× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

আপনি কি আপনার মনঃচিকিৎসককে বিশ্বাস করতে পারেন?

মত-মতান্তর

সাকিব রহমান
১০ মে ২০২১, সোমবার

ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমরা প্রায়শই এধরনের ‘মিমস’ বা ‘রসাত্মক ছবি’ দেখি যে, মহামারি পরবর্তী সময়গুলোতে দু’ধরনের পেশাজীবীদের উপার্জন হু হু করে বেড়ে চলেছে। যথা এক, বিবাহবিচ্ছেদ করানো আইনজীবীগণ ও দুই, নরসুন্দরগণ! যদিও বাস্তবে তাদের বেশির ভাগেরই অবসর সময় কাটছে। পক্ষান্তরে, উপার্জন করার ক্ষেত্রে সম্মুখসারিতে চলে এসেছে সেসব ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীগণ যারা মনঃচিকিৎসা পরামর্শকেন্দ্র বা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেছেন।
কোভিড অবস্থা বিবেচনায় হোক বা অন্যকোনো ভাবে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা’ বাংলাদেশে বেশ মনোযোগ পেতে শুরু করেছে। যেখানে রোগী বা সেবাগ্রহীতার ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষাও এই লক্ষ্যে মনঃচিকিৎসক/মনঃবিজ্ঞানীগণের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে বিধি বা আইনের প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতার মধ্যকার অগ্রাধিকারসমূহ:
সাধারণত প্রথম দর্শনে, সেবাগ্রহীতাদের ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ কীভাবে তাদের যথা সেবা বা পরামর্শ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা মনঃবিশেষজ্ঞদের হাতে নিরাপদ ও গোপনীয় থাকবে তার মৌখিক বা যৎসামান্য লিখিত বর্ণনা করার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের সন্তুষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা চলে যেখানে বলা হয় শুধুমাত্র রোগীর মাঝে আত্মহত্যা বা অন্যকে বিনষ্ট করার প্রবণতা দেখা গেলেই কেবল তারা রোগীর পারিবারিক সদস্য ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করতে পারেন।

যদিও আপনার কাছে এমনটা মনে হতেই পারে যে, এখানে অবশ্যই একটি পেশাগত বা নৈতিক আচরণবিধি অথবা প্রচলিত আইন রয়েছে যার দ্বারা তাদের পেশাগত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, বাংলাদেশে এধরনের কোনো বিধি বা আইন নেই যা আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য।
বাংলাদেশে আইনজীবীদের ক্ষেত্রে যেমন ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল’ নামক একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে যা আইন পেশা অনুশীলনের জন্য আইনজীবীদের লাইসেন্স প্রদান করে থাকে তাদের তথা আইনজীবীদের পেশাগত আচরণও নিয়ন্ত্রণ করে। এধরনের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাই এসব পরামর্শদাতা বা মনঃচিকিৎসকদের ক্ষেত্রে নেই।
সুতরাং আপনার গোপনীয়তা অন্যের কাছে প্রকাশের দরুন আপনার মনঃপরামর্শদাতা বা বিশেষজ্ঞকে নৈতিকতার মানদণ্ডে  দোষী সাব্যস্ত করা গেলেও আপনি তাকে আইনগত ভাবে দোষী সাব্যস্ত বা দায়ী করতে পারবেন না এবং এখানে এমন কোনো কর্তৃপক্ষও নেই যারা কোনো একজনকে তার গুরুতর অপেশাদার আচরণের জন্য তার লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করে তাকে শাস্তি দিবে।

এভাবে, একজন রোগী বা সেবাগ্রহীতার এসব পেশাজীবীদের মুখের কথা বিশ্বাস করা ব্যতিরেকে আর কোনো উপায়ই থাকে না।

তথ্য সুরক্ষা আইন:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৩ (খ) অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের তাদের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের ওপর গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।
এই বিধানটি সংবিধানের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

অতএব, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষা বাস্তবায়নে বাধ্য। অন্যথায়, অন্যায় বা অন্যায্যতার শিকার ব্যক্তিটির আবেদনের (রিট পিটিশন) মাধ্যমে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার অধিকার রয়েছে।
অধিকন্তু, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর ধারা ৭ (জ), ৭ (ঝ), ৭ (দ) অনুসারে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো নাগরিককে এমন তথ্যসমূহ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে না, যা প্রকাশের ফলে যেকোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে অথবা যা প্রকাশের ফলে কোনো ব্যক্তির জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে, কিংবা যা কোনো ব্যক্তির আইন দ্বারা সংরক্ষিত গোপনীয় তথ্য।

যদিও এক্ষেত্রের ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে উপরোক্ত ধারা বলে কিছুটা সুরক্ষা প্রদান করে। আইনের এই বিধানসমূহ কিছুটা ফল বয়ে আনতে পারে কেবলমাত্র তখনই যখন আপনার পরামর্শদাতা বা মনঃবিশেষজ্ঞ মহোদয় কোনো একটি নির্দিষ্ট হাসপাতাল বা চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন।
কিন্তু যদি তারা ফ্রিল্যান্স কাজ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে আপনার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়লে সম্ভাব্য কোনো প্রতিকারই আসলে থাকে না। এমন কি কুখ্যাত আইসিটি এবং ডিজিটাল সুরক্ষা আইনগুলোও পুরোপুরিভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় ব্যর্থ এই বিবেচনায় যে, এই আইনসমূহ বিশেষত ডিজিটাল তথ্যে মনোনিবেশ করে। অর্থাৎ শুধুমাত্র কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থার মধ্য থেকে কোনো তথ্যের অপব্যবহার না হয়ে অন্যকোনো রেকর্ড থেকে অপব্যবহৃত হলে, তখনই অপব্যবহারকারীকে শাস্তির আওতায় আনতে এই আইনসমূহ ব্যর্থ।

সমাধান:
যদিও বাংলাদেশে এখনো কোনো ব্যক্তি মানসিক থেরাপি বা পরিষেবার দ্বারস্থ হলে তাকে উন্মাদ বা পাগল বলেই ধরে নেয়া হয় অথবা তার এই সংকটকে সৌখিনতা জ্ঞান করে বলা হয় যে, বাস্তব জীবনে তার আসলে কোনো সমস্যাই নেই! তবুও কাউন্সেলিং পরিষেবার জনপ্রিয়তার এই তীব্রবর্ধনে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার গঠনও কার্যকরযোগ্য একটি আচরণবিধির প্রণয়ন এই সময়টাতে না হলেই নয়। যে সব অল্পবিস্তর আইনি ধারাসমূহ এ বিষয়ে রয়েছে তা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।

এখন একবার এভাবে ভাবা যাক যে, আমি নিজেই উদ্বেগজনিত ব্যাধিবাহক একজন ব্যক্তি এবং আমার পরামর্শদাতার কাছে আমার কিছু গোপনীয়তা প্রকাশ করতে হবে শুধুমাত্র এতটুকু জেনেই যে, সে হয়তো আমার বিষয়সমূহ প্রকাশ করবে না! কিন্তু সে যে অসচেতনতায় তা প্রকাশ করবে না তার নিশ্চয়তা কি? আর শুরুতেই নিজ পরামর্শদাতার প্রতি এমন অবিশ্বাসের জায়গা স্বভাবতই আমার উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যাধিকে উপশম করার বিপরীতে আরো ত্বরান্বিতই করতে পারে।

মজার বিষয় হলো, সেবাগ্রহীতা ও তার পরামর্শদাতার মধ্যে একটি অপ্রকাশ্য বা গোপনীয় খসড়া চুক্তি তৈরি করা হয়ে থাকে যেটাকে এই গোপনীয়তা রক্ষার একমাত্র আইনি দলিল বলে ধরে নেয়া হয়। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি যে, এই চুক্তিটি হলো দুটি পক্ষের মধ্যে এমন একটি লিখিত বোঝাপড়া যা দুটি পক্ষের মধ্যেকার বর্ণিত তথ্যসমূহকে তৃতীয় পক্ষ বা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করা হতে আইনগতভাবে বাধা প্রদান করে থাকে।
এধরনের বর্ণিত তথ্যসমূহ প্রযোজ্য হতে পারে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, নতুন উদ্ভাবিত পণ্য, সেবা, উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া অথবা অন্যকোনো ব্যবসায়িক গোপন তথ্য বা বিষয়ের ক্ষেত্রে। চুক্তিটি একপক্ষীয় হতে পারে শুধুমাত্র একটি পক্ষকে তথ্যসমূহ প্রকাশে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে আবার দ্বিপক্ষীয়ও হতে পারে যা উভয়পক্ষকেই তাদের মধ্যকার আদানকৃত তথ্য উন্মোচন বা প্রকাশে বাধা প্রদান করে।

এখন যে ব্যক্তির প্রকৃত অর্থেই একজন মনঃবিজ্ঞানী বা মানসিক পরামর্শদাতার পরিষেবা বা সাহায্য জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন তাকে যদি বাংলাদেশের ‘চুক্তি আইন ১৮৭২’-এর আওতায় একটি চুক্তিপত্র তৈরির চিন্তা করতে হয় তা একদিকে যেমন তার নিজেকেই আরো মানসিক অস্বস্তির দিকে ঠেলে দেয় অন্যদিকে পরিষেবা গ্রহণকারীর ওপর তার পরামর্শদাতার অনাস্থা তৈরি করতে পারে যা সঠিক পরিষেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুতরাং আমি মনে করি যে, এ বিষয়ক একটি যথাযথ আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিষ্ঠা ও পেশাগত আচরণবিধি বা আইনের প্রণয়ন করা এ মুহূর্তে অত্যাবশ্যকীয় এবং আমার বিশ্বাস এই পদক্ষেপ মনঃবিজ্ঞানী বা মানসিক পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকেই নেয়াটা সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলজনক হবে। কেননা, এটা একদিকে যেমন পরিষেবা গ্রহণকারীদেরকে স্বস্তি প্রদান করবে তেমনি অন্যদিকে মনঃবিজ্ঞানী বা মানসিক পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাকেও অধিকতর সমৃদ্ধি প্রদান ও ত্বরান্বিত করবে।

লেখক:  আইনজীবী, ঢাকা জেলা জজ আদালত ও জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, আইন বিভাগ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর