্সে কাজ করতেন তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকেই বইয়ের ব্যবসায় ধস। মাঝে কিছুদিন ব্যবসা চললেও তা আগের মতো নেই। পরিবার নিয়ে আর চলতে পারছেন না তিনি।
বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন নভেম্বরে। থাকতেন মোহাম্মদপুরের লোহার গেইট এলাকায়। বাড়ি ভাড়া তিন হাজার টাকা। বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আর মেয়ে ছোট। আয় কমে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি ভোলায় পাঠিয়ে দেন। এখন তিনি একটি রুম ভাড়া নিয়ে দু’জন মিলে থাকেন। ভাড়া দিতে হয় ৮০০ টাকা। কোনো রকম চলছিলো সংসার। কিন্তু দ্বিতীয় দফা লকডাউনে আর পারছেন না সংসার চালাতে। এবার বাধ্য হয়ে প্যাডেলে পা দিয়েছেন।

কামাল হোসেন বলেন, আর পারি নারে ভাই। ক’দিন আর এভাবে থাকা যায়। ভাড়াও পাই না। চালাইতেও পারি না বেশি সময় ধরে। পায়ে টান পড়ে। এরমধ্যে আবার পুলিশের যন্ত্রণা। কয়দিন আগে একটা ভাড়া লইয়া যাইতাছি। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে আটকাইলো। রিকশার সিট আটকাইয়া রাইখা কি এক বিপদে পড়লাম। আমাগো কয়েকজনের সিট নিয়া রাখলো কিন্তু কোনো বড় গাড়িরে চেকও করলো না। দুই ঘণ্টা আটকাইয়া রাইখা তারপর ছাড়লো রিকশা।

সারা দেশে বিধিনিষেধের মধ্যে চলছে মানুষের জীবনযাত্রা। বাধ্য হয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির ঢল। তবে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর রিকশা চালকরা। বিধিভঙ্গ করে রাস্তায় বের হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হচ্ছে তাদের।

লকডাউনের এই সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে রিকশা-ভ্যান উল্টে রাখা হয়েছে। মূল সড়কে গেলেই শাস্তি স্বরূপ ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হচ্ছে রিকশা ও ভ্যানচালকদের। তবে অনেককে আবার ছেড়েও দেয়া হচ্ছে। আটকে রাখা রিকশাচালকদের দাবি, সড়কে সব ধরনের গাড়ি চলছে। পণ্যবাহী অনেক পিকআপও চলছে। অথচ তাদেরকে নির্বিঘ্নে চলতে দেয়া হলেও রিকশা-ভ্যানচালকদের হয়রানি করছে পুলিশ। সব গাড়ি চললেও শুধু রিকশা কেন উল্টে রাখা হয়?

সরজমিন রাজধানীর কয়েকটি মোড়ে বেশকিছু রিকশা আটকে রাখতে দেখা যায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ফার্মগেট গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছেন। কিন্তু গতিরোধ করা হচ্ছে রিকশা ও ভ্যানকে। এ সময় ফার্মগেট মোড়ে অন্তত ৮-১০টি রিকশা ও একটি ভ্যানকে আটকে রাখা হয়। তাদের মধ্যে একজন আমির হোসেন। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমারে ১ ঘণ্টা ধইরা আটকে রাখা হইছে। সারাদিন পর একটা খ্যাপ পাইলাম। কাওরান বাজার থাইকা মিরপুরে মুদি দোকানের চাল নিয়ে যাইতে ছিলাম। ফার্মগেটে আসলেই আমার গাড়ি ধইরা মালপত্র ফেলায় দিয়া গাড়ি উল্টাইয়া দেয়। অনেক অনুনয় বিনয় কইরা কইলাম স্যার সারাদিন পর একটা খ্যাপ পাইছি একটু যাইতে দেন। কিন্তু কোনোমতেই তাদের মন গলে না। কি করুম কন? আমাগো গরিবের কথা কে শুনবো? রাস্তায় বড় লোকেরা পাশ লয়া চলতেছে। তাহলে আমরা কি করুম। কামকাজ না করলে বাঁচুম কেমনে। বউ বাচ্চাগো খাওয়ামু কি?

বিজয় সরণি মোড়ে ৩টি রিকশা উল্টে রাখতে দেখা যায়। আব্বাস আলী নামের প্রায় ষাটোর্ধ্ব বয়সী এক রিকশাচালক বলেন, রাস্তায় মানুষ কম। যারাই বের হয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। এ অবস্থায় আমরা রিকশা দিয়ে মাল বহন শুরু করছি। কাওরান বাজার থেকে ৬০ ফিট যাচ্ছিলাম। রাস্তা ফাঁকা তাই এই পথে আসছি। এখন পুলিশ আমাকে আধা ঘণ্টা ধরে আটকে রাখছে। মাফ চাইছি তবুও ছাড়তেছে না। রাস্তায় তো বাস বাদে সব গাড়িই চলতেছে। আর পুলিশ খালি আমগো ধরতেছে।

মিরপুর ১৪ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত ৩টি চেকপোস্টে পথচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায় পুলিশকে। এ সময় বিভিন্ন জায়গায় রিকশা উল্টে রেখে চালকদের শাস্তির চিত্র চোখে পড়ে। দুপুরে মিরপুর ১০ নম্বরের পাশের গলিতে কিছু রিকশা উল্টে রাখে পুলিশ। রিকশাচালক শামসুল বলেন, এই রিকশা আটকে রাখার আইন কই পাইছে পুলিশ? গাড়ি চলতেছে রোডে, তাদের তো ধরতে পারে না।

খালি রিকশাওয়ালার লগে পারে। ঘরে যে থাকমু খামু কি? সরকার এতো সাহায্য সহযোগিতা বলে করে আমরা তো পাই না। রাস্তায় বের না হইলে পরিবার নিয়া কি মরে যাবো? এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে উল্টিয়ে রাখা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলেন মন্টু মিয়া। বয়স আনুমানিক ৫০। তিনি আরো বলেন, বাড়িতে টাকা পাঠাইতে পারতেছি না। পোলা মাইয়া খাইয়া না খাইয়া আছে। সেদিন বাকি কইরা পাঁচশ’ টাকা পাঠাইছি এই দিয়া কয়টা চাল-ডাল খাইয়া আছে।

এই ধারের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন? কীভাবে সংসার চালাবেন এই চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। এরপর ফের বলেন, গত তিনদিন ধইরা চারটা মুড়ি খাইয়া রোজা থাকি। শেষ রাইতে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাই। তাও বাড়িতে টাকা পাঠাইতে পারতাছি না।

পান্থপথ গ্যাস্ট্রোলিভার গলির বস্তিতে থাকেন রিকশাচালক মিলন মিয়া। তিনি বলেন, এমনেই শহরে লোক নাই। ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করণ লাগে। দূরের বড় ভাড়াও পাওয়া যায় মাঝে মধ্যে। আগে যে ভাড়া আছিল ১০০ টাকা সেই ভাড়া এখন ৬০/৭০ টাকায় যাওন লাগে। রিকশা বেশি ফের লোকও কম। আর যদি রিকশা আটকায় তাইলে তো ১০০/১৫০ টাকা গেল। আবার রিকশার জন্য ১/২ ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকা লাগে। আগে সারাদিনে ৫০০/৬০০ টাকা আয় হইতো, এখন সারাদিন ঘুইরাও ২৫০/৩০০ টাকা হয় না।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর