× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

করোনাকালীন ঈদ: চাঁদের আলোয় ভেজা স্বপ্নের উঠোন কই?

মত-মতান্তর

গাজী মিজানুর রহমান
৯ মে ২০২১, রবিবার

২০২০ সালে করোনাকালীন দুটো ঈদ গেছে। একুশ সালের দুটো ঈদ সামনে। একটা দরজায় টোকা দিচ্ছে। ঈদের যে একটা উষ্ণতা থাকে, গত বছরের ঈদে তার প্রভূত ঘাটতি ছিল। মানুষ দরজা আটকে যার যার ঘরে বসে ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে বা অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতিবেশির সাথে ভিডিও-কোলাকুলি করছেন। এতে না ছিল  জাপটে ধরে খাঁচা-ভাংগা হার্ট-টু-হার্ট চাপাচাপি, না ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে হই-হল্লা, আর ‘হাই-হ্যালো’ করার সুযোগ। ঈদ মানে খুশি। সে খুশি পেতে হলে মুখের ভাষা এবং দৈহিক ভাষা, দুই তরফের ভাষা এক হতে হবে।
ট্রান্সমিশন প্রান্ত এবং রিসিভিং প্রান্ত, উভয় দিকের কোডিং-ডিকোডিং মিলতে হবে। তা নাহলে থ্রি-জি খুশি টু-জি এন্টেনায় মাথাকুটে ফিরে যাবে। সকলের খুশি এক মোহনায় মিলিত না হলে, তাকে কি  ঈদ বলা যায়? করোনার মধ্যে ২০২১ সালের ঈদুল ফিতরের আগে সবকিছু বন্ধ থাকার পরও ফেরিতে চড়ে পদ্মা পার হওয়ার আশায় ছুটে যাওয়া লোকের ভিড়ে ফেরিঘাট সয়লাব হয়ে গেল। ফেরিতে গাড়ি উঠবে, সে জায়গা নেই। মানূষ আর মানুষ। হাতে একটা ব্যাগ, কারো কাঁধে আরও একটা। চেপে-ঠেসে ফেরির চাতালে দাঁড়ানো ঈদমুখো মানুষ। নাচতে নেমে তো ঘোমটা দেয়া যায় না! করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ঘরের বাইরে যখন পা দিয়েছেন এবং ট্রলার, স্পীড-বোট, লঞ্চ সব যখন বন্ধ, তখন দূরত্ব মেনে কি করে ফেরির উপর দাঁড়াবে-এটা জেনেই শুধু নাক-মুখে মাস্ক এঁটেই ফেরির দিকে ছুটেছেন ওরা। এই ভয়াবহ ঘরমুখো যাত্রার চেহারা দেখে সরকার শেষমেশ ফেরি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন যারা ঘাটে আছে, তাদের আরেক রকমের তিক্ত অভিজ্ঞতা হবে, যা ঈদের এক ফোঁটা আনন্দের দুধে একমন গো-মূত্র পড়ার মত ব্যাপার। এমন তো আগেও হয়েছে, এবার সেটার পুনরাবৃত্তি হলো।

২০২০ সালের সর্বশেষ ঈদ, অর্থাৎ ঈদুল আজহায় যারা কুরবানি দিয়েছেন, তারা এভাবেই গিয়েছিলেন এবং ঈদ করেছিলেন। করোনা আসার আগের সময়ে মানুষ পায়ে হেঁটে ছেলেকে নিয়ে গরুর হাটে গেছে। ছেলে একটা বড়সড় গরু দেখে বলে- আব্বা, এই গরুটা কিনে ফেলো! ওটা দেখতে নাদুস-নুদুস, তাই তার নজর কেড়েছে। ওদিকে আব্বারও একটা বাজেট আছে। তিনি পকেটে হাত দিয়ে দেখেন যে, গলার কাছে অত থল-থল করা গোস্ত-দোলানো গরুর টাকা তার থলিতে নেই। তিনি বলেছেন, এটা নেয়া যাবে না! তারপর পাঁচটা গরুর পাশে দাড়িয়ে বাপ-বেটা গরুর জাবর কাটা দেখে, লাফালাফি দেখে, স্মার্টনেস দেখে বেলা পড়ো-পড়ো হলে একটা পকেট-সাইজ গরু কিনে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে। হাট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় উঠে বিশ গজ পার হতে না হতেই, লোকে জিজ্ঞেস করে-দাম কত? এভাবে পাঁচ মিনিট পরপর কৌতুহলী মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে বাসা পর্যন্ত আসা। দাম শুনে তারা যদি বলে, ভালো কেনা হয়েছে, তবেই বাপ-বেটা দুজনের  হাসির  ঝিলিক ফোটে। এসব না থাকলে, তাকে কি ঈদ বলা যায়? কিন্তু সে ঈদের দেখা তো গতবার মেলেনি। কেউ-কেউ অন-লাইনে, আবার কেউ-কেউ বাসার সামনে রাস্তার মোড় থেকে পছন্দ করে গরু-খাসি নিয়ে এসেছেন। অন্য বছর বাসায় এনে দু’দিন একটা অস্থায়ী শেডে রেখে গরুটার ‘হাম্বা’ আর খাসিটার ‘ব্যাঁ-ব্যাঁ’ শুনতে শুনতে দিন-রাত্রি পার হতো। করোনা সে সুখ কেড়ে নিয়ে গেল !  

সম্পর্কের বাঁধনগুলো টিকে থাকে অন্তরের টানে। এই যে ঢাকা মহানগরী-আমাদের এত প্রিয় রাজধানী শহর- সে  মনের টানে তার সন্তানদের একটু আড়ালে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াবে, সে জায়গাটুকু নেই! সবখানে ব্যবসা! ফুটপাতে ব্যবসা, পাবলিক অফিসের গেটে ব্যবসা, হাসপাতালের বেডে ব্যবসা! ব্যবসা মানেই সাড়ে- ষোল কোটি মানুষের দেশে গিজগিজ লোকের ভিড়ে ঠেকায় ফেলে কিছু পয়াসা আদায়। যেদিকে দু’চোখ যায় শুধু লোক-ঠকানো, জনগণ-ঠকানো, ক্লায়েন্ট ঠকানো বাহানার ঝাঁপি! মাথার উপরে এসে ওরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গিয়ে বলছে, এই তো আমি তোমার নিরাপত্তার ছাতা। কোনো ছাতা এসে বলছে, ব্যাংকে তোমার টাকা আছে গোপনে জেনেছি, ওই যে অমুক বিলের মধ্যে আমাদের মেগা-প্রজেক্ট হচ্ছে, কিনে নাও এক-টুকরো জমি। কেউ এসে বলছে, আমরা ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান, বছরে ব্যাংকের চেয়ে দেড়গুণ লাভ দিই, ফেলো কিছু কড়ি এখানে। কেউ বলছে, দালান বানাচ্ছি, ফ্লাট বুকিং দাও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথার সাথে এদের কাজের মিল নেই। আর নিম্নবিত্ত যারা, তাদের  মাথার উপরে আচ্ছাদন, পায়ের তলায় মাটি, আর মুখে মোটা চালের ভাত জোগাড়ে হিমশিম খেতে হলেও, এদের ঠকাতে মধ্যস্বত্ত্বভোগীর অভাব নেই! তাই বিশ্বাসের জায়গাটুকু তেলাপোকায় ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে যাচ্ছে রোজ দিনেরাতে।
 
এমন যখন অবস্থা, তখন করোনা এসে দিল হানা। উটকোবাজি আকাশ ছুঁয়ে গেল। মৃত্যু নিয়ে, অসুখ নিয়ে হলো ব্যবসার রমরমা বাজার। বাজার থেকে রাতারাতি হারিয়ে গেল সেনিটেশন সংক্রান্ত ঔষধ, করোনার চিকিৎসায় কাজে লাগে যে আইভারমেকটিন তা। প্রথমদিকে এভাবে হাওয়া হয়েছিল হেক্সিসল, সেপনিল, স্যাভনল-এসব ব্যাকটেরিয়া বিধ্বংসী কেমিক্যাল প্রডাক্ট। তারপর এলো মিথ্যা সনদ, ভুয়া চিকিৎসা বিল, তিন টাকার জিনিস তিন-শ টাকায় বেচা-কেনার মচ্ছব। কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিতে ঠাসাঠাসি করে স্বাস্থ্যবিধির অপলাপ হলো। তারপর জানাজার নামাজ পড়তে, ধর্মীয় বয়ান শুনতে, রাজনৈতিক মত-বিনিময় করতে গিয়ে গায়ে-গা লাগিয়ে কত রকম মান্যগণ্যতার অপলাপ হলো! রাজধানী ঢাকাতেই এদের  দোর্দন্ড প্রতাপের পর  অল্প কিছুদিনের জন্য যখন সংক্রমণ একটু কমেছিল ,  তখন কক্সবাজার , কুয়াকাটায় যাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। এরপর  মানববন্ধন, সমাবেশ, ধরপাকড়, প্রেস-কনফারেন্স ইত্যাদি গেল বেড়ে। সব মিলিয়ে আবার কোভিড এগিয়ে এলো বীরদর্পে। এসব কারণে  সুযোগ পেলেই  মানুষের ঢাকা ছাড়বার আগ্রহ হয় দ্বিগুণ।
 
ঢাকা থেকে  গ্রামে গিয়ে  খুব যে আমোদ-প্রমোদ করবে এরা  তাও নয়! তবু মানুষ সামান্য একটু ছুটিছাটা পেলে গ্রামমুখো দৌড় দেয়। তারা যেন রাজধানী ঢাকার সৎ-মায়ের টেরা চাহনী দেখতে পায়। উঠতে বসতে খোঁটা, শাপ-শাপান্ত, এবং কথায়-কথায়  নালিশ! এই নির্বান্ধব চোখের হিংসুটে দৃষ্টি আর  জিহ্বার ছোবল থেকে পরিত্রাণ পেতে  দু-চারদিনের জন্য পালিয়ে কোথাও যাওয়া যাক, দেখে আসা যাক গত বর্ষায় যে লাউ-গাছটার উপরে মাচান করে দেয়া হয়েছিল-তা বেয়ে বেয়ে কতখানি বড় হলো? পেয়ারা গাছে ফুল এসেছিল, দেখে আসা যাক তার ফল কতটা বড় হলো? সেইসাথে শুধু মনে পড়ে, উঠোনটায় জ্যোৎস্না এসে পড়তো আগে, চৌকি পেতে কত গোল-মিটিং হতো!  চাঁদের আলোয় সিক্ত হয়ে সময়ের পেটের সন্তানের মত প্রকৃতির মধ্যে গুটিসুটি শুয়ে ভাবনাহীন সময় পার  হতো  তখন! স্মৃতিকাতর হয়ে এজন্যই বুঝি সবাই ভোঁ করে দৌড় দেয় গ্রামের দিকে। সেখানে গেলে সবাই বলে, এখানে করোনা নেই! কারুর তো শুনিনি করোনা হয়েছে! ঢাকা থেকে যারা যায়, তারা মনে-মনে বলে, পরীক্ষা তো করে  না, তাই করোনা হয় না! কেউ কেউ  মনে-মনে বলে, এত অবারিত সূর্যের চক-মিলানো মাঠ, সারাদিন দৌড়ঝাঁপ – করোনা এসে খুব-একটা পাত্তা পাবে না এখানে! কিন্তু উঠোনে চিৎ হয়ে শুয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আগের মত জ্যোৎস্না এসে ভিজিয়ে দেয় না। মনের মেঘে ঢাকা পড়ে চাঁদের হাসি।
 
(গাজী মিজানুর রহমান , প্রাক্তন সিভিল সার্ভেন্ট , রম্যলেখক এবং প্রবন্ধকার)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর