দুটি ছবি। লড়াইয়ের চিত্র। এ লড়াই কোন যুদ্ধ জয়ের জন্য নয়। আবার কোন অধিকার আদায়েরও নয়। এ যুদ্ধ নিয়ম ভাঙার। এ যুদ্ধ সরকারি আদেশ অমান্যের। কারণ, ঈদ বলে কথা। সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে বাড়ি যেতেই হবে।
কদিন ধরেই মাওয়া ফেরি ঘাটের এ চিত্র। শঙ্কা ছিল কোন দুর্ঘটনার। তাই ঘটল গতকাল বুধবার। ভিড়ের চাপে লাশ হয়েছে ৫ জন জলজ্যান্ত মানুষ। যে ঈদে বাড়ি যেতে এতো লড়াই সে ঈদ তাদের করা হলোনা। এসব পরিবারে ঈদের আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে। এ দায় কার? বড় প্রশ্ন হলো এমন কাণ্ড দেখেও কেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি? কেন তারা এতো মানুষের ফেরিতে উঠা নামায় সতর্ক থাকেনি? কড়া পাহাড়ার ব্যবস্থা নেয়নি। সেটা করলে হয়তোবা দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। বাংলাদেশে যেন নিয়ম করাই হয় সেটা ভাঙার জন্য। আর তা দেখতে দেখতে সবাই অভ্যস্থ। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বার বার বলা হয়েছে যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। এজন্য এবার কল কারখানায় ঈদের ছুটিও বাড়ানো হয়নি। তারপরও নাছোড়বান্দা মানুষ। তাদের বাড়ি যেতেই হবে। চিড়াচেপ্টা হয়ে ফেরিতে উঠতেই হবে! লকডাউনের মধ্যে গাড়ি, লঞ্চ বন্ধ জেনেও রাষ্টের আইনের তোয়াক্কা না করে সবারই বাড়ি যেতে হবে! একশ টাকার ভাড়া হাজার টাকা হলেও আপত্তি নেই। তখন টাকারও অভাব হয়না। এমনে চিৎকার করে- লকডাউন হলে খাব কি? দেশের অন্য সড়কের চিত্র কি? মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার চলছে। তিনগুণ, চারগুণ ভাড়া দিয়ে মানুষ বাড়ি ফিরছে। তাও আবার ১০ জনের সিটে ১২,১৩,১৪ জন গাদাগাদি করে যাচ্ছে। সেখানে করোনার ভয় নেই। ভয় শুধু বাস আর লঞ্চে? যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ না হলে ফেরিঘাটে এমন গ্যাদারিং হতোনা।
কথা হলো, নিয়ম করে লঞ্চ চলাচল আর এক সিট ফাঁকা রেখে আন্তজেলা বাস চলাচলের অনুমতি উত্তম নাকি ফেরিঘাটে এমন ভিড় উত্তম? লাশ দেখা উত্তম? কেউ কেউ বলছেন, ঈদে বাড়ি যাবনা? আনন্দ করবনা? তাদের এটা বুঝানো মুশকিল এখন সময় ভালনা। করোনা বিশ্বকে ওলটপালট করে দিয়েছে। জেরবার করে দিয়েছে অর্থনীতি। সামাজিক রীতি-নীতিকেও আঘাত করেছে। সবচেয়ে বড় কথা- ঢেকে দিয়েছে পৃথিবীর সকল মুখ। এ এক অন্যরকম পৃথিবী। অন্যরকম কালচার। অন্যরকম সমাজ ব্যবস্থা। এর সবকিছুই হয়েছে নিজেকে রক্ষার জন্য। অদৃশ্য ভাইরাস করোনার হানা থেকে রক্ষার জন্য। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, রাশিয়া, ভারত কোনো দেশই বাদ যায়নি। আর চীন দিয়ে তো এর যাত্রাই শুরু হয়। এ ভাইরাস কীভাবে কি করে এতদিনে সবারই জানা হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি যা করেছে ভালোবাসাকে ধুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। পিতা যখন বাইরে থেকে ঘুরে ঘরে প্রবেশ করেন, তার ছোট্ট সন্তান তখন দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে বাবার কোলে উঠতে। কিন্তু পিতা পারছে না আদরের সন্তানকে টান দিয়ে কোলে নিতে। এক বছরে ভয়-আতঙ্ক অনেকটা কমলেও ভালোবাসা বাড়েনি একটুও। সচেতনরা মুখে মাস্ক পরে বেরুলেও এমন অনেকে আছেন করোনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। মুখে মাস্ক ছাড়াই ঘুরাঘুরি করেন। আড্ডা দিচ্ছেন। এরা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। বার বার সতর্ক করেও তাদের বুঝানো সম্ভব হচ্ছে না। হাটবাজার, স্টেশন, ফেরিঘাট সর্বত্র মানুষের জটলা। ঈদে বাড়ি যেতে মাওয়া ফেরিঘাটে ফেরির এমনতর চিত্র বিশ্বকে অবাক করে দেয়। যেখানে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে সর্বনিম্ন তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখার কথা, সেখানে গা-ঘেঁষে ফেরি পেরুনোর দৃশ্য করোনাকে যেন স্বাগতম জানানোর আয়োজন। এ আয়োজন কতো বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে তা কি কল্পনা করা যায়? পাশের দেশ ভারতের দৃশ্য দেখে আমরা এখনো কি সচেতন হবো না? নাকি মরণত্যাগী হয়ে দৌড়াব সামনের দিকে? বাড়ি যাওয়ার যুদ্ধে শরিক হয়ে লাশ হবো? আবারো বাড়ি থেকে ফেরার পথে এ দৃশ্য যেন দেখতে না হয়। এর আগেই কঠিন শর্ত সাপেক্ষে বাস, লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করা হউক। নিয়ম যেন ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বাস্তবায়ন যেন কঠোরভাবে হয়।