‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অনেক কষ্ট করে শ’খানেক পাত্র তৈরি করি, কিন্তু বেচাবিক্রি নেই। বাপ-দাদারা করে গেছেন। আর কোনো কাজ করতে পারি না। এজন্য বাপ-দাদাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আজও মাটির বাসন তৈরি করে যাচ্ছি। মাটির বাসনের বিকল্প প্লাস্টিকের তৈজসপত্রে বাজার ছেয়ে গেছে যার ফলে আমরা ঐতিহ্য ধরে রাখলেও মানুষ তো আমাদের পণ্য কেনে না।’ সরজমিন শ্রীমঙ্গলের কুমারপাড়া পরিদর্শনে গেলে সেখানকার এক মৃৎশিল্পী বীণা পাল এমন আক্ষেপের কথা বলেন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের আবর্তে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। বহুমুখী সমস্যা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ সংকটের মুখে এ শিল্প। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প।
একটি সময় ছিল যে, মৃৎশিল্প পেশার সঙ্গে জড়িতরা মাটির বাসন তৈরি করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে লাভের মুখ দেখতেন। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনই ছিল এ মৃৎশিল্প। আগে যেখানে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ছিল মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার, তার স্থান এখন প্লাস্টিক, স্টিল, সিরামিক, ম্যালামাইনের তৈরি জিনিসপত্র দখল করে নিয়েছে। এতে মৃৎশিল্পের ব্যবহার দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। সরজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নিয়োজিত মৃৎশিল্পীরা প্রচীনকাল থেকে ধর্মীয় এবং আর্থসামাজিক কারণে মৃৎশিল্পে শ্রেণিভুক্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা মৃৎশিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। বর্তমান বাজারে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা তলানিতে ঠেকেছে। এর স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের তৈজসপত্র। ফলে বিক্রেতারা মাটির জিনিসপত্র আগের মতো আগ্রহের সঙ্গে নিচ্ছে না। তাদের চাহিদা নির্ভর করে ক্রেতাদের ওপর। কিন্তু উপজেলার কোথাও এখন আর মাটির হাঁড়িপাতিল তেমনটা চোখে পড়ে না। সে কারণে অনেক পুরনো শিল্পীরাও পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির জিনিসপত্রের পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে এখনো যারা এ পেশা আঁকড়ে রেখেছেন তাদের জীবনযাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
শ্রীমঙ্গল কুমারপাড়ার মৃৎশিল্পী বীণা পাল জানান, ২৫ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত আছেন। এর আগে বাপ-দাদারা করে গিয়েছেন এর ঐতিহ্য ধারণ করে আজও তিনি এ মৃৎশিল্প পেশায় নিয়োজিত। তিনি জানান, এ পেশায় কাজ করে দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এখন ও ছেলে মেয়েরা মাস্টার্স, অনার্সে লেখাপড়া করছে।
মৃৎশিল্প কারিগর ভৌমিক পাল জানায়, পলি মাটির উৎস নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন মাটি সংগ্রহে খরচ বেশি হয়। এ ছাড়া বেড়েছে জ্বালানি খরচ। সবমিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা না থাকায় তারা সঠিক দাম পাচ্ছেন না। এতে করে প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বাজার সৃষ্টি এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন অনুভব করছেন এখানকার মৃৎশিল্প সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো।