× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫১) / ‘স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে এহেন সংকট সামাল দেয়া অসম্ভব’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
১৮ মে ২০২১, মঙ্গলবার

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২২৫
হাসিনার রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যারিস্টার রফিক-উল হক রাজনীতিবিদদের হেনস্তা করতে গিয়ে দুর্নীতি ও আইনের অপব্যবহার করার জন্য কমিশনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। তিনি বলেন, নীতি দমন কমিশন মনে করছে যে, তারা আইনের ঊর্ধ্বে এবং নিজেদের প্রণয়ন করা আইনই তাদের ব্যবহার করা প্রয়োজন বলে মনে করছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন ৮ ও ১১ নং বিধির বরখেলাপ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শুনানির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। প্রথমে প্রাথমিক তথ্য রিপোর্ট তৈরির আগে এবং পরবর্তীকালে চার্জশিট দাখিলের আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আইনের বিধান অনুযায়ী এ নিয়ে অপরাধ উল্লেখ করে নিজস্ব আইনজীবীর উপস্থিতিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অভিযুক্তকে পূর্বাহ্নে নোটিশ পাঠাতে হবে। কিন্তু জরুরি আইনের সুযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করছে যে, তারা আদালতের কোনো প্রতিবন্ধকতার অনুপস্থিতিতে অব্যাহতভাবে এই আইনের পরিপন্থি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারে। আমার আগামী রিট আবেদনে অন্যান্য পয়েন্টের পাশাপাশি এই মূল্যবান পয়েন্টটিও আদালতে পেশ করা হবে।

শনিবার ২৪ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২২৬
‘সিডর’ আক্রান্ত দুর্গতদের সাহায্যার্থে ২০টি হেলিকপ্টারসমেত একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ অচিরেই বাংলাদেশের জলসীমায় এসে ঢুকবে। দু’টি হসপিটাল-বিমানে করে পাকিস্তানি চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যে এসে আহতদের শুশ্রুষা ও মৃতদের সৎকারে সাহায্য করছেন।
ভারত থেকে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী এসেছে এবং অন্যান্য বহু ধরনের ত্রাণসামগ্রী এখনো আসার পথে রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা অবশ্যই সাহায্য করে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা থাকে নিতান্তই অপ্রতুল। সরকার সবসময়েই নিজেদের সুবিধার্থে এসব তৎপরতা প্রচারকার্যে ব্যবহার করে। প্রকৃতপক্ষে এহেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হলো সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক। অথচ দেশের বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের কারণে সরকার জনগণের সেই উদ্যোগ নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশে বিগত বন্যার সময়ও একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটতে দেখা গিয়েছিল। ভয়-ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে জনগণ সরকারের কোনো কর্মতৎপরতায় শরিক হচ্ছে না। খালেদা ও হাসিনা জেলে অন্তরীণ থাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর উৎসাহে ভাটা পড়েছে।
আজ আমার দর্শনার্থীদের আসার দিন। সারা সপ্তাহ আমি এই দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। সুপ্রিম কোর্টে মামলার ব্যাপারে খবর দিতে এসেছিল ব্যারিস্টার খোকন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল আত্মপ্রত্যয়ী। বড়দা ও এডভোকেট মিজান এসেছিল আমার ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে। হাসনা ও আমার ছেলেমেয়েদের আরো অনেক খবর ওরা আমাকে জানিয়ে গেছে।

রবিবার ২৫ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২২৭
‘সিডর’-এর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দেশ এখন ব্যাপক খাদ্য সংকটের মুখোমুখি। খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লক্ষ টন। ৫০ লক্ষাধিক মানুষ এখনো গৃহহীন, খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন এবং চিকিৎসাহীন। বিশাল সংখ্যক জনগণ পরিণত হয়েছে ভিক্ষুকে। নীরব দুর্ভিক্ষের পালা চলছে। স্বৈরাচারী একটি সরকারের পক্ষে এহেন সংকট সামাল দেয়া অসম্ভব।

সোমবার ২৬ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২২৮
যা বলেছিলাম তাই হয়েছে। অ্যাপিলেট ডিভিশন বার্জ মাউন্টেড পাওয়ার পাল্টে মামলায় হাইকোর্ট থেকে শেখ হাসিনার জন্য মঞ্জুরকৃত জামিন বাতিল করেনি, আদালতে বিচারকার্য শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে। আমি আশা করবো যে, আদালত কোনো ভীতি বা হুমকির মুখে এ আদেশ দেয়নি। জনগণ কখনো চান না যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া হোক। আদালতের পবিত্র দায়িত্ব হলো জনগণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, স্বাধীনতার পথ অবরুদ্ধ করা নয়।
দেশের উচ্চতম আদালতের কাছে জনগণ সুস্পষ্টভাবে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের চাপের মুখে বাংলাদেশের আদালতের ক্ষেত্রে এ সত্যটি আর প্রযোজ্য হতে দেখা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচারকদের বিশেষ করে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে ঐকান্তিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার অভাব। এর পরে দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বা পৃথক্করণ নিয়ে আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে কী লাভ?

মঙ্গলবার ২৭ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২২৯
জেলখানায় হাজার রকমের যন্ত্রণা ও হতাশার মধ্যেও একজন বন্দি শুধু নানা রকমের আশা ভরসায় দিনরাত অতিবাহিত করে। কোনো আশায় ছাই পড়লে সে অনুগামী হয় নতুন কোনো প্রত্যাশার। চরমতম বিচ্ছিন্নতাময় এই জীবনে আশা-প্রত্যাশা একজন বন্দির প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী। ‘পলাশীর যুদ্ধ’- কবিতায় নবীনচন্দ্র সেন লিখেছেন-
ধন্য আশা কুহকিনী তোমার মায়ায়
মুগ্ধ মানবের মন মুগ্ধ ত্রিভূবন।
বিগত ৩৬ বছরে যা ঘটেনি আইন উপদেষ্টা মইনুল হোসেন সে কাজটি করেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, তিনি অযোগ্য ও বিতর্কিত বিচারকদের লম্বা একটি তালিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করেছেন। বিচারকরা অযোগ্য, বিতর্কিত এমনকি দুর্নীতিবাজও হতে পারেন। কিন্তু তা সামলানোর জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়াও রয়েছে। এক্ষেত্রে উপদেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নতর এবং এ কারণে প্রতিক্রিয়াও ছিল তীব্র। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর এ ছিল এক সরাসরি আঘাত এবং সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারকের জন্য অপমানজনক। উপরন্তু এর মাধ্যমে বিচারকদের বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের ওপর এমন চাপ দেওয়ার প্রয়াস চালানো হয় যাতে করে অন্তরীণ রাজনীতিবিদেরা কোনোভাবে জেলের বাইরে আসতে না পারেন। অন্যথায় সরকার বিচারকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের হুমকি দেন। এ ঘটনা সর্বস্তরের বিচারপতির মধ্যে রোষ, ক্রোধ ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। যা তারা আগে কখনো দেখেনি।
প্রায় একই সময়ে তথাকথিত আইন বিশারদ ড. কামাল হোসেন তার স্বভাবসুলভ বুদ্ধিবৃত্তিক অভিব্যক্তিতে হতাশা ব্যক্ত করে অন্তরীণাবদ্ধ রাজনীতিকদের জন্য স্বাভাবিক আইনের অনুপস্থিতিতে জরুরি আইনের আওতায় ক্যাঙ্গারু কোর্টে যথাযোগ্য শাস্তি প্রদানে সবরকম সহযোগিতা দানের ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সহায়তাদানের প্রস্তাব করেছেন। চমৎকার! সাবাস কামাল হোসেন।

বুধবার ২৮ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২৩০
যেমন আশঙ্কা করেছিলাম তেমনটাই হয়েছে। আমার সম্পত্তি ও আয়ের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার ওপরে হাইকোর্ট বিভাগের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ অ্যাপিলেট ডিভিশন স্থগিত করে দিয়েছে, যেখানে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে আমার ব্যক্তিগত-পারিবারিক খাতে ভুয়া কতকগুলো ব্যয়ের ফর্দ দেখিয়ে অভিযোগ আনা হয়েছিল যার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে কোনো বিধান ছিল না। যখন তারা দেখতে পেরেছিল যে, আমার ঘোষিত সম্পত্তি আমার আয়ের চাইতে অনেক কম তখন একটা কাল্পনিক ‘ব্যয়’ খাত সৃষ্টি করেছে। কোনো আইন, বিধি বা নোটিশেই দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক উপরোক্ত ‘ব্যয়’ সম্পর্কে কোনো বিবরণী চাওয়া হয়নি এবং সংশ্লিষ্ট ফর্মেও এর কোনো উল্লেখ ছিল না। এভাবেই জামিন বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ডিভিশনের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকে রদ করে দেওয়া হয়েছে যা অতীতে আপিল বিভাগের প্রচলিত ঐতিহ্য ও প্রথার শুধু নজিরবিহীন ব্যত্যন্তরই নয়, বরং তা সংবিধানের ওপর জরুরি আইনের খবরদারি ও অবস্থানকে স্বীকার করে নেওয়া।
অ্যাপিলেট ডিভিশনের এ ধরনের আচরণ আমাদের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।

বৃহস্পতিবার ২৯ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২৩১
আমি নিতান্তই হতাশা বোধ করছি। আমার মামলার বিষয়টি পুরোপুরি আইনগত। তা বিচারকের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়।
বিষয়টি এত স্বচ্ছ যে, আপিল ডিভিশন থেকে এর ওপর হস্তক্ষেপের কোনো কারণ ছিল না। কার প্ররোচনায় তারা এ কাজটি করেছেন আমার তা জানা নেই। শেষ পর্যায় অবধি এ অবৈধ বিষয়টির বিরুদ্ধে আমাকে লড়াই করে যেতে হবে।
গতরাতে আমার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটা ঘটনা ঘটেছে। অনেক বছর পরে, সাধারণত ঠিক যে সময়টাতে আমার ঘুম ভাঙে, সেই ভোর ৪টার দিকে আমি আমার পরম পূজনীয় বাবাকে স্বপ্নে দেখেছি। তাঁর হাতে ছিল নিম গাছের ডাল দিয়ে তৈরি দাঁতের মাজন। আমি যে ঘরটিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম ধীরে ধীরে তিনি সেই ঘরটাতে প্রবেশ করছিলেন। ধীর পায়ে সামনে এসে তিনি যখন আমার দিকে একটি দাঁতন এগিয়ে দিচ্ছিলেন সে সময় তিনি লক্ষ্য করলেন আমার চোখে পানি। অত্যন্ত স্নেহভরে নিজের দু’হাত দিয়ে তিনি আমার চোখের পানি মুছে দিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? আমি বললাম, খুব জলদিই আমার বিচার শুরু হবে। তিনি বললেন, তাতে কি? আমি বললাম, এগুলো সবই ক্যাঙ্গারু কোর্টে। আমাকে ওরা সাজা দিয়ে দেবে। আমার বাবা এর কোনো জবাব দিলেন না। এরপর আমার ঘুম ভেঙে যায় ।

শুক্রবার ৩০ নভেম্বর ২০০৭ দিন ২৩২
নির্বাচন কমিশন আবার তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে আরেকটি বিতর্ক সৃষ্টি করছে ও নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে খাটো করে তুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকে তারা দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সেগুলোতে দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রায়ণের নির্দেশ দিয়েছে। সংবিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো- ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। দলের গঠনতন্ত্র হলো একটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর ওপর নির্বাচন কমিশনের কোনো ধরনের এখতিয়ার নেই। নির্বাচন কমিশনের প্রধান এমনকি কোন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে কোন ধরনের গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করা হয়েছে সে সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। অথচ তিনি ভালো করেই জানেন যে, বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া থাকুক বা না থাকুক রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। কেবলমাত্র এ নিয়ে সন্দেহের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা এবং সরকারের পূর্ব পরিকল্পনার বাস্তব রূপদানে সাহায্য করার লক্ষ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার জন্যই নির্বাচন কমিশন এই বিতর্কের উদ্ভাবন ঘটিয়েছে।

(চলবে..)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর