× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কে বড়?

মত-মতান্তর

শামীমুল হক
১৯ মে ২০২১, বুধবার

আচ্ছা বলুন তো কে বড়? বিদ্যা নাকি বুদ্ধি?  লক্ষ্মী না সরস্বতী?  ধর্ম না কর্ম? গল্পে গল্পে এর সমাধান বের করা যাবে কি? দেখি-ই না, সমাধান পাওয়া যায় কিনা? এক গরিব ব্রাহ্মণের একমাত্র ছেলে। বড় আদরের। কিন্তু গরিব হওয়ায় ব্রাহ্মণ তাকে খাবার দেয়াই কষ্ট হয়। কাপড়-চোপড় দেয়া তো অনেক পরের কথা। এজন্য ব্রাহ্মণ পুত্রের মনেও অনেক যন্ত্রণা। কারণ আশপাশে তার পরিচিতরা, বন্ধু-বান্ধবরা নতুন জামা-কাপড় পরে বের হয়। আমার বাবা আমাকে দিতে পারে না। তাই তাদের সঙ্গে আমি প্রাণ খুলে ঘুরতে পারি না।
লজ্জা লাগে। এভাবে দিন চলতে থাকে। মনের দুঃখে একদিন ব্রাহ্মণ পুত্র বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। কাউকে কিছু বলে যায়নি। ব্রাহ্মণ পরিবার অনেক খুঁজেও তার সন্ধান পায়নি। তাই তার আশা ছেড়ে দেয়। ওই ব্রাহ্মণ পুত্র বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেশের রাজধানী শহরে পৌঁছে। সেখানে ফুটপাতে টোকাই ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এভাবে দিন চলতে থাকে। একদিন রাজবাড়ীতে এক অনুষ্ঠান হচ্ছে। ওই অনুষ্ঠানে বহু লোকের সমাগম। ব্রাহ্মণের ছেলেও সেখানে যায়। রাজদরবারে রাজা, উজির, নাজির সবাই উপস্থিত। অনুষ্ঠান চলছে। হঠাৎ রাজার নজর গিয়ে পড়ে ব্রাহ্মণের ছেলের ওপর। রাজা তাৎক্ষণিক হুকুম দিলেন, ওই ছেলেকে আমার কাছে নিয়ে আসো। হুকুম মতো কাজ। ছেলেটিকে রাজার সামনে নিয়ে আসা হলো। ছেলেটি রাজাকে সালাম দিয়ে দাঁড়ালো। প্রথমেই রাজা ছেলেটির কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। ছেলেটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ফের রাজা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা-বাবা কোথায়? এবার ছেলেটি বললো, দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। রাজা তার উজিরের সঙ্গে পরামর্শ করলো ছেলেটিকে রেখে দেয়ার। কারণ রাজার কোনো পুত্রসন্তান নেই। ছেলেটিও দেখতে রাজপুত্রের মতো। উজিরের পরামর্শে রাজা তাকে পুত্র হিসেবে সেই ব্রাহ্মণের ছেলেকে রেখে দেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজা হুকুম জারি করেন এই ছেলেকে রাজপুত্রের মতো সাজিয়ে দিতে। এবং এখন থেকে সবাই যেন তাকে রাজপুত্র হিসেবে মান্য করে। হুকুম তামিল হলো। তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। পড়া-লেখায় অনেক ভালো করছে সে। একের পর এক ক্লাস ডিঙিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠানো হলো। বিদেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে এলো। রাজা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। ছেলেকে ডেকে বললেন, বাবা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছো। এখন রাজ্য পরিচালনা করতে হবে। তবে, আমি তোমাকে একটি অংক দেবো। এই অংকটা যদি করতে পার তবেই তোমার হাতে রাজ্যের ভার তুলে দেবো। ছেলেও রাজি হলো। রাজা অংক দিলেন। ছেলে অংক করতে আরম্ভ করলো। কিন্তু ফল ঠিকমতো হচ্ছে না। রাজা তাকে সময় দিলেন। একদিন দুই রাত সময় দেয়া হলো। বলা হলো- এই সময়ের মধ্যে অংক মেলাতে না পারলে তুমি আমাকে কোনোদিন মুখ দেখাবে না।
ছেলে সময় নিয়ে অংক করতে থাকল। কিন্তু না। অংকের ফল মিলছে না। এরই মধ্যে সময়ও শেষ হয়ে গেছে। রাজার কথা মতো সে আর মুখ দেখাবে না রাজাকে। ছেলে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছে। সারা রাত বন জঙ্গল পেরিয়ে অন্য দেশে পা রেখেছে। তার শরীর বড় ক্লান্ত। পেটে ক্ষুধা। হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটি খাবার হোটেল দেখতে পেলো। সেখানে গিয়ে সে কিছু খেলো। খাওয়ার পর শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে পেয়েছে। তখনই মনে পড়লো তার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। খাবারের বিল দিবে কীভাবে? আস্তে আস্তে হোটেল ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বললো, ভাই আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। তবে একটা আংটি আছে আমার আঙ্গুলে। এই আংটি বিক্রি করে আপনাকে টাকা দিয়ে যাবো। ম্যানেজার বললো, কোথায় তোমার সেই আংটি। তখন সে আংটি আঙ্গুল থেকে খুলে ম্যানেজারের হাতে দেয়। ম্যানেজার কিছুক্ষণ আংটিটি নেড়ে চেড়ে বললো, এই আংটি দিয়ে তোমার খাবারের টাকা পরিশোধ হবে না। তখন ছেলেটি বললো, এই আংটির দাম অনেক। আমার সঙ্গে একজন লোক দেন, আমি আংটি বিক্রি করে আপনার টাকা দিয়ে দেবো। ম্যানেজার বললো, আমি লোক রাখিনি যে, কাস্টমারের টাকা উঠিয়ে এনে দেবে। যদি ভালো চাও তাহলে তুমি এখান থেকে চলে যাও।  ছেলেটি এখান থেকে বেরিয়ে এক জহুরির দোকানে গিয়ে বললো, আমার একটি মূল্যবান আংটি আছে। তা বিক্রি করতে চাই। কোথায় সে আংটি। তখন সে ঘটনা খুলে বলে ম্যানেজারের কাছ থেকে আংটি আনতে গেল। কিন্তু ম্যানেজার আর আংটি ফেরত দেয়নি। বরং তাকে উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগলো। এখানে শোরগোল শুনে পেয়াদারা এলো। হোটেল ম্যানেজার পেয়াদাকে জানালো সে খাবার খেয়ে টাকা দিতে পারেনি। আবার মিথ্যা বলছে। এ কথা শুনে রাজার পেয়াদারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার ঠিকানা হয় কয়েদ খানায়। মানে কারাগারে। সেখানেই তার দিন কাটতে থাকলো। ওই রাজ্যে ছিল ৬ জন খেলোয়াড়। মাঠে খেলতে গিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হলো ভীষণ ঝগড়া। কে প্রধান হবে- এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি থেকে ঝগড়ার সৃষ্টি। কারণ এই ৬ জনই তাদের বড় মনে করছে। তারা স্থির করলো তাদের মধ্যে কে বড় তা ঠিক করতে রাজার কাছে যাবে। রাজাকে বিচারের ভার দেয়া হবে। যেই কথা সেই কাজ। সবাই রাজার কাছে গেল। তারা রাজার কাছে বিচার প্রার্থী হলো। বললো, মহারাজা আমরা ৬ জনই নিজেকে বড় দাবি করছি। আর কে আসলে বড় সেটা আপনার দরবার থেকেই ফয়সালা করে দেবেন। আমরা ৬ জন হলাম- ধর্ম, কর্ম, বিদ্যা, বুদ্ধি, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। একজনকে বড় করে দিতে হবে। এবং কীভাবে সে বড় হয়েছে তা আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে। এ কথা শুনে রাজা উজির সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ডাকা হলো জরুরি মিটিং। কিন্তু কিছুতেই কে বড় এটার ফয়সালা করা যাচ্ছে না। ৬ জনের কাছ থেকে রাজা কিছু সময় চেয়ে নিলেন। এক সপ্তাহের সময় দেয়া হলো। ৬ জন ঘোষণা দিলেন যদি এক সপ্তাহের মধ্যে এর ফয়সালা দিতে না পারেন তাহলে এ রাজ্যের ভীষণ ক্ষতি হবে। রাজ্য ধ্বংস করে দেয়া হবে।
রাজা মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কি করবে উপায় না পেয়ে সমস্ত রাজ্যে এলান করে দেয়া হলো এই বিচার যে করে দিতে পারবে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে। না। কোনো সাড়া নেই। রাজা অস্থির হয়ে উঠলেন। এবার এলান করলেন- যে ব্যক্তি এর সুষ্ঠু বিচার করে দিতে পারবে তাকে অর্ধেক রাজ্য লিখে দেয়া হবে। এবারও একই অবস্থা। কোন সাড়া শব্দ নেই। এবার এলান করা হলো পুরো রাজ্যই তাকে দেয়া হবে। কিন্তু না। কোনো শব্দ নেই। সারা রাজ্যেই শুরু হলো অস্থিরতা। মানুষ-জন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে চিন্তায়। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সবার মুখে এককথা- রাজ্যে কিছুই থাকবে না। ধ্বংস করে দেয়া হবে। কয়েদ খানার পাশ দিয়ে ছাত্ররা এসব কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল। ওই ছেলে তা শুনে তাদের জিজ্ঞেস করলো তোমাদের কি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সব শুনে ওই ছেলে বললো, তোমরা আমাকে একটা খাতা আর কলম দাও। আমি কিছু লিখে তোমাদের রাজাকে দেবো।
কয়েদি লিখলো-
মহারাজা আমার কথায় যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনার ধর্ম, কর্ম বিদ্যা, বুদ্ধি, লক্ষ্মী আর সরস্বতীর বিচার করে দিতে পারি। আমার কথা হলো- আমাকে একদিনের জন্য বাদশাহ্ বানাতে হবে। খুব বড় একটা ময়দানে এর বিচারের আয়োজন করতে হবে। আর বিচারে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকে আসতে হবে। দেশের সকল কয়েদিকে একদিনের জন্য আজাদ করে দিতে হবে। বিচারের সময় কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। হাসতে পারবে না। কাঁদতে পারবে না। চিঠি পেয়ে রাজা তার উজির-নাজির সকলকে পাঠালেন ওই কয়েদিকে সসম্মানে রাজদরবারে নিয়ে যেতে। তারা গেলে কয়েদি বললো, আমি এখন যাবো না। আগে বিচারের সময় নির্ধারণ করে তারপর আসুন। আমি যাবো।
শুক্রবার বিকাল তিনটায় বিচার শুরু হবে। আয়োজন সম্পন্ন। কয়েদিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিচারের ময়দানে আনা হলো। তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে রাজ সিংহাসনে বসানো হলো। বিচারের ময়দানে উত্তেজনা। কি হয় তা নিয়ে। হাজির হলো বিচার প্রার্থী ৬ জনও। সিংহাসনে বসা কয়েদি বিচার প্রার্থীদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা সবাই বড়। তোমাদের আমিও সব সময় সম্মান করি। তবে এখন প্রকৃত বড় কে তা বের করে দেয়া হবে।
সিংহাসন থেকে কয়েদি বিচারক ঘোষণা দিলেন, ধর্ম, কর্ম, বিদ্যা, বুদ্ধি, লক্ষ্মী ও সরস্বতী তোমরা এক লাইনে দাঁড়াও। সঙ্গে সঙ্গে তারা দাঁড়িয়ে পড়লো। বিচারক একজনকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার নাম কি? জ্বি আমার নাম লক্ষ্মী। তুমি কি করো? আমি মানুষের ধন, সম্পদ, টাকা-পয়সা, ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি এসব দিয়ে থাকি।
বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি আমার বাবা ব্রাহ্মণের ঘরে ছিলা না?
ছিলাম।
তাহলে তুমি আমার বাবা ব্রাহ্মণকে টাকা-পয়সা দেও নাই কেন?
লক্ষ্মীর উত্তর, এটা হলো কর্মদোষ। বিচারক বললেন, তাহলে কর্ম তোমার চেয়ে বড়। তুমি এটা লিখ এবং স্বাক্ষর করো। লক্ষ্মী লিখলো, আমার নাম লক্ষ্মী। আমি কর্মের সঙ্গে পারি না। আমার চেয়ে কর্মই বড়।
সিংহাসনে বসে বিচারক আরেকজনকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার নাম কি? তুমি কি করো?
আমার নাম সরস্বতী। আমি মানুষের পড়া-লেখা, শিক্ষা-দীক্ষা দেই। আমিই সবার থেকে বড় মনে করি। বিচারক বলেন, আমিও মনে করি তুমিই বড়। কিন্তু আমাকে যখন বাবা অংক দিলো, তখন তুমি কোথায় ছিলে। সরস্বতী উত্তরে বললো, আমি ছিলাম। তবে তোমার কর্মের জন্য পারিনি। তাহলে লিখ এবং স্বাক্ষর করো। সরস্বতী লিখলো- আমার নাম সরস্বতী। আমি কর্মের সঙ্গে পারি না। আমার চেয়ে কর্মই বড়।
এরপর বিচারক আরেক জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কি? আমার নাম বুদ্ধি। আমি মানুষের যে কোনো কাজে বুদ্ধি দিয়া থাকি। কাজের সুবিধা করে দেই। এবার বিচারক বললেন, আচ্ছা আমি যেখানে পেটের ক্ষুধা নিয়ে খেতে গেলাম তুমি বুদ্ধি তখন কেন বলোনি আগে আংটি বিক্রি করো। তারপর খেতে যাও। বুদ্ধি তখন বললো, এটা তোমার কর্মে দেয়নি। বিচারক বললেন- তাহলে লিখ, আমি কর্মের সঙ্গে পারি না কর্মই আমার চেয়ে বড়।
এরপর এলো বিদ্যার পালা। বিদ্যার কাজ কি? উত্তরে বিদ্যা জানালো, আমি চিঠিপত্র, দলিল, বই-পুস্তক লিখে থাকি। বিচারক বললেন, আচ্ছা যখন হোটেল ম্যানেজারকে আংটি দিলাম, তুমি একটা কাগজে লিখে নিতে পারতে আমি আংটি দিলাম সে বুঝে পেয়েছে। তা করনি কেন? বিদ্যার উত্তর- আমি তোমার কর্মের জন্য পারিনি। তাহলে লিখে দাও- কর্মই তোমার চেয়ে বড়। বিদ্যা তা লিখে দিলো।
এরপর এলো ধর্মের কাছে। বললো, আমার নাম ধর্ম। আমি সব সময় ধর্ম ঠিক রেখে চলা ফেরা করি। বিচারক বললেন, আমি যখন ম্যানেজারকে আংটি দিলাম তার ধর্ম কোথায় ছিল। দুই পেয়াদার কি ধর্মও ছিল না। ধর্ম বললো, অবশ্যই ছিল। কিন্তু তোমার কর্মের জন্যই পারেনি।
সবার উদ্দেশে বিচারক বললেন, তোমাদের মধ্যে কর্মই সবার চেয়ে বড়। কর্ম যা করে তাই মেনে চলতে হবে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর