দুই দাগে ৪০ একর ৬৬ শতক জমি নবগঙ্গা নদীর নামে রেকর্ড। ৬২ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত নদীর নামেই বহাল আছে রেকর্ড। অথচ জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে জলমহাল দেখিয়ে নদী ইজারা দেয়া হয়েছে। ইজারা প্রদানের সময় শর্ত প্রদান করা হয় নৌ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এমন বাঁধ না দিতে, নদী খনন না করতে। কিন্তু সে শর্তও মানেনি ইজারা গ্রহীতারা। নদীর মধ্যে বড় বড় পুকুর খনন করে আস্ত নদী গিলে খেতে বসেছে। অন্যদিকে মৎস্য বিভাগের নথিতে ইতিহাস খ্যাত নবগঙ্গা নদীটি বাঁওড় দেখিয়ে খননের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩১ লাখ টাকা। বলা যায় নদীর মধ্যেই বাস্তবায়ন হচ্ছে এক মহাপ্রকল্প।
এ নিয়ে এলাকার কৃষকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কৃষকরা নদীতে পাট জাগ দিতে পারে না। জেলেরা ধরতে পারে না মাছ। ঘটনাটি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নে। সরজিমন দেখা গেছে, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদী বদরগঞ্জ হয়ে হরিণাকুণ্ডুর রিশখালী, সোনাতনপুর, ভুইয়াপাড়া ও ভেড়াখালী হয়ে ঝিনাইদহে মিশেছে। হরিণাকুণ্ডুর ভুইয়াপাড়া মৌজার ৫২৪নং দাগে ১১ একর ও সোনাতনপুর মৌজার ৩০৭৫, ৫০১৬নং দাগে ২৯ একর ৬৪ শতক নদীর জমি ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। নদীর নামে রেকর্ড থাকা জমি আবার ঝিনাইদহ মৎস্য বিভাগ পুনঃখননের জন্য ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দও করেছে। সেই কাজও এখন চলমান।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ইজারা প্রদানের সময় ১৬নং শর্তে উল্লেখ ছিল ইজারা গ্রহীতা ইজারাদাতার অনুমোদন ব্যতীত আড়াআড়িভাবে বাঁধ বা বেড়া এমনকি কোনো কাঠামো তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু নদীর মধ্যে এখন বড় বড় পুকুর ও বাঁধ। ফলে নৌকা বা ডিঙ্গি চলাচল করতে পারছে না। ৫নং শর্তে উল্লেখ আছে নৌ চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এমন কাজ ইজারা গ্রহীতা করতে পারবে না। জনস্বাস্থ্য ও পানির দূষণ ঘটে এমন কাজও করা যাবে না। কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করে সমিতির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক ও সাধারণ সম্পাদক এলেম মণ্ডল নদীর বুকে নিজেদের ভাগ্য বদলের এক মহাযজ্ঞ শুরু করেছেন।
স্থানীয় দৌলতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বুড়ো অভিযোগ করেন, ২০-২২ বছর ধরে নবগঙ্গা নদীটি বেদখল। নদীর বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া সমবায় সমিতি গঠন করে নদী ইজারা নেয়া হয়েছে। ফলে এলাকার কৃষকরা নদীতে পাট জাগ দিতে পারে না। ফসলের জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রয়েছে। হতদরিদ্ররা উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরে খেতে পারে না। নদীর অসংখ্য জায়গায় বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। তিনি নদীর বাঁধ উচ্ছেদ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানান।
ঝিনাইদহ নদী রক্ষা পরিষদের নেতা ও পরিবেশবিদ মাসুদ আহমেদ সনজু জানান, নদীর প্রবাহ বন্ধ করে মাছ চাষ কাম্য হতে পারে না। এটা অন্যায় ও পরিবেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। ভুইয়াপাড়া ও সোনাতন গ্রামের মানুষ অভিযোগ করেন, গত ১১ বছর ধরে সমবায় সমিতি গঠন করে নদীটি দখলে রাখা হয়েছে। বর্তমানে নদীটি জনতা মৎস্যজীবী সমিতির দখলে রয়েছে। গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে রিশখালী, ভুইয়াপাড়া, সোনাতনপুর ও ভেড়াখালী এলাকায় নদীর তিন কিলোমিটার অংশে বাঁধ দিয়ে এই মাছ চাষ করার ফলে কয়েক বছর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে অন্তত ৫০টি ঘরবাড়ি ভাঙনের কবলে পড়েছে। আর নদীর দু’পাড়ে জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি। নদীর ওই এলাকার ইজারাদার সোনাতনপুর জনতা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, আমরা ২০১৯ সালের ১৯শে জুলাই বাঁওড়টি (নবগঙ্গা নদী) জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বছরে ৬ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছি। এটা একটা লুপ কাটিং। আগে নদীর অংশ ছিল। কিন্তু এখন নদীটির বাঁকা অংশ কেটে সোজা করে দেয়ায় ইজারাকৃত অংশটি লুপকাটিংয়ে পরিণত হয়েছে। হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা নাফিস সুলতানা বলেন, নদী দখলমুক্ত করার বিষয়ে একটি আবেদন পেয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, ২০১১ সাল থেকে এটি ইজারা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এটি তিন বছরের জন্য ওই এলাকার একটি মৎস্যজীবী সমিতিকে ইজারা দেয়া রয়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে ইজারার মেয়াদ শেষ হলে নদীটি আর ইজারা দেয়া হবে না বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।