বৃহস্পতিবার ৮ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১০অর্থনীতি চাঙ্গা না হয়ে বরং ক্রমশ পেছনের দিকে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের জেলে না। পুরে ও যাদের ধরা হয়েছে তাদের ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি ক্রমশ জোরদার হচ্ছে।
শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের উচ্চতম সংগঠন ফেডারেশন অব চেম্বারস অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে ৫০ হাজার টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা দায়ের হাস্যকর। অথচ জাতীয় বুর্জোয়াবাদের এই শিল্পপতি দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা নিজেই দিয়ে থাকেন।
যাই হোক, মিন্টু ও আরেকজন শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটু আজ জামিনে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এই ঘটনা অন্যান্য ব্যবসায়ীকেও খানিকটা স্বস্তি দেবে।
শুক্রবার ৯ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১১নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। সরকারপন্থি সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক আজ কড়া ভাষায় লিখেছে: “লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম।” গত দশ মাসে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ২৭০ শতাংশ। একবছর আগে ভোজ্য তেলের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৪০ টাকা, এখন তা হয়েছে ১১০ টাকা। লোকজন বলছে, জরুরি আইন জারির আগে তাদের অবস্থা ছিল এখনকার চেয়ে অনেক ভালো।
শনিবার ১০ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১২আজ আমানের জন্মদিন। এদিন আমাদের প্রথম সন্তান আসিফেরও জন্মদিন।
রাতের সময়টা হিসাব করলে আজ হাসনারও জন্মদিন। আসিফ ও আমান দু’জনেরই জন্ম হয়েছিল ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আসিফ ১৯৭৩ ও আমান ১৯৭৬ সালে। আসিফের জন্মকালে আমার বাবা ছিলেন জীবিত। তিনি দাদা হয়ে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। তিনি কাঁচঘেরা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে সদ্যপ্রসূত চোখ বন্ধ অবস্থায় আসিফকে দেখামাত্র আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য আজান দিয়েছিলেন। আসিফের স্বভাব ছিল একদম আমার মতো, চঞ্চল ও উদ্যমী। চার বছর বয়সেই সে রাজনৈতিক বৈঠকের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতো ও গাড়িতে বসে টেপে বাজানো আমার বক্তৃতা শুনতো। আমার সাথে জনসভায় যেত, গাড়িতে বসে আমার বক্তৃতা শুনতো। বাসায় থাকতে তার অভ্যাস ছিল সচিৎকারে নানা ধরনের সেøøাগান দেওয়া আর দুর্দান্ত বেগে সাইকেল চালানো। সবসময় সে ছিল বন্ধুভাবাপন্ন ও হাসিখুশি।
কিন্তু ক্রমশ সে বুকে ব্যথা অনুভব করছিল। এক সময় সিঁড়ি বেয়ে আর সে ওপরে উঠতে চাইতো না। দৌড়ানো ও সাইকেল চালানো দিলো কমিয়ে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগলো তার। লন্ডন ও বস্টনে চিকিৎসার পরেও ১৯৮০ সালের ৩০শে মার্চ সাড়ে ৬ বছর বয়সে ঢাকায় সে মারা যায়।
আসিফের মতো আমানেরও হাইপার গ্লাইসিনিমিয়ার জেনেটিক্যাল সমস্যা রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম হলো এই যে, আসিফ একই সাথে আক্রান্ত হয়েছিল পালমুনারি হাইপারটেনশনে যা ছিল তার মৃত্যুর তাৎক্ষণিক কারণ। চার বছর বয়স নাগাদ আমান কোনো শক্ত খাবার খেতে পারতো না, হাঁটতে বা ভালো করে ঘুমাতে পারতো না। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে খ্যাত, বস্টন চিল্ড্রেন হাসপাতালে ডাক্তাররা আমানের টনসিল, অ্যাডেনয়েড এবং সবগুলো দাঁত তুলে নেওয়ার পরই আমান ক্রমশ খেতে, ঘুমাতে ও হাঁটতে শুরু করে ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দিনে দিনে বেড়ে উঠতে থাকে। আমার আত্মজীবনীতে ওদের সম্পর্কে আরো বিশদভাবে আমি লিখেছি। আমার জীবনের সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি হলোÑ আসিফের অকালমৃত্যু এবং সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত হলো যখন আমি আমানের নিষ্পাপ মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখি। সে সময় আমার ইচ্ছা হয় বাকি সারা জীবন আমি তাকে বুকের মধ্যে ধরে রাখি। আমান একজন প্রতিবন্ধী, কিন্তু সে হলো আমার জীবনের সূর্যালোক।
রবিবার ১১ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১৩আজ হাসনার জন্মদিন। আমরা এ দিনটি পালন করি না বললেই চলে, কারণ আগের রাতেই জন্ম নিয়েছিল আমার দুই সন্তান আসিফ ও আমান তাদের জন্মদিন একসাথেই করা হয়।
হাসনার সাথে প্রথম দেখার দিনটি আমি ভুলতে পারি না। আমি তখন যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন করার গর্বে বুক উঁচু করে ফিরে এসেছি আর হাসনা যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে, ছুটি উপলক্ষে এসেছে ঢাকায়। বন্ধু ক্যাপ্টেন হুদার বাসায় এক পার্টিতে আমাদের দেখা। সারা রাত আমরা কথা বলেছি। তারপর প্রায় সারা বছর রোমান্সের পর ১৯৭২ সালের ২২শে ডিসেম্বর আমরা আবদ্ধ হয়েছি বিবাহবন্ধনে। আমার প্রতিটি দুর্দিনে আমার পাশে দাঁড়িয়ে তার ভালোবাসা, ধৈর্য ও ত্যাগের ঔজ্জ্বল্যতা, আমার সন্তানদের দু’হাতে আগলে রেখে মা ও স্ত্রী হিসেবে সে যে কোনো মহিলার জন্য চির অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রথম সন্তানের মৃত্যু, আমানের প্রতিবন্ধকতাজনিত উন্মাদনা, আনার তিন বছরেরও বেশি সময় অ্যানোরেঙ্কিয়ায় ভোগার কালে চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ডে ঘন ঘন এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে বদলির কারণে শিক্ষাকাল ব্যাহত হওয়ার মুখেও সন্তানের মা হিসেবে হাসনা তার ধৈর্য ও দৃঢ়তায় দুই সন্তানের জন্য কেবল উল্লেখযোগ্য উন্নতিই নিশ্চিত করেনি। অর্জন করেছে আমার অন্তরের উৎসারিত শ্রদ্ধা। তার অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সে-ই আমার জীবনের প্রিয়তম মানুষ, আমার চিরন্তন সঙ্গী।
সোমবার ১২ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১৪সম্প্রতি আওয়ামী লীগের তরফ থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে। এটা অনেকটাই রহস্যে ভরা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সাড়ে তিন বছর ওরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। যারা গণহত্যা চালিয়েছে ও তাদের সহযোগিতা করেছে তাদের বিচারের জন্য সে সময় একটা আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং দালাল বা সহযোগী হিসেবে একজনকেও সাজা দেয়নি। ১৯৯১-৯৫ সালের পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দল হিসেবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে তখন আজ যাদের যুদ্ধাপরাধী বলা হচ্ছে সেই জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অংশীদার। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারে অধিষ্ঠিত থাকাকালে একদিনের জন্যও তারা এ ইস্যু নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। এককথায় বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো আওয়াজ তোলেনি। এখন হঠাৎ করে এ ইস্যু ওঠানোর রহস্য কি? আইন উপদেষ্টা মইনুল হোসেন অভিযোগ করেছেন যে, কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা বানচাল করার লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ এই ইস্যুটি উত্থাপন করেছে।
মঙ্গলবার ১৩ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১৫আমরা বেশি না হলেও অন্তত সমানভাবে দেশের বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না এবং যে মারাত্মক ভুল আমরা করেছি তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে। হাসিনা ও খালেদার মধ্যে পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণাবোধ এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঘাটতি হলো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বর্তমানের ঘূর্ণায়মান এই দুর্যোগের মূল কারণ। ক্ষমতার চরম মোহ এবং আত্মোপলব্ধির ঘাটতির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাদের কর্মকাণ্ডে । দু’পক্ষেরই আমরা যারা চারদিক থেকে ওদের ঘিরে রেখেছি সেই আমাদেরও অবশ্যই উপরোক্ত বদনাম ও নিন্দার ভাগীদার হতে হবে।
আমার মাদক দ্রব্যসংক্রান্ত মামলা হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কপি নিম্ন আদালতে চলে আসায় আগামী বছরের এপ্রিল মাস নাগাদ আমাকে আর আদালতে হাজিরা দিতে হবে না।
বুধবার ১৪ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১৬জেনারেল মইনের সরকার কী করতে চান ফখরুদ্দীনের প্রশাসনের তা জানা নেই। আমি সরকার বলতে মইনের সামরিক সরকার ও প্রশাসন বলতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারকে বোঝাতে চাইছি। কোনো কোনো সময় এরা সমান্তরালভাবে কাজ করে তবে বেশির ভাগ সময়েই সামরিক সরকারের গোপন শক্তিধরেরা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্থির করে সবরকমের রাজনৈতিক কর্মপন্থা- কারণ তাদের রয়েছে বন্দুকের জোর। সম্প্রতি টাস্কফোর্স তাদের ক্ষমতার পরিধি চারদিকে বিস্তৃত করে সকল প্রতিষ্ঠানেই তাদের আধিপত্য স্থাপন করেছে। ক্ষমতা মানুষকে এমনভাবেই অন্ধ করে দেয়।
বৃহস্পতিবার ১৫ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২১৭নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগলোতে সৎ ও যোগ্য লোকের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এখন জোরেশোরে প্রচার করা হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যে সামরিক সরকারের প্রেরণা ও অর্থানুকূল্যে কতিপয় মুখচেনা সিভিল সোসাইটি দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে এই আপ্তবাক্য। এতে বোঝানো হচ্ছে যে, আজ অবধি যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছেন এবং দেশ পরিচালনা করেছেন তাদের কেউ সৎ কিংবা যোগ্য ছিলেন না। কিন্তু নিজ দলের কর্মী ও সমর্থকদের সমর্থন নিয়ে এবং দলের জন্য জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো এত অধিকসংখ্যক সৎ ও যোগ্য লোক কোথায় ও কীভাবে পাওয়া যাবে সেরকম দিকনির্দেশনা এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। অথচ গণতন্ত্রে একজন প্রার্থী সৎ এবং যোগ্য কি না তার পরিমাপের একমাত্র নির্ধারক হলেন ভোটাররা। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে তাকেই সবচাইতে সৎ ও যোগ্য বলে ধরে নিতে হবে যারা জনগণের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হবেন। একইভাবে দলের পক্ষ থেকে কোন প্রার্থী জনগণের কাছে সবচাইতে সৎ ও যোগ্য হিসেবে জনসমর্থন পাবেন তা নির্ধারণ করে দেবে তার দল। নিজ দলের কর্মী ও সমর্থকদের সমর্থন নিয়ে এবং দলের প্রতি ত্যাগ ও আনুগত্য প্রদর্শন করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মতো এত অধিক সংখ্যক সৎ ও যোগ্য লোক কোথায় ও কীভাবে পাওয়া যাবে তারও কোনো হদিস নেই। নাগরিকদের মধ্যে যে কেউ একটি নির্বাচনী পদে অভিষিক্ত হতে চাইলে তাকে উপরোক্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই নিজ দলের মানদণ্ডের ভিত্তিতে মনোনীত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর তা না হলে বড়জোর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করা। এর বাইরে অন্য কারো এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকারের সুযােগ নেই।