× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩১) /‘সালাহউদ্দিন-ফালু দুজনই নির্যাতনের কথা আমাকে জানালো’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৪ এপ্রিল ২০২১, শনিবার

শুক্রবার ২৯ জুন ২০০৭ দিন ৭৮
একদিকে আমার সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে এবং অন্যদিকে আমার সব ফাইল, রেকর্ডপত্র, দলিল ইত্যাদি যৌথবাহিনীর সদস্যরা ১৩ এপ্রিলের মাঝরাতে আমার চেম্বার থেকে জব্দ করে নিয়ে গেছে। এর জন্য আদালতের কোনো নির্দেশনামা তাদের কাছে ছিল না কিংবা জব্দ করা জিনিসপত্রের বিপরীতে কোনো জব্দ তালিকা তৈরি করে ওরা আমাকে দেয়নি। একাউন্ট ফ্রিজ করায় ব্যাংক থেকেও আমাকে কোনো হিসাব বিবরণী দেয়া হচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমাকে বলা হচ্ছে, সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে এবং জেলখানায় বসে আমার সম্পদ, দায়দেনা ও আয় বিবরণী বানিয়ে ওদের কাছে পেশ করতে। এ পরিস্থিতিতে আমি কোনো ভুল করলে আমাকে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইনের ২৬ (২) ধারাবলে তিন বছরের জন্য কারাদ-ও দেয়া হতে পারে। ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া ও সুবিচারের কি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! এ হলো হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কাউকে পানিতে সাঁতরানোর আদেশ দেয়ারই শামিল।
এ বয়সে এ ধরনের যাতনা, নির্যাতন, অপমান ও অপদস্থতার চাইতে মৃত্যুই বোধহয় আরো বেশি শান্তিপূর্ণ ও যন্ত্রণানাশক হতে পারতো। তবে আল্লাহ্র ইচ্ছায় এর সবকিছু আমি মেনে নিয়েছি। তিনি মহান, দয়ালু ও শ্রেষ্ঠতম সম্মানের অধিকারী।
হয়তো আমার জীবন বাঁচানোর জন্যই মহান আল্লাহ আমার ভাগ্যে এই কারাবরণ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

শনিবার ৩০ জুন ২০০৭ দিন ৭৯
যৌথবাহিনী এখনো আমার ব্যক্তিগত স্টাফ শহীদের পেছনে লেগে আছে। গত পরশুদিন ওরা শহীদের বাড়ির ওপর চড়াও হয়েছিল। গতকাল কদর্য ভাষায় ওকে গালাগালি করে তিনদিনের মধ্যে ওদের কাছে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ওর ধারণা এবার ওকে তারা মেরে ফেলবে। গতবার ওর ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য শহীদকে ভারতে যেতে হয়েছিল। এভাবে পরিস্থিতি পৌঁছে যাচ্ছে এক বিপজ্জনক পর্যায়ে। ওর ওপর এই নির্যাতন এবং প্রতিশোধস্পৃহার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। কি তার অপরাধ? ওরা কি সত্যিই মনুষ্যপদবাচ্য?
এক সপ্তাহেরও বেশি সময়ের জন্য যৌথবাহিনীর হাতে রিমান্ডে থাকাকালে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহকারী এবং আস্থাভাজন মোসাদ্দেক আলী ফালুকে অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার ও নানা রকমের নির্যাতন করা হয়েছে। আজ রিমান্ড থেকে মুক্ত করে তাকে পাঠানো হয়েছে জেলখানায়। সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিনের ওপরও একই ধরনের আচরণ করা হয়েছে। ও দেখতে এসেছিল আমাকে এখানে। দু’জনই সব জানালো।
বাইরে যা ঘটছে আমাকে দেখতে আসা দর্শনার্থীরা সে সম্পর্কে প্রায়ই নিত্যনতুন ও তরতাজা খবর নিয়ে আসে। চেম্বারের ফরিদ ও শহীদুল্লাহকে নিয়ে আমার ভাই শাকের এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার ব্যাপারে ওদেরকে খুবই উদ্বিগ্ন বলে মনে হলো।

রবিবার ১ জুলাই ২০০৭ দিন ৮০
সারা দিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে। ছাদের ছিদ্র দিয়ে মৃদু টুপ টুপ শব্দে একটা তাল মিলিয়ে আমার ঘরের মধ্যে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির পানি। ব্যাঘাত জন্মাচ্ছে আমার কাজকর্মে। জিয়াউদ্দিনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ছাদ থেকে পড়া পানি বিভিন্ন পাত্রে সংরক্ষণ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রয়াস চলছে।
দিনে ১০ থেকে ১২ বার চলে যায় বিদ্যুৎ সংযোগ। জেনারেটর কাজ করে রাতে। কাজেই বিদ্যুতের সঙ্গে সঙ্গে পানিরও অভাব। কি দুর্ভোগ?
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। আজ কাঁচামরিচের দাম বেড়ে হয়েছে প্রতি কেজি ১০০ টাকা। অবিশ্বাস্য! সাধারণত এর দাম থাকে ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে।
সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা একই বিষয়ের ওপর কথা বলছেন ভিন্ন ভিন্ন সুরে। অসংলগ্ন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন কমিশনকে একটি হাস্যাস্পদ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তুলেছেন। রাজনৈতিক শূন্যতা এখনো অব্যাহত রয়ে গেছে ।

সোমবার ২ জুলাই ২০০৭ দিন ৮১
আমার মামলার ব্যাপারে এডভোকেট শহিদুল্লাহ ও আমার ‘ল’ ক্লার্ক ফরিদের কাছে গত পরশুদিন ভিজিটিং আওয়ারে আমি যে ড্রাফট দিয়েছিলাম, জেলগেটে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা তা জব্দ করেছিল। অর্থাৎ আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো অধিকার নেই। ওদেরকে প্রায় একঘণ্টা ধরে সার্চ করে নানাভাবে অপমানিতও করা হয়েছে। যাই হোক, আমি কোর্ট থেকে ফিরে আসার পর জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তর্কাতর্কির ফলে শেষ পর্যন্ত আমি সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি।
বিএনপিতে মান্নান ভূঁইয়ার মতো আওয়ামী লীগে আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক,  তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দলে সংস্কার নিয়ে আসার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শেখ হাসিনাকে দল থেকে বিতাড়িত করার অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলেও এদের প্রত্যেকের কৌশল ও অভিব্যক্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। সেনাপ্রধানের নিযুক্ত সেনা অফিসাররা এদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
গত পরশুদিন, ৩০ জুন আব্দুর রাজ্জাক তার সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন। আজ ঘোষণা দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ।

মঙ্গলবার ৩ জুলাই ২০০৭ দিন ৮২
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুন, যিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, ১০ বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। তবে টাকা আত্মসাতের জন্য তাকে সাজা দেয়া হয়নি- তার সাজা হয়েছে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে। কি আশ্চর্য্য!
দুর্নীতির মামলা এখন টাকা আদায় ও চাঁদাবাজির মামলায় পরিণত হয়েছে। কমিশন যেসব দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছে তার মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ ব্যক্তিগত পর্যায়ে চাঁদাবাজির অভিযোগসংক্রান্ত এবং এর সঙ্গে সরকারি অর্থ বা সরকারি তহবিলের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এমনকি হাসিনার বিরুদ্ধে শেষ দায়েরকৃত মামলার মধ্যেও দু’টি মামলা চাঁদাবাজিসংক্রান্ত- যা নিতান্তই হাস্যকর। এরচেয়ে বেশি অপদস্থকর ব্যাপার হলো কোনো কোনো মামলায় রাজনীতিবিদদের স্ত্রীদেরও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এর আগে রাজনীতিবিদদের ওপর যখন আঘাত করা হয়েছে তখন কোনো অবস্থাতেই তাদের দুর্নীতির সঙ্গে স্ত্রী বা পরিবারকে জড়িত করা হয়নি। এবার এই প্রথমবারের মতো নির্যাতন, অত্যাচার ও অপদস্থতার হাত পরিবারের সদস্যদের ওপর পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এমন কমপক্ষে ৩৬টি মামলায় স্ত্রী-সন্তানকে অভিযুক্ত বা সহ-অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ টুকুকে অভিযুক্ত করার সময় তার স্ত্রী ও পুত্রের পাশাপাশি তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অবিবাহিতা কন্যাকেও অভিযুক্ত করে পিতামাতার সঙ্গে জেলখানায় আবদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের অসুস্থ, অমানবিক ও অনিয়ন্ত্রিত, লক্ষ্যবিহীন কাজকর্ম একজনকে মানসিকভাবে কতখানি পর্যুদস্ত করতে পারে তা নিরূপণ করতে একজন বড় মাপের মানসিক বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন ।

বুধবার ৪ জুলাই ২০০৭ দিন ৮৩
শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে এফিডেভিট দিয়ে মামলা করার অনুমোদনসহ সুপ্রিম কোর্টের নোটিশ জেল কর্তৃপক্ষ আমার কাছে হস্তান্তর করেছেন। এটা নিয়ে আমি কোর্টে যাওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে আনীত অ্যালকোহলের মামলা ১০ জুলাই পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
সাবেক একজন প্রতিমন্ত্রী মীর নাছির উদ্দীনকে দুর্নীতির দায়ে ১৩ বছর এবং তার ছেলে ব্যারিস্টার হেলালকে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। কমিশন আইনের এমন অপব্যবহার করেছে যে, দুর্নীতি দমন আইনের ২৬ ও ২৭ নং ধারার আওতায় দায়েরকৃত এসব মামলার সাজা সুপ্রিম কোর্টে কোনো অবস্থাতেই টিকতে পারে না। মীর নাছির যখন তার মামলার রায় শোনার পর কাঁদছিল, আমি তাকে এ নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করেছি। আইনমন্ত্রী হিসেবে এ আইনের একজন প্রণেতা হিসেবে আমি মামলা দায়েরের সময় ওরা কীভাবে এই আইনের অপব্যবহার করেছে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছি। যেভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়েছে এবং ক্যাঙ্গারু কোর্টে যেভাবে রায় দেওয়া হয়েছে তার স্পষ্ট চিত্রও আমি দেখেছি। এগুলো কোনোটাই শেষ পর্যন্ত টিকবে না।
আজ আমি দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছ থেকে সম্পদের বিবরণী দাখিল নোটিশ পেয়েছি এবং এর ফলাফল কী হবে সহজেই তা অনুমান করতে পারি। প্রমাণ থাকুক আর না থাকুক আমার জন্য নির্ধারিত রয়েছে ১৩ বছরের জেল। এ বিচার প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। পরবর্তীকালে অবশ্য হাইকোর্টের আপিলে মীর নাছির ও তার পুত্র উভয়েই খালাস পেয়েছেন। আমি যা বলেছিলাম তা-ই হয়েছে।

(চলবে..)

আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) 
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২০)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২১)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২২)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৩)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৪)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৫)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৬)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৭)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৮)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৯)
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩০)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর