মঙ্গলবার ১০ জুলাই ২০০৭ দিন ৮৯অ্যালকোহল মামলায় সরকারের পরাজয়ের কারণে আমার ওপর ক্রোধ ও আক্রমণের ধারা তীব্রতর হয়েছে। আমার সমস্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইতিমধ্যেই ফ্রীজ করার পরেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আজ হাসনা, আমান, আনা ও আমার আইন প্রতিষ্ঠান এবং মূলত আমার পয়সায় পরিচালিত হাসনার চেয়ারম্যানশিপের অধীনস্থ দুটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ অন্যান্য বিবরণী দাখিল করার জন্য সংবাদপত্র মারফত নোটিশ জারি করেছে- যা হলো চরিত্রহননের আরেকটি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা মাত্র। হাসনা, আমান এবং আনার ব্যাংক স্টেটমেন্ট সম্পর্কে সমস্ত তথ্য কর্তৃপক্ষের স্পষ্টতই জানা রয়েছে। ওদের নামে যেখানে যে ব্যাংকে যত টাকাই জমা রয়েছে তার সবই হলো আমার টাকা। কয়েকটি এফডিআর বা স্থায়ী বিনিয়োগ সম্পর্কে তারা একথা জানতেন যে, আমি কোনো তথ্য গোপন রাখিনি এবং ইনকাম ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে আমি নিজে সই করে আমার রিটার্ন দাখিল করেছি ।
এ মুহূর্তে সরকার তাদের নোংরা খেলায় আমার স্ত্রী ও সন্তানদের জড়িত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে হাসনার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। আত্মস্বার্থবিহীন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নিবেদিতপ্রাণ একজন পরিবেশবিদ হিসাবে দেশের জন্য, দেশের ভেতরে ও বাইরে সমুদ্রপৃষ্টের উষ্ণতাবৃদ্ধির আশঙ্কায় উপকূল এলাকাসমূহের পক্ষে সচেতনতা সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীর অনাগত দুর্যোগকে বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করার মহান ব্রত নিয়ে কর্মশীলা এই নারীকে কেবলমাত্র আমার মতো একজন রাজনীতিবিদের স্ত্রী হওয়ার কারণে এখন অশেষ নির্যাতন ও অপদস্থতার শিকার হতে হচ্ছে। দেশকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার জন্য এটাই কি যোগ্য প্রতিদান?
আমার বোন নাফিসা এবং ভাগ্নি খুবি আদালতে হাজির ছিল।
সুপ্রীম কোর্টের আদেশ এখনো ট্রায়াল কোর্টে এসে পৌঁছেনি। যত বেশিদিন লাগবে আমার জন্য ততই ভালো। আমি আমার পাণ্ডুলিপিকে ততদিনে ফার্মের সচিব অশোক বাবুর কাছে টাইপ করার জন্য পাঠাতে পারবো এবং সাথে সাথে ভুল সংশোধনের জন্য টাইপ করা কিছু কপি ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে পারবো। আমার অফিসের নিবেদিত একজন কর্মী আমির হোসেন প্রথম থেকেই এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালন করে আসছে।
বুধবার ১১ জুলাই ২০০৭ দিন ৯০যৌথবাহিনী ও টাস্কফোর্সের অত্যাচার, নির্যাতন ও বেআইনি কার্যকলাপের বিবরণী এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে দিনে দিনে আরো প্রকাশিত হচ্ছে। ব্যাপক ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সংবাদপত্রগুলো কোনো না কোনো উপায়ে কিছু কিছু খবর প্রকাশ করে দিচ্ছে। যৌথবাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করে শেখ হাসিনাও ক্রমশ এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। সরকারের কোনো কোনো মহল সেগুলো অস্বীকার করছেন আবার কোনো কোনো মহল থেকে এ বিষয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে অজ্ঞতা। অথচ এসব ঘটনা ঘটে চলেছে প্রায় প্রতিদিনই। একজন ক্ষমতাধর মার্কিন কংগ্রেস সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইসের কাছে হাসিনার জন্য লেখা এক চিঠিতে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এর আগে হিলারী ক্লিনটন ও এডোয়ার্ড কেনেডিসহ মার্কিন সিনেটরবৃন্দ ও ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স ও লর্ডসের সদস্যদের বিবৃতি ছাড়াও কানাডা পার্লামেন্টের ৫১ জন সদস্য ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যবৃন্দ একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
একমাত্র রাজনীতিই দেশের চলমান সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। তবে সে সুদিন কবে আসবে তা কেউ জানে না।
বৃহস্পতিবার ১২ জুলাই ২০০৭ দিন ৯১‘ল’ চেম্বারে আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহকারী, প্রায় দুই দশক ধরে আমার সাথে কাজ করা এডভোকেট আজিজুল হক আর আদালতে আমার পক্ষে সমর্থন করতে আসছেন না। তিনি কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত নন এবং তার ওপর বহুলাংশে নির্ভর করছিলাম আমি। যৌথবাহিনীর সদস্যরা তার পেছনে লেগেছে। ওরা আজিজের সাথে দেখা করে ওদের অফিসে ডেকে নিয়ে গেছেন এবং তাকে হুমকি দিয়েছে। তার পরিবারবর্গসহ তিনি এখন দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কের মধ্যে। তারা কেবল আজিজকে আমার জন্য কাজ করা থেকে বিরত রাখতেই চাইছে না, উপরন্তু চাপ দিচ্ছে তিনি যেন আমার বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী হন। ঠিক এমনটি তারা করেছিল শহীদের বেলায়। জেলে আটকে যে কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষ সমর্থনকারী আইনজীবীর সাথে ঠিক এ ধরনেরই আচরণ করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার খোকনকে অনবরত গোয়েন্দা বাহিনীর নজরদারিতে রেখে প্রতিনিয়ত তাকে হুমকি ও ধমক দেয়া হচ্ছে। এর আগে আমরা একদলীয় শাসনব্যবস্থা দেখেছি। আমরা দেখেছি স্বাধীনতার পরে দুটি সামরিক শাসন, পাকিস্তান আমলে আরো দুটি সামরিক শাসন। কিন্তু এ ধরনের অমানুষিক বর্বরতা ও আচরণ কখনো দেখিনি। এদের মধ্যে। রয়েছে ঘৃণাবোধ, ধ্বংসাত্মক ও অন্যায় মানসিকতা এবং প্রতিশোধ স্পৃহার এক অসাধারণ সমন্বয়।
অনেক রকমের লাঞ্ছনা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সংগ্রহ করে আমার কয়েকজন আত্মীয় আমার সাথে দেখা করতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র আধঘণ্টার জন্য হলেও ওদের সাহচর্য ছিল আমার জন্য সত্যি আনন্দময়।
শুক্রবার ১৩ জুলাই ২০০৭ দিন ৯২আজ জেলখানায় বন্দী হিসাবে আমার তিন মাস পূর্ণ হলো। মনে হচ্ছে এমনি করে একদিন তিনটি বছরও কেটে যাবে। সময় দ্রুতই বয়ে যায়।
২০০৭ সালের ৪ জুন সরকারের জারিকৃত একটি প্রজ্ঞাপন অনুসারে আমি আগে ঘোষণা করা হয়নি এমন আইনানুগ আয়ের ট্যাক্স হিসাবে আমার ব্যাংক থেকে ৪ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য অনুমোদন দিয়ে ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের বরাবরে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তা ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে অস্বীকার করেছে। আমি এ ব্যাপারে ডিআইজি হায়দারের সাথে কথা বলতে চেয়েও কোনো সাড়া পাইনি। ওদের কাছে না হলেও আমার জন্য বিষয়টি ছিল অত্যন্ত জরুরি।
শনিবার ১৪ জুলাই ২০০৭ দিন ৯৩দৈনিক ইত্তেফাকের তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছোট্ট একটা খবর ছাপা হয়েছে। অন্য সময় হলে সংবাদটি ছয় কলামে বড় অক্ষরে লাল কালিতে ছাপা হতো। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার বলেছে গত ছয় মাসে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের হাতে ১১৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি ৩৬ ঘণ্টায় খুন হয়েছে একজন মানুষ। এই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ লক্ষ ৮৬ হাজার জনকে। অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১৬ শত জনকে। এমতাবস্থায় দেশে গণতন্ত্র থাকলে এ নিয়ে চার দিকে উঠতো প্রতিবাদের ঝড়, সিভিল সোসাইটি ব্যস্ত থাকতো সেমিনারে, পেশাদার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ইস্যু করা হতো কড়া বিবৃতি, বিদেশী বন্ধুপ্রতিম সংগঠনসমূহ ও কূটনীতিকরা এসবের প্রতিকার চেয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, টিভি চ্যানেলগুলো ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটাছুটি করতো তাদের টকশোর আয়ােজনে, সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হতো সম্পাদকীয় এবং বিরোধী দল হয়তো সরকারকে বিব্রত করার জন্য একটা হরতালই ডেকে বসতো। কিন্তু এর কোনোটাই ঘটেনি। সরকারের বিব্রত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদও উত্থাপিত হয়নি।
এছাড়া দেশব্যাপী কৃষকেরা সারের দাবিতে উপজেলা অফিসগুলোকে ঘেরাও করে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। বিবিসি গতরাতে চলমান পরিস্থিতির ওপর সুদীর্ঘ একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। সততা ও সাহসের জন্য আমি আতাউস সামাদকে ধন্যবাদ জানাই। অবশ্য সংবাদপত্রে তেমন কোনো ধরনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রবিবার ১৫ জুলাই ২০০৭ দিন ৯৪নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে এবং সরকার তার লাগাম টেনে ধরতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এ নিয়ে সেনাবাহিনী, বিডিআর, স্ক্যাব ও পুলিশ বসিয়েও কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের তীব সংকটও অব্যাহত রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার পৌঁছেছে প্রায় ৯ শতাংশে।
অন্যদিকে জনগণকে মুখ খুলতে দেওয়া হচ্ছে না। গতকাল ময়মনসিংহে খাদ্যের অভাবে বাবা-মা ও সাত সন্তানসহ পরিবারের ৪ জনের আত্মহত্যার খবরে সরকার একথা বুঝতে পারছেন না যে, মানুষকে অনাহারে রেখে বেশিদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা যায় না।
পসামবার ১৬ জুলাই ২০০৭ দিন ৯৫আজ ভোরবেলা যৌথবাহিনীর একটি বিরাট বহর কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই শেখ হাসিনার বাসভবনে চড়াও হয়ে ৭ ঘণ্টাব্যাপী তল্লাশি চালিয়ে নেত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে। শুধু তাই নয়, বাসভবন থেকে তারা হাসিনার ফাইলপত্র, দলিলাদি, মূল্যবান কাগজপত্র ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি জব্দ করে নিয়ে গেছে। একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়। সেনা সরকার জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাইছে যে, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিলেন। আমার ধারণা, সরকারের এসব কর্মকর্তাদের মতিভ্রম ঘটেছে। এদের প্রত্যেকটি কাজে পাওয়া যাচ্ছে অপরিপক্কতা ও ছেলেমানুষীর ছাপ। এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে চারদিক থেকে প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে, একপর্যায়ে খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হবে এবং ঠিক এর পরপরই দেশের রাজনৈতিক চরিত্র বদলাতে শুরু করবে। এর মাধ্যমে সংস্কারবাদী হিসাবে পরিচিত তথাকথিত দলত্যাগীদের সহায়তায় সরকার তার নগ্ন রাজনৈতিক ভূমিকার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্সজ্জিত করার দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তার স্বরূপ উন্মোচিত করেছে। এই পরিস্থিতি জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে একটি যৌথ আন্দোলন পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করবে।
নির্বাচন কমিশনের ভাড়রা সরকারের জন্য যে রোডম্যাপ দিয়েছেন তা এখন অনেকটা অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছে।
(চলবে..)
আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৯)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২০) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২১) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২২)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৩)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৪)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৭) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৮) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৯) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩০) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩১)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩২)