মঙ্গলবার ২৩ অক্টোবর ২০০৭ দিন ১৯৪গত পাঁচ দিনে সেনাবাহিনী প্রধান অসংলগ্ন এবং স্ববিরোধী মোট ১৪টি বিবৃতি দিয়েছে। এটা এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি একজন অপরিপক্ক ও স্থল চিন্তার মানুষ। কিন্তু ক্ষমতা তার মাথার মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে এবং তার প্রতিফলন ভয়াবহ হতে বাধ্য। তার ছেলে আমেরিকায় লেখাপড়া করছে। নিজের স্বল্প বেতন থেকে তিনি তার বিপুল ব্যয় নির্বাহ করছে কীভাবে?
আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিম্ন আদালতে অ্যালকোহল মামলার প্রয়োজনে সেই ঝুঁকিপূর্ণ, ময়লা, নোংরা, দমবন্ধ করা প্রিজন ভ্যানে চড়িয়ে। কিন্তু কেন এই অত্যাচার? মামলার বিচারকার্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু আমাকে নাজেহাল করার প্রক্রিয়া থেমে যায়নি। অবশ্য জেলখানা থেকে সাময়িক ভাবে বের হয়ে আসার সুবাদে আমি কিছুটা বাড়তি সুবিধাও ভোগ করি। এ সময়টাতে আমি আমার পাণ্ডুলিপি বিনিময়, আইনজীবীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ, তাদের যথাযথ নির্দেশ দান, হাইকোর্ট ডিভিশনে চলা মামলাগুলোর জন্য নোট আদান-প্রদান এবং আমার আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের দেখার সুযোগ পাই সাময়িক মুক্তির খানিকটা আস্বাদ আমি এ সময় ভোগ করি।
আদালতে যতক্ষণ ছিলাম হিজাবে মুখ আবৃত অবস্থায় আমার বোন নাফিসার আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু চোখ এ সময় আমাকে প্রতিমুহূর্তে অনুসরণ করে চলছিল।
বুধবার ২৪ অক্টোবর ২০০৭ দিন ১৯৫স্থানীয় পত্রিকাসমূহে ব্যাপকভাবে ঢাকঢোল পেটানোর পরেও সেনাবাহিনী প্রধানের আমেরিকায় কথিত সফরের একটি সংবাদ আমার কাছে মুখরোচক বলে মনে হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডী সেন্টারে তার একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখার কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তার সেন্টারে আগমনের পূর্বমুহূর্তে ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে তাকে না জানিয়েই নির্ধারিত সে কর্মসূচি বাতিল করা হয়। নিজস্ব যুগব্যাপী সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে ইউনিফর্ম পরিহিত একজন জেনারেলকে হার্ভার্ডে ভাষণ দিতে তারা অনুমতি দেয়নি-কারণ হার্ভার্ডের কেনেডী সেন্টার সবসময়ই উদার গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে এসেছে- সেনাশাসনের অনিয়মতান্ত্রিক শাসনের সমর্থক হিসেবে নয়।
শেষ পর্যন্ত নিতান্ত হতাশ ও অসহায় অবস্থায় জেনারেল সাহেব একটি অনানুষ্ঠানিক কাগজের ঠোঙায় খাবার কিনে সরকারের তল্পিবাহক গুটিকয়েক ছাত্রের সঙ্গে লাঞ্চ করেছেন এবং তাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলেছেন। অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি ওয়াশিংটন সফরের জন্য কোনো আমন্ত্রণ সংগ্রহ করতে পারেননি, এমনকি পেন্টাগনের কোনো জেনারেলের সঙ্গেও তিনি দেখা করতে পারেননি।
হার্ভার্ডের একজন ফেলো হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেনেডী সেন্টারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের ভাষণদানের জন্য আমন্ত্রণ পাওয়ার সংবাদে প্রথম প্রথম আমি বেশ খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম- কারণ আমি জানতাম যে, হার্ভার্ডে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অন্য সবকিছুর ওপরে স্থান দেওয়া হয়। তাছাড়া এই অঞ্চল হলো উদার ও গণতান্ত্রিক কেনেডী পরিবারেরও বাসস্থান।
নিঃসন্দেহে এটা সরকারি কোনো সফর ছিল না এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে এর ছিল না বিন্দুমাত্র সম্পর্ক। এখন প্রশ্ন হলো জেনারেলকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানালো কে? যাতায়াত খরচ, খাবার ও থাকার ব্যয়ভার বহন করেছে কারা? রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ব্যয় বহন করা হয়ে থাকলে এ হবে দুর্নীতির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জনশ্রুতি আছে যে, এই সফরের আয়োজন করেছিল গওহর রিজভী এবং শেখ হাসিনার পুত্র জয়।
বৃহস্পতিবার ২৫ অক্টোবর ২০০৭ দিন ১৯৬সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোাশাররফের চাপে দীর্ঘ ৮ বছর যাবৎ নির্বাসনে থাকার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো তনয়া প্রাচ্যের কন্যা হিসেবে খ্যাত বেনজীর ভুট্টো এ মাসের ১৮ তারিখে পাকিস্তান ফিরে আসার পর হাজার হাজার মানুষের সহর্ষ অভ্যর্থনার সময় করাচীতে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে হত্যা করার জন্য তার মোটরবহরে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৪৯ জনের মৃত্যু ঘটে ও আহত হন আরো ৪ শতাধিক। পাকিস্তানে নিজ বাসভূমিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ফিরে আসা এ জননেত্রী জঘন্য সন্ত্রাসবাদের শিকার হওয়ার এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। অল্পের জন্য Daughter of the East প্রাণে বেঁচে গেছেন।
এ ধরনের রাজনৈতিক হামলার রহস্য সবসময়ই অমীমাংসিত থেকে যায় এবং আসল খুনিদের চিহ্নিত করা যায়নি। তবে ইসলামী জঙ্গীরা অনেক আগে থেকেই তাকে দেশে না ফেরার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছিল, কারণ বেনজীরের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনা ছিল সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করা এবং পাকিস্তানকে একটি সমৃদ্ধ, শানিন্তপূর্ণ ও নিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত করা। তবে সন্ত্রাসীরা তাদের শক্তিময়তা প্রমাণে সফল হয়েছে। বেনজীর ভুট্টো সন্দেহ প্রকাশ করেছিল কতিপয় সামরিক অফিসার যারা তার বাবা ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, এই হামলার পেছনে তারাই মদদ জুগিয়েছেন, কারণ তারা জানতেন যে, বেনজীর ক্ষমতায় গেলে তাদের রেহাই দেওয়া হবে না।
শুক্রবার ২৬ অক্টোবর ২০০৭ দিন ১৯৭আল্লাহর অশেষ করুণায় আমি মুক্তি পেলে আমার জীবনে এক গুণগত পরিবর্তন এনে অবশ্যই আমি আল্লাহর কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো। আমি যেসব পদক্ষেপ নেবো সেগুলো হলো: (১) আল্লাহর প্রতি আমার আনুগত্য গভীরতর করা, (২) পরিবারকে, অর্থাৎ হাসনা, আমান ও আনাকে আরো বেশি সময় দেওয়া, (৩) বই লেখার জন্য লেখাপড়ায় আরো বেশি মনোযোগ নিবিষ্ট করা, (৪) আমার পেশা জোরদার করা এবং (৫) যে কোনো ধরনের পাপকার্য থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।
আমি আরো যে কাজগুলো করবো সেগুলো হলো: (ক) আমার এলাকার গরীব জনগণ ও এতিমদের জন্য আরো বেশি সময় দেবো, (খ) কোরআন মুখস্তকরণ উৎসাহিত করে কোরআনে হাফেজদের ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করবো, (গ) বাবা ও মায়ের জন্য আরো বেশি দোয়ার আয়োজন করবো, (ঘ) আমার বড় বোন দিল আফরোজ ও নাফিসার প্রয়াত স্বামী বড় ও মেঝে দুলাভাইয়ের কবরে ফাতেহা পাঠ করবো, (ঙ) আমার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগ রাখবো এবং (চ) আমার দুর্দিনে যারা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আমাকে সাহায্য করেছে, তাদেরকে অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা জানানোর বিষয়টি কোনোদিন বিস্মৃত হবো না।
শনিবার ২৭ অক্টোবর ২০০৭ দিন ১৯৮ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে একজন সদস্য জেলখানায় আমার অবস্থা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন যে, ব্রিটিশ সরকার আমার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন এবং তারা এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক জন পিলজার মুক্তিযুদ্ধকালে আমার সমস্ত অবদানের বিষয় বিশদভাবে বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধান বরাবরে সুদীর্ঘ এক পত্র লিখেছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকায় দুই কলাম হেডিংয়ে “Bangladesh PM held for alcohol” - ‘মদ রাখার দায়ে বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী আটক’ শীর্ষক একটি খবর ছাপা হয়েছে। হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে আমার আশু মুক্তি দাবি করে যার যার সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অদক্ষ এই সরকার এ ধরনের আবেদনের গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করতেও অক্ষম।
ছয় মাস আগে জেলখানায় অন্তরীণ হওয়ার পর আজ আমি হাসনার লেখা প্রথম চিঠি পেয়েছি। আনাও আলাদাভাবে আমাকে লিখেছে। লন্ডন থেকে ফেরার সময় খোকন চিঠিগুলো নিয়ে এসেছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে হাসনার ফেলোশিপ শুরু হবে। অতিকষ্টে অভাবের মুখে ধারকর্জ করে ওদের জীবন কাটছে।
রবিবার ২৮ অক্টোবর ২০০৭ দিন ১৯৯এ যাবৎ আমি কখনোই শুনিনি যে, নিবর্তনমূলক আটকাদেশের বিরুদ্ধে কোনো হাইকোর্ট ডিভিশনের দেওয়া মুক্তির নির্দেশ অ্যাপিলেট ডিভিশন স্থগিত করে দেয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা ঘটেছে। চেম্বার জজ মুক্তির আদেশ স্থগিত করে দেয়। তবে ফুল কোর্ট আজকে নিয়মিত সিভিল আবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টে আমার মুক্তির আদেশ অবৈধ বলে দাবি করে যুক্তি দেখানোর পর সেগুলো অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত আমার মুক্তির আদেশ বহাল রেখেছে। আপিলের সময় সবচাইতে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটেছে এই যে, প্রধান বিচারপতি স্বয়ং উন্মুক্ত আদালতে জানিয়েছেন যে, আমাকে মুক্ত না করার জন্য তাকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটর্নি জেনারেল সে চিঠি দেখতে চাইলে প্রধান বিচারপতি তাকে তার খাস কামরায় গিয়ে চিঠিটি দেখে আসতে বলেছেন।
অবশ্য এর পরেও আমার মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ এর আগেই দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা আমার সম্পত্তিসংক্রান্ত এক মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ জামিন মঞ্জুর করা সত্ত্বেও সরকারের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব ও চাপে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ আমাকে জামিন মঞ্জুর করেনি।
তবে অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে আটকাদেশ থেকে আমার মুক্তির ব্যাপারে দেওয়া রায় তাৎক্ষণিকভাবে আমার কোনো উপকারে না এলেও ভবিষ্যতে একই ধরনের মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
পুলিশ বিভাগের কর্মচারীরা তাদের কার্যকলাপের প্রতি পদে পদে মাথামোটা সামরিক কর্মকর্তাদের বাধাদানের ঘটনায় সমালোচনামুখর হয়েছে এবং সুযোগ পেলেই তারা এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা করছে। গত ছয় মাসে পুলিশবাহিনী থেকে চাকুরি হারিয়েছে প্রায় ৬ হাজার জন।
সোমবার ২৯ অক্টোবর ২০০৭ দিন ২০০নিজেকে আলোকিত রাখার জন্যই আমি আমার কাছে হাসনার লেখা ও হাসনার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের লেখা চিঠিগুলো বারবার পড়ি।
হঠাৎ করেই জেলখানার ভেতরে এবং জেলগেটে আমাদের চলাফেরা ও গতিবিধির ওপর বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আগত অতিথিদের ওপর চালানো হচ্ছে তল্লাশি ও জেরা; নানাভাবে তাদের নাজেহাল করার মাত্রা বেড়ে গেছে। আমাদের লক-আপ টাইম রাত আটটা হলেও এখন তা এগিয়ে নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
বিচারকার্য স্থগিত থাকলেও আমাকে যথাবিধি হাজিরা লিপিবদ্ধ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আদালতে। তবে এর ফলে আমার পাণ্ডুলিপি ও নোট বিনিময়, আইনজীবী, আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাংক্ষীদের সঙ্গে দেখা করার বাড়তি সুযোগ পাওয়া গেছে।
(চলবে..)