মঙ্গলবার ৩০ অক্টোবর ২০০৭ দিন ২০১বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা সবচাইতে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। সেনাপ্রধানের দুই তল্পিবাহক অফিসার ব্রিগেডিয়ার আমিন ও বারীর নির্দেশে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বাসায় বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটির একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। এ দু’জন অফিসার সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের রূপকার হিসেবেই পরিচিত। এই বৈঠকের আগে এই দুই অফিসার দলের সদ্য নির্বাচিত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে ডেকে অবিলম্বে তাকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন যে, অন্যথায় পরিবারবর্গসহ তাকে খুন করা হবে। কিন্তু তাকে পদত্যাগে রাজি করাতে না পেরে তথাকথিত সে বৈঠকে দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিবের পদ থেকে রেহাই দিয়ে সাইফুর রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ও মেজর হাফিজ উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিযুক্ত করা হয়েছে ও বেগম জিয়া কর্তৃক দলের বহিষ্কৃত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার বহিষ্কারাদেশ বাতিল করে দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যপদে পুনর্বহাল করা হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারপারসন ব্যতীত আর কারো এসব পরিবর্তন আনার অধিকার নেই এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বা ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নামের কোনো পদের অস্তিত্ব নেই। তাছাড়া গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসনের সম্মতি ও অনুমোদন ব্যতীত স্ট্যান্ডিং কমিটির কোনো বৈঠক আহ্বানের এখতিয়ারও কারো নেই। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা যে কতটা অপরিপক্ক ও বালকসুলভ আচরণ করছে এ থেকে স্পষ্টভাবেই তা প্রতিভাত হয়।
রাজনীতিতে এ ধরনের অবাস্তব ও অযৌক্তিক খেলাধুলার সূত্রপাত ঘটিয়ে তারা কী ফায়দা লুটতে চান সাধারণ মানুষের কাছে তা বোধগম্য নয়। তারা ভেবেছিলেন যে, এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে বিএনপিতে ভাঙন ধরিয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করে ফেলবে। কিন্তু রাজনীতি কোনো ছেলেখেলা নয়। খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় সাইফুর রহমানকে ১১ বছর অর্থমন্ত্রী পদে বহাল রাখা হয়েছিল এবং মেজর হাফিজকে খালেদা জিয়া শেষ মন্ত্রিসভায় দু’টি পোর্টফোলিও একসঙ্গে দিয়েছিলেন। এহেন তৎপরতার ফলে তারা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চরম আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান এই ঘটনাকে ‘মধ্যরাতের ক্যু’- হিসেবে অভিহিত করেছেন ।
বুধবার ৩১ অক্টোবর ২০০৭ দিন ২০২সাইফুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়ার ক্ষেত্রে সরকার যা করেছে তাতে করে সরকারের নির্লজ্জ অবস্থানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আতাউস সামাদ বিবিসিতে যথার্থ সত্য কথাই বলেছেন যে, বিএনপি’র প্রতিনিধিত্ব করার জন্য খালেদা জিয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এসব গোঁজামিলের পরিসমাপ্তি ঘটবে কবে?
আমার লেখার কাজ, সময়ে সময়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও কোর্টে হাজিরা দেওয়া বাদে, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ছাড়াই দিন কাটছে আমার।
বৃহস্পতিবার ১ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৩দিনে দিনে সেনাবাহিনী প্রধানের নতুন নতুন দুর্নীতির খবর আরো বেশি ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে প্রথমে তিনি বলেন যে, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কাছ থেকে তিনি ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি নিজেই সেই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং দাবি করেন যে, সম্পত্তি ভাড়া থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে তিনি প্রতিমাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন। কিন্তু এখন ইন্টারনেটে জানা গেছে যে, ব্যাংকের কাছে তার দেনার পরিমাণ ৯৯ লাখ টাকা এবং বাড়িটি বানাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তিনি তার বিবরণী দেননি।
আজ কোর্টে আমার বোন নাফিসা আমাকে জানালো যে, গ্রামাঞ্চলে ক্ষুধার তাড়নায় লোকজন মারা যাচ্ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে সকলে সবরকমের আশা ছেড়ে দিচ্ছে।
শুক্রবার ২ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৪আমাদের কয়েকজনের প্রণয়ন করা একটা খসড়া চিঠি গোপনে বেগম জিয়ার কাছে আমরা পাঠিয়েছি। তাকে বলেছি, তিনি যেন জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চিঠিটি নির্বাচন কমিশনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠিয়ে দেন। এতে বেগম জিয়া নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেবেন যে, ২৯শে অক্টোবর সাইফুর রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত বিএনপি’র কমিটির তথাকথিত বৈঠক এবং সে বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত পুরোপুরিভাবে অগঠনতান্ত্রিক। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেবেন যে, নির্বাচন কমিশন যে সংলাপের আয়োজন করেছেন প্রস্তাবিত সেই সংলাপে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অংশ নেবেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ্। এছাড়া না কাউকে সেই কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি। যদি জেল কর্তৃপক্ষ চিঠিটি নির্বাচন কমিশনে পাঠাতে অস্বীকার করে তাহলে গোপনে তা গণমাধ্যমের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে জনগণকে এ বিষয়ে যেন অবহিত করা হয়। দেখা যাক এর শেষ কোথায়!
শনিবার ৩ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৫দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর নিজের লেখা নিবন্ধে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে সত্য ও সাহসী মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ২৮ টাকা কেজিতে এবং আশঙ্কাজনক বিষয় হলো লাল আটার দাম উঠে গেছে কেজি প্রতি ৪০ টাকায়। এর আগে আটার দাম সবসময়ই ছিল চালের দামের চাইতে তুলনামূলকভাবে কম। প্রতিদিন প্রত্যেকটি পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। সরকার হতবিহ্বলের মতো শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
সায়েদাবাদের হুজুর এসেছিলেন আমাকে আশীর্বাদ জানাতে। ব্যারিস্টার খোকন, তৌহিদ ও ফরিদ সুপ্রিম কোর্টের মামলায় আমার পক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করার ব্যাপারে পরামর্শ করতে এসেছিল।
রবিবার ৪ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৬রমজান শেষ হয়ে যাওয়ায় আমার সময়-ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আমার প্রার্থনা ও বই লেখার সময়ের ব্যাপারে।
১. প্রার্থনা ও ইবাদতে সাড়ে তিন ঘণ্টা; সকালে দুই ঘণ্টা, বিকালে দেড় ঘণ্টা।
২. হালকা ব্যয়াম ১৫ মিনিট।
৩. পড়াশোনা ও লেখা ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা।
৪. ডায়েরি লেখা আধঘণ্টা।
৫. নাস্তা, লাঞ্চ ও বৈকালিক আহার দেড় ঘণ্টা।
৬. নিদ্রা ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা।
৭. ঘুমানাের আগে বই পড়া আধঘণ্টা বা ততোধিক।
৮. পত্রিকা পড়া ও ক্লিপিং করা আধ থেকে এক ঘণ্টা।
৯. টিভি দেখা ১০ মিনিট।
১০. বাকি সময়ে গোসল, বাথরুম ইত্যাদি।
আমার হাসপাতাল ও কোর্টে আসা-যাওয়া এবং মামলার জন্য আর্জি লেখার দিনগুলো ছাড়া এই হলো আমার এখনকার দৈনন্দিন কার্যতালিকা।
আমি গালগল্পে সময় নষ্ট করি না। তবে সহবন্দিদের সাথে যে কোনো ইন্টারেস্টিং আলোচনায় আমি অংশ নিই। অন্যথায়, আমার সময় কাটে নিজস্ব কক্ষটাতে।
সম্প্রতি তারেক রহমান প্রায় প্রতিদিন আসছে আমার কাছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে প্রায় ৪৫ মিনিট পর্যন্ত।
সোমবার ৫ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৭প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে অন্যান্য অপরাধসহ সরকারি গাড়ি অপব্যবহারের দায়ে তার অনুপস্থিতিতে ৫৯ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। বরগুনার সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনিকে কয়েক বান্ডিল ঢেউটিন আত্মসাতের দায়ে ১৪ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরকে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে সাজা দেওয়া হয়েছে ১৭ বছরের। আমদানিকৃত শুল্কমুক্ত গাড়ি বিক্রির অভিযোগে বিপুলসংখ্যক সংসদ সদস্যকে ১৪ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। সবাইকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে। একদিনও কম নয়। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বাদে বাকি পাঁচটি শহরের মেয়রই এখন কারাগারে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল। আরেকজন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দেশের আকাশে এখন ঘনীভূত কালো মেঘ ইঙ্গিত দিচ্ছে আসন্ন এক অশনি সংকেতের। চমৎকার সব কথা।
অন্যদিকে, নানারকমের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিচারপতি জনাব শাহ্ আবু নাঈম হাইকোর্ট ডিভিশনে সুবিচারের দ্বার উন্মুক্ত রেখে তার রিট এখতিয়ারের সুবাদে ফৌজদারি অভিযোগের ভিত্তিতে দায়েরকৃত মামলাসমূহের ওপর জামিন মঞ্জুর ও স্থগিতাদেশ জারি করে চলেছেন।
মঙ্গলবার ৬ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৮আধা বিচারিক সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবিধানের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন, গঠন করা হলেও সামরিক সরকারের অধীনস্থ একটি আজ্ঞাবহ সংগঠন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কমিশনটি দারুণভাবে আলোচনার পাত্র হয়ে পড়েছে। যে সমস্ত কারণে প্রতিষ্ঠানটি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে সেগুলো হলো: (১) রাজনৈতিক মন্তব্যসমূহ জারি করে ও রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নিয়ে; (২) সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত এবং সংবিধানের বিধান
অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে; (৩) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ছবিসম্বলিত ভোটার তালিকা প্রণয়নের অজুহাতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দু’বছরের বেশি সময় নিয়ে; (৪) এটা প্রচার করে যে নির্বাচন কমিশন হলো আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল; (৫) কোনোরকম বিচারকার্য শেষ হওয়ার আগে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হবার আগে এবং এ সংক্রান্ত কোনো বিতর্কের আহ্বান না করে যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত দিয়ে এবং (৬) চেয়ারপারসন হিসেবে দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পরও সিদ্ধান্ত মোতাবেক মনোনীত খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের প্রতিনিধিত্ব অগ্রাহ্য করে বিএনপি’র প্রতিনিধি হিসেবে সামরিক সরকারের ইচ্ছানুযায়ী সাইফুর রহমান ও মেজর হাফিজ উদ্দিনকে কথিত সংলাপে আহ্বান করে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর প্রচেষ্টা। এভাবে নির্বাচন কমিশন তার অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতাই হারিয়ে ফেলেছে।
হাজিরা লিপিবদ্ধ করার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আদালতে, যার ফলে আমার অন্যান্য কাজকর্ম সম্পাদন করার সবরকম সুযোগের সদ্ব্যবহার আমি করেছি।
নাফিসা, শাকের, জ্যোতি ও রিয়াদ আদালতে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে।
বুধবার ৭ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২০৯এ দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। স্বতঃস্ফূর্ত এক বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ স্লোগানে মুখরিত করে সেনাবাহিনী ও জনগণ সম্মিলিতভাবে নেমে এসেছিল রাজধানীর রাজপথে। তারা সেদিন জিয়াউর রহমানকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্ত ও ক্ষমতায় অভিষিক্ত করে। কড়া পুলিশবেষ্টিত অবস্থায় জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে গিয়েও সাইফুর রহমান ও আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া বিএনপি’র কর্মী-সমর্থকদের দ্বারা প্রতিহত ও নাজেহাল হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন নি।
আমার লেখার কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। এর ফলে ব্যস্ত সময় কাটে আমার। আমি ভুলে থাকতে পারি আমার পরিবার, নির্জন একাকীত্ব ও চারদিকের বিশ্বকে।
বিক্রম শেঠ-এর লেখা ১৩৪৯ পৃষ্ঠার বৃহদাকার উপন্যাস এ স্যুইটেবল বয় এ যাবৎ অর্ধেকমাত্র পড়া হলো। যদিও বহুদিন আগে আর একবার পড়েছিলাম।
(চলবে..)