বুধবার ২২ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩২ঘটনাটি একেবারে একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়ার মতো। গতকাল ২১শে আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট এক জরুরি বৈঠকে ছাত্রদের পুরোপুরি সমর্থন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সর্বসম্মত প্রস্তাবে ছাত্রদের দাবির প্রতি জানিয়েছে সমর্থন। আগ্নেয়গিরির আগুনের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। সকল শ্রেণীর জনগণ জরুরি আইন প্রত্যাহারসহ ছাত্রদের ১৯ দফা দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দাহ করা হয়েছে মঈন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের কুশপুত্তলিকা। রাজশাহীতে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে একজন পুলিশ নিহত হয়েছে, কয়েকজন শিক্ষকসহ আহত হয়েছে প্রায় ৪০০ জন।
সারা দেশে আহত ও গ্রেফতার হয়েছে কয়েক হাজার। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সন্ধ্যা ৮টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়েছে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ছাত্রাবাসগুলো খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকল পর্যায়ে সবরকম পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ২৩ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৩তিনদিন ধরে চলতে থাকা গোলযোগ ও প্রতিক্রিয়া সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট অবৈধ সরকারের প্রতি গভীর গণঅসন্তোষেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এতে আরো প্রমাণিত হয় যে, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক শক্তি সরকারের নেই। গতকাল কারফিউ বলবৎ থাকলেও জনগণ সেনাবাহিনীর একটি যানবাহন পুড়িয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর একজন সদস্যকে বিক্ষোভকারীরা পিটিয়েছে, সেই সময়কার ছবি বের হয়েছে পত্রিকার পাতায়। রাজশাহীতেও ঘটেছে একই ধরনের ঘটনা।
জনগণ ও সেনাবাহিনীর মধ্যেকার এ ধরনের সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলে পক্ষান্তরে বাংলাদেশকে যারা একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান তাদের হাতই শক্তিশালী হবে। খুব সম্ভবত ঘটনাগুলো সংগঠনের পেছনে তাদেরই কোনো অদৃশ্য ইন্ধন রয়েছে।
শুক্রবার ২৪ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৪সকাল-সন্ধ্যা কারফিউর জায়গায় এবার জারি করা হয়েছে ২৪ ঘণ্টার কারফিউ যা স্বাধীনতার পর থেকে মানুষ আর দেখেনি। এ ধরনের কারফিউ শুধু সাধারণ লোকের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকেই ব্যাহত করেনি, সরকারের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষের মাত্রাও বাড়িয়ে তুলেছে। সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় রাজপথে সুরক্ষিত আর্মির যানবাহনের আনাগোনায় পরিস্থিতি আপাতভাবে শান্ত বলে মনে হলেও এর। গণপ্রতিক্রিয়া অনেকদিন পর্যন্ত বহাল থাকবে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ওপর প্রবল নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও যেসব খবর বের হয়ে আসছে তাতে মনে হয় ঘটনা। সবেমাত্র শুরু হয়েছে এবং জনগণ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কেবল প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে ।
শনিবার ২৫ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৫এ ধরনের ব্যাপক গণপ্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরেই আঁচ করা যাবে সরকার কি আশু একটি নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবেন নাকি গায়ের জোরে দমন পীড়নের মাধ্যমে তার স্বৈরশাসন অব্যাহত রাখবেন। জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সেনাবাহিনীর কোনোদিনই ঠিক হবে না এবং তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায় এমন কোনো কর্মতৎপরতার ফাঁদে পা দেওয়া তাদের উচিৎ হবে না। ওরা কি তা বোঝে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ওরা তা বুঝতে পারছে না। ছাত্রদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং ছাত্রীসহ তাদের পেটানো হচ্ছে নির্দয়ভাবে। এখন বিবিসিই হলো আমাদের একমাত্র খবরের উৎস। বিস্তারিতভাবে ওরা সব প্রচার করছে। বেশ কিছু জায়গায় কারফিউ ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হচ্ছে। এর আগে সামরিক এজেন্সির মাঝরাতের এক আকস্মিক অভিযানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন বিশিষ্ট শিক্ষককে ক্যাম্পাসে অবস্থিত তাদের বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ আরো দুজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই ধরনের গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিক্ষক গ্রেফতারের ঘটনা পক্ষান্তরে ছাত্রদের মনোভাবই শুধু কঠোর করে তুলবে না, এ সরকারকে প্রতিহত করতে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রতি জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতিই জোরদার করবে। একটি অবৈধ দুঃশাসক সরকারের শেষ পরিণতি কি হতে পারে তা আমাদের সকলেরই জানা আছে।
রবিবার ২৬ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৬আমার আইনজীবীদের সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানোর পর এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো জবাব আসেনি। আত্মপক্ষ সমর্থনের একটি মৌলিক অধিকার হলো আইনজীবীদের সাথে পরামর্শের অধিকার। সে অধিকার থেকে বঞ্চিত অবস্থায় কীভাবে আমি সুবিচার আশা করতে পারি?
জুলাই মাসের ৫ তারিখে আটকাদেশ দেওয়ার পর প্রায় দেড়মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। আত্মীয়স্বজনেরা আমার সাথে দেখা করার সুযোগ পাননি বললেই চলে। কাজেই নানা রকম গোপন কায়দায় আমি বিভিন্ন সময়ে তাদের কাছে গোপন বার্তা পাঠিয়েছি। কিন্তু সেগুলোর জবাব এসেছে খুব কমই।
প্রায় দু’মাস হাসনা কিংবা আমার সন্তানদের কোনো খোঁজখবর পাইনি। আসমাও আসেনি। তৌফিক কোনোদিনই আসেনি আমার সাথে দেখা করতে। তারা হয় ভয় পাচ্ছে কিংবা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। যৌথবাহিনীর হাত থেকে জান বাঁচাতে গিয়ে শহীদও গত দু’মাস ধরে দেখা দিচ্ছে না। কেবলমাত্র আমার একজন গৃহস্থলী কর্মচারী মুনির এসে প্রতি শনিবার জেলগেটে আমার জন্য কিছু ফলমূল রেখে যায়। আমার সাথে দেখা করার কোনো অনুমতি তার নেই। বেশির ভাগ সময়েই তার রেখে যাওয়া ফলমূল আমার কাছে আসে পরের দিন। আবার কোনো কোনো সময় সেগুলো আসেই না।
কেউ দেখা করতে না এলে বন্দীজীবন আরো বিষণ্নময় হয়ে ওঠে। এতে আমার উদ্বেগ যায় বেড়ে, একাকীত্ব আমাকে গ্রাস করে। প্রায় দুই মাস পরে ডিআইজি হায়দার সিদ্দিকী এসে দেখা করে গেছেন আমার সাথে। অথচ আগে রুটিনমাফিক প্রতি সপ্তাহে তার দেখা পাওয়ার কথা।
সোমবার ২৭ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৭দেশের এখন একরকম লণ্ডভণ্ড অবস্থা। এই লক্ষ্যবিহীন মস্তিষ্কবিহীন সরকারই এর জন্য দায়ী। সমাজের চাকা সচল রাখার শক্তি যারা জোগান, অর্থনীতি ও সামাজিক মুল্যবোধের যারা অতন্দ্র প্রহরী, সমাজের সেই সচেতন প্রত্যেকটি অংশকে সরকার একে একে আক্রমণ করে চলেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও তারা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষক, ছাত্র কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজন কাউকেই ছাড় দেয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে ৪ থেকে ১০ দিনের জন্য রিমান্ডে নিয়ে আরেক দফা নির্যাতন ও অত্যাচার চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ হাজার ছাত্রসহ প্রায় ৪০ হাজার লোকের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ফৌজদারি মামলা। ওরা জানে না কোন ভীমরুলের চাকে হাত দিয়েছে তারা।
মঙ্গলবার ২৮ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৮২০-২২ আগস্ট বিদ্রোহের অভিযোগে সরকারি এজেন্সিগুলো প্রায় এক লাখ লোককে অভিযুক্ত করেছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী প্রায় একলাখ লোক বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে যার মধ্যে ৮২ ভাগ ছাত্র।
এ ধরনের গণঅসন্তোষের প্রকৃত কারণ চিহ্নিত না করে সরকার এখন বলির পাঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে সরকার দোষারোপ করছে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও অসৎ রাজনীতিবিদদের। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অভিযোগ করেছিলেন যে, কতিপয় সুবিধাবাদী অশুভ মহল এর জন্য দায়ী। পর্দার অন্তরালে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এতে ইন্ধন জুগিয়েছে বলে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছেন।
বুধবার ২৯ আগস্ট ২০০৭ দিন ১৩৯আজ পবিত্র শব-ই-বরাত, ভাগ্য নির্ধারণের মহিমাময় রজনী।
গত সোমবার আপিল বিভাগ শক্তিমানের বিরুদ্ধে দুর্বলের, একনায়কত্ববাদী অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে যাতনাদগ্ধ নাগরিকদের সুবিচার পাওয়ার সকল পথ অবরুদ্ধ করে দিয়েছে। প্রথিতযশা ব্রিটিশ বিচারপতি লর্ড ডেনিং-এর সুমহান বাণীর এ এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং তার সম্পদ বিবরণীর পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের নোটিশ সংক্রান্ত দুটি মামলায় জামিনসহ অন্তর্বর্তীকালীন সকল আদেশ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। দুটি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ জামিন দেওয়ার পর আপিল বিভাগ সেগুলো নাকচ করে দিয়েছে। আদালতে এটি ছিল একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এটা দুঃখজনক যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখছে না। একই কারণে নিম্ন আদালতগুলোও সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশের আজ্ঞাবাহী ও অধঃস্তন হিসাবে কাজ করে চলেছে।
(চলবে..)
আরো পড়ুন-
মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৪) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৭)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৮) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৯) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১০) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১১) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১২) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৩) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৪) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৭) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৮) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (১৯)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২০) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২১) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২২)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৩)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৪)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৭) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৮) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (২৯) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩০) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩১)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩২) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৩) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৪) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৫) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৬) মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৭)মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৩৮)