× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

এপির রিপোর্ট /মোদির সক্ষমতার বড় ক্ষতি করেছে করোনা ভাইরাস

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(২ বছর আগে) মে ৫, ২০২১, বুধবার, ১:৪২ অপরাহ্ন

ভারতে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সক্ষমতার বড় ক্ষতি করেছে। এ খবর দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি বলছে, ভারতের হাসপাতালগুলো করোনা রোগীতে ঠাসা। আত্মীয়-স্বজনরা অসুস্থদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার স্থানগুলোও সক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। কারণ, তারা সর্বোচ্চ যে পরিমাণ মৃতদেহ দাহ করতে পারে, তার চেয়েও অনেক বেশি লাশ যাচ্ছে সেখানে। দেশে ভয়াবহ এমন স্বাস্থ্য সঙ্কটের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশাল সব প্রচারণা র‌্যালিতে অংশ নিয়েছেন। এতে মানুষের ঢল নেমেছিল। এমন মানুষের ঢল দেখে পশ্চিমবঙ্গে গত ১৭ই এপ্রিল সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি গর্জন দেনÑ এর আগে আমি এত বিপুল মানুষের সমাগম কখনো দেখিনি! যেদিকেই তাকাই, শুধু দেখতে পাচ্ছি মানুষ আর মানুষ।
আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ যখন ভারতজুড়ে প্রবল বেগে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মোদি সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশাল অনুষ্ঠান কুম্ভমেলা বন্ধ করেননি। বন্ধ করেননি ক্রিকেট ম্যাচ। এসব অনুষ্ঠানে সমাগম হয় লাখ লাখ মানুষের। কিন্তু গত বছর দেশের প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের দেশে করোনা সংক্রমণ রোধে মোদির সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়েছিল। এ জন্য বেশ প্রশংসা পেয়েছিল তার সরকার। কিন্তু এবারের বিপর্যয়কর সার্জ মারাত্মকভাবে মোদির রাজনৈতিক ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. নভজোৎ দাহিয়া তাই প্রধানমনত্রী নরেন্দ্র মোদিকেই ‘সুপার স্প্রেডার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। চারদিকে যখন মৃত্যুশোক, মানুষ স্বজন হারিয়ে আহাজারি করছেন, তখন করোনা ভাইরাসের টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বাজেভাবে। এপি আরো লিখেছে, এর জন্য নরেন্দ্র মোদি দায় চাপাচ্ছেন রাজ্য সরকার এবং রোগীদের ওপর। তিনি বলছেন, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নাজুক এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল রাজ্য সরকারগুলো। তাই এর দায় তাদের এবং রোগীদের। নরেন্দ্র মোদি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিকে যেভাবে মোকাবিলা করছেন সে সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন আলোচিত লেখিকা ও অধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়। পরিস্থিতিকে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অরুন্ধতী বলেন, বিদেশি সরকারগুলো সাহায্য করার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু মোদির সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হবে ততই বিষয়টি হবে চালনির ওপর সাহায্য ঢাকার মতো। কারণ, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে মোদি নিজেকে অক্ষম হিসেবে দেখিয়েছেন। অথবা সংকীর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন।

ভারতের মধ্যবিত্তরা দুর্নীতি এবং ব্যুরোক্রেটিক অকার্যকারিতার কারণে একজন টেকনোক্র্যাটকে গভীর অনুমোদন দিয়েছে মানুষ।  ৭০ বছর বয়সী মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তিনি ভিন্নমত পোষণকারীদের কণ্ঠরোধ করেন এবং জনস্বাস্থ্য ইস্যুতেও রাজনীতি বেছে নিয়েছেন। ভারতে সরকারি হিসাবে যখন মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে যায় তখনও মোদি ছিলেন নীরব। বিপুল সংখ্যক বিশেষজ্ঞ বলেন, মৃতের এই সংখ্যা অনেক কমিয়ে দেখানো হয়েছে। মোদির সরকার বলেছে, তারা হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে, অক্সিজেন সরবরাহ এবং ওষুধের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য এক যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। বার্তা সংস্থা এপিকে তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকর বলেছেন, বর্তমান কোভিড মহামারি হলো এক শতাব্দীতে ফিরে আসা এক সঙ্কট। রাজ্য সরকার এবং সমাজের অন্যান্য অংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিস্থিতিকে কাটিয়ে উঠার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি নিজেকে এমন একজন হিসেবে উপস্থাপন করেন, যেন তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি হিন্দুত্ববাদী আদর্শের সঙ্গে ব্যবসা-বান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেন। তবে সমালোচকরা বলেন, তিনি জাতীয় সমাজকল্যাণ এবং নিজের হিন্দুত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতা ধরে রাখবেন। গুজরাটে নিজে যখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী, তখন ২০০২ সালে সেই রাজ্যে মুসলিম বিরোধী রক্তাক্ত দাঙ্গার জন্য তাকে দায়ী করা হয়, যদিও আদালত তাকে এ অভিযোগ থেকে স্বস্তি দিয়েছে। তার সরকার ভারতে অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, পণ্য ও সেবাখাতে ট্যাক্স বসানোর পর অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পর জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে আবার নির্বাচিত হয়েছেন।

তার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থনীতির ক্ষতি, সামাজিক দ্বন্দ্বকে আরো বিস্তৃত করা এবং প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষের পরও মোদি অবিশ্বাস্যরকম রাজনৈতিকভাবে স্থিতিস্থাপক অবস্থানে রয়েছেন বলে মনে করেন কার্নেজ এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক মিলান বৈষ্ণব। তিনি বলেন, যখন করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয় তখন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসনারোর থেকে ভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মোদি। ‘তিনি এই ভাইরাসকে ধাপ্পাবাজি হিসেবে কখনো আখ্যায়িত করেননি। তিনি এটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। তিনি মুখে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি যেকোনো স্থানে স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করেছেন’।

কিন্তু মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে তিনি কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছেন। এতে লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক আটকা পড়েন। তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তারা নিজেদের গ্রামে ফিরে গেছেন। পথেই মারা গেছেন অনেকে। তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সিদ্ধান্ত করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করেছে সরকারকে। আর এর মধ্য দিয়ে সরকারকে সময় করে দিয়েছে। ২০২০ সালের জুনে যখন ভারতে সবকিছু খুলে দেয়া হয় তখনই আবার করোনা সংক্রমণ বাড়া শুরু হয়। সরকার জরুরি অবকাঠামো পরিকল্পনার উন্নয়ন করে। এক পর্যায়ে এই সংক্রমণ কমে আসা শুরু হয়। শীতের সময়ে তা আরো কমে যায়। এ অবস্থাকে অনেক কর্মকর্তা বড় এক সাফল্য বলে আখ্যায়িত করেন। মাঠপর্যায়ে যেসব অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল এবং বিলম্বে আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর বসানো হয়েছিল তার সবটাই তুলে নেয়া হয়। অন্যদিকে এ মাসের শুরুর দিকে সরকার ১৬২টি অক্সিজেন প্লান্ট সৃষ্টির প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। বর্তমানে আছে এমন মাত্র ৩৮টি প্লান্ট। তারা আরো বলেছে, এই মাসেই তারা আরো ১০৫টি অক্সিজেন উৎপাদনের প্লান্ট স্থাপন করবে। অশোকা ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানের প্রফেসর গৌতম মেনন বলেছেন, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এখনও পর্যাপ্ত আধুনিকায়ন হয়নি। বর্তমানে সার্জ যে পর্যায়ে আছে তাতে এসব পর্যাপ্ত মনে হচ্ছে না।

জানুয়ারিতে আবার করোনা সংক্রমণ অনেক কমে আসে। এ সময় মোদি ভারতের সফলতা জোর গলায় বলতে থাকেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে তিনি বলতে থাকেন, কার্যকরভাবে করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করে তার দেশ বড় এক বিপর্যয় থেকে ভারতের মানবতাকে রক্ষা করেছে। তার দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রশংসায় গলে পড়ে তারই ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দল থেকে বলা হয়, তিনি কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে গর্বিত এবং এক বিজয়ী জাতি হিসেবে তৈরি করেছেন।

কিন্তু পরিস্থিতি উল্টে গেল মধ্য মার্চে। এ সময় গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচে যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। সেখানে ভাবখানা এমন ছিল যে, করোনা সংক্রমণ কিছুই না। এরও পরে গঙ্গায় কুম্ভমেলায় যখন লাখ লাখ হিন্দু ধর্মীয় মানুষের সমাবেশ ঘটে তখন মোদি এবং তার রাজনৈতিক মিত্ররা তাদেরকে স্বাগত জানায়। ২১ শে মার্চ পত্রিকাগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয় ‘বিউটিফুল ক্লিন সেফ’। উল্লেখ্য, এপ্রিলজুড়ে কুম্ভমেলায় লাখো মানুষ গঙ্গাস্নানে সমবেত হন। পক্ষান্তরে ২০২০ সালের মার্চে মুসলিমদের এক সমাবেশে যে ৩০০০ মানুষের জমায়েত হয়েছিল (তাবলীগ জামাত)- তাতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তার সরকার দায়ী করেছিল মুসলিমদের। এমনকি আদালতও এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এবার পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী র‌্যালি করেছেন তিনি ও তার দল বিজেপির বড় বড় নেতারা। তাতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। তাদের খুব কম মানুষের মুখেই ছিল মাস্ক। অন্য দলগুলো যে এ থেকে পিছিয়ে ছিল তা কিন্তু নয়। মোদির এমন সব কর্মকা-ে যখন সমালোচনার ঝড় শুরু হয়, তখন তিনি সরাসরি মাঠে না গিয়ে ভিডিও মারফত বক্তব্য দিতে থাকেন। কিন্তু মানুষের জমায়েত অব্যাহতই রয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে যখন তার দল ভয়াবহ পরাজয় বরণ করেছে, তখন বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনি দেশজুড়ে বেশ জনপ্রিয় এখনও।

এরই মধ্যে ভারতে করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়েছে জানুয়ারিতে। তার পর থেকে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ মানুষ এই টিকার একটি ডোজ নিয়েছেন। শতকরা ২ ভাগেরও কম মানুষ দুটি ডোজই নিয়েছেন। বাকি ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকা দেয়ার দায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে রাজ্য এবং বেসরকারি খাতের ওপর। সমালোচকরা বলছেন, এর উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক বিতর্কে রাজ্য সরকারকে দায়ী করা এবং তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়া। যখনই সঙ্কট বা সমস্যা দেখা দেবে, তখনই সরকার সহজেই রাজ্যগুলোকে দায়ী করবে। এরই মধ্যে অনেক রাজ্য জানিয়ে দিয়েছে, টিকা দেয়া শুরু করার মতো পর্যাপ্ত টিকা তাদের হাতে নেই।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর