শনিবার ১ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৩একজন কোটিপতি এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে ৫০ হাজার টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্বলিত এক মামলায় তাকে কয়েক মাস ধরে জেলখানায় নাজেহাল করে সরকার তাদের হীন মনোবৃত্তির এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাথে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে, তিনি এখন বাংলাদেশ থেকে শুধু তার তিন কোটি ডলার মূল্যমানের বিনিয়োগই প্রত্যাহার করবেন না, দেশ ছেড়েই তিনি চলে যাবেন। ব্যবসায়ীদের ওপর এ ধরনের হামলা ও অপদস্থতার প্রতিক্রিয়া হবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর মারাত্মক হুমকিস্বরূপ, কারণ তার এই মনোভাব ও সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে দেশের গোটা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মানসিকতারই প্রতিফলন মাত্র। ব্যবসায়িক পরিবেশের ওপর চরমতম দুর্যোগ সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন সরকার প্রান্তিক অর্থনৈতিক সীমার এ দেশটির ওপর কি ধরনের আঘাত সৃষ্টি করছেন সে সম্পর্কে তারা বোধহয় ধারণাও রাখেন না। অন্যান্য সকল খাতেও চলছে একই ধরনের নৈরাজ্য। দেশের প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সাধারণ একজন ঠিকাদার পর্যন্ত সকলের মনে সর্বদা এই শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে যে, এই বুঝি সরকারের এজেন্টদের মাধ্যমে তারা অপমান ও অপদস্থতার শিকার হতে যাচ্ছেন।
রবিবার ২ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৪একদিনের সফরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা এসেছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সাথে তার গাঢ় সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত।
আমার পুরনো বন্ধুদের অন্যতম মোস্তফা জামান আব্বাসী আমার সাথে দেখা করেছে জেলগেটে। সে এসেছিল কারা পরিদর্শন কমিটির সদস্য হিসেবে নির্ধারিত এক বৈঠকে যোগ দিতে এবং বৈঠক শেষে ও আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
তার এই বদান্যতার জন্য তাকে আমার ধন্যবাদ জানাই। আমরা একসাথে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি। সাথে করে এনেছিল তাঁর লেখা কয়েকটি সুবিখ্যাত বই। এর মধ্যে একটি ছিল মহানবী (সাঃ)-এর ওপর। অধীর আগ্রহ নিয়ে বইটির অংশবিশেষ পড়ে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
সোমবার ৩ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৫কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছিল যে, বাংলাদেশের মাটিতে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নামে একই সময়ে দুর্নীতির মামলা দায়ের করে দু’জনকে একই সাথে কারাবন্দি করা হবে এবং দেশের উচ্চতম আদালত থেকে তাদের জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে? জনগণ দেখছে তাদের প্রিয় নেত্রীরা এখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন। খবরের কাগজ থেকে জনগণ জানতে পারছে তাদের অবস্থা। তারচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো- বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের মতো দুর্বল একটি সরকার এসব তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে? একথা সর্বজনবিদিত যে, ক্ষমতাসীন সরকারের এসব করার মতো এখতিয়ার বা জনসমর্থন কোনোটাই নেই। আসলে তাদের এই ক্ষমতার মূল উৎস অন্যত্র, দেশের বাইরে আর বন্দুকের নলে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ক্ষমতাধর দুই নেত্রীকে বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করা। জনগণের ধারণা, কোনো একপর্যায়ে এ ছিল ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সুদূরপ্রসারী ও অভিন্ন একটি লক্ষ্য।
মঙ্গলবার ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৬আজ আমার বাবার জন্মদিন। ১৮৮৯ সালের এই দিনে তার জন্ম। কিন্তু তিনি কিংবা আমরা কোনোদিন তা উদযাপন করিনি। শুধু আজ এই দিনে নয়, প্রতিদিন আমি তার জন্য দোয়া করি। দোয়া করি আমার মা ও ছেলে আসিফের জন্য। আমি আকুতি জানাই আল্লাহ্ যেন আমার বাবা ও মায়ের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। আমার বাবা ছিলেন উত্তম একজন ব্যক্তিত্ব, আল্লাহর প্রতি নিবেদিত একজন বান্দা। আমার মা ছিলেন একই রকমের একজন মহীয়সী নারী, ১৮ জন সন্তানের জননী। অশেষ স্নেহের সাথে সকলকে তিনি লালন-পালন করেছেন। আমি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন আমার বাবা, মা ও আসিফকে বেহেস্তে স্থান দেন। আমাদের স্নেহময়ী মায়ের পদতলে আমাদের বেহেস্ত। আসিফ ছিল নিষ্পাপ একটি শিশু। কোনো পাপ তাকে কোনোদিন স্পর্শ করেনি। আমি নিজে একজন মস্ত বড় গুনাহগার। কিন্তু আমার বাবা, মা ও আসিফকে বেহেস্তে স্থান দেওয়ার জন্য আমি আল্লাহর দরবারে আবেদন জানাই।
বুধবার ৫ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৭আগস্ট মাসের ২০-২২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে সংঘঠিত বিদ্রোহসংক্রান্ত ঘটনা সরকারের নির্দয় মনোভাবের আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধান বারবার এই আশ্বাস দিয়েছেন যে, কারাবন্দি অধ্যাপকদের আর নাজেহাল না করে অচিরেই মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু তাদের ওপর সরকারের অশুভ ও গোপন থাবার আক্রমণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। রাজশাহীতে দ্রুতবিচারের একটি আদালত দু’জন বিশিষ্ট অধ্যাপককে দু’বছরের জন্য কারাদণ্ড দিয়ে শিক্ষা ও রাজনৈতিক মহলে বিস্ফোরণমূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ছাত্রমহলে সৃষ্টি হয়েছে চরম ক্ষোভ।
বৃহস্পতিবার ৬ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৮দাঁতের চিকিৎসার জন্য আমাকে নেওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে একই সাথে অন্যান্য দিনের মতো এজেন্সির লোকজনের চোখের আড়ালে আমি পাণ্ডুলিপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র হাতবদল করার সুযোগ নিয়েছি। চেম্বার থেকে আমির হোসেন ও ডা. হেলাল এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে।
পাকিস্তানের দিকে তাকিয়ে দেখা উচিত, হাইকোর্টের ৩৭ জন বিচারক জরুরি আইনের অধীনে শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অথচ বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে অপমান ও হুমকির মুখেও বিচারকেরা নির্বিকারভাবে তাদের কাজকর্ম মাথানত করে চালিয়ে যাচ্ছেন হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি বদরুল হক সামরিক এজেন্সির হুমকি ও ব্ল্যাকমেইলিং-এর মুখে পদত্যাগপত্র পেশে বাধ্য হলে প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতিরা নীরবে, নতমুখে তা মেনে নিয়েছেন। পাকিস্তানে যদি বিচারপতিরা নিজেদের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল রাখায় রুখে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে আমাদের দেশের বিচারপতিরা কেন তা পারেন না? কারণ তারা অনেকে সৎ বা উপযুক্ত নন, তাদের আত্মবিশ্বাস নেই। এর জন্য মূলত দায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বের ব্যর্থতা।
শুক্রবার ৭ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৩৯এ সরকারের অধীনে বিচারাধীন রাজনীতিবিদদের সাথে সাজাপ্রাপ্ত খুনি ও দুর্বৃত্তদের চাইতেও বেশি বেশি জঘন্য আচরণ করা হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের ওপর তাদের ঘৃণাবোধের কোনো শেষ নেই। কিন্তু তারা এটা অনুধাবন করতে পারছে না যে, দিনের শেষে ক্ষমতাধর এই শক্তিকেই রাজনীতিবিদদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
প্রতিদিনই আমাদের কাছে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞাসম্বলিত বাণী পৌঁছানো হচ্ছে। আজ শুক্রবার। হঠাৎ করেই আমাদের জামাতে নামাজ আদায় করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। জামাতে অন্যান্য কয়েদির সাথে মিশে পাছে আমরা জুমার নামাজ শেষে অন্যান্য কয়েদিকে উত্তেজিত করে তুলি, এই ভয়ে সরকার আমাদের জামাতে নামাজ পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে বলে জানানো হয়েছে। এজেন্সির লোকেরা হয়তো লক্ষ্য করেছেন কীভাবে শত শত কয়েদি শুধুমাত্র আমাদের সাথে হাত মেলানোর জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে।
শনিবার ৮ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪০আমাকে আবার আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জেলখানার গেটে তিনঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ব্যারিস্টার খোকন ও এডভোকেট তৌহিদকে জানানো হয়েছে যে, উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এতে করে আমি আর কোনো আইনজীবীর সাথে দেখা করতে পারবো না। ডিআইজি এই বলে ব্যারিস্টার খোকনকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, সে যদি আবার আমার সাথে দেখা করতে আসে, এমনকি দেখা করার চেষ্টাও করে, তাহলে তারা আমাকে উত্তরাঞ্চলের প্রত্যন্ত শহর দিনাজপুর জেলে বদলি করে দেবে। যেখানে কারাবন্দিদের ডিভিশন দেওয়ার সুযোগও নেই। কাজেই আমার সাথে দেখা না করেই দু’জন ফিরে গেছে।
আমার আত্মীয়দের মধ্যেও যারা আমার সাথে দেখা করার জন্য তিন ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করছিল, তাদের কাছ থেকে এই খবর শোনামাত্র আমি খোকনের কাছে একটি চিরকুট পাঠিয়ে বলে দিয়েছি সে যেন নিষেধাজ্ঞা উঠে না যাওয়া অবধি আর এখানে আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা না করে। কারণ, আমি আরো পচনের জন্য দিনাজপুর জেলে যেতে চাই না। ১৯৮৩ সালে সামরিক শাসকদের নির্দেশে একবার আমাকে জঘন্য নরকতুল্য সেই জেলখানায় পাঠানো হয়েছিল।
যতদূর জানা গেছে, হঠাৎ করে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণ ছিল, তারা সন্দেহ করছিল যে, ব্যারিস্টার খোকনের মাধ্যমে আমি খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে আনীত মামলার বিষয়ে কাগজপত্র সাজানোর জন্য যথাবিধ নির্দেশ পাঠাচ্ছিলাম। এই সন্দেহ সত্য হোক আর না হোক তারা আমাকে আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করার মৌলিক সাংবিধানিকভাবে গ্যারান্টিকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে নতুনভাবে নাজেহাল করার মাধ্যমে আমাকে কঠিনতর অবস্থার মুখে ঠেলে দেওয়ার একটি অযুহাত মাত্র। এভাবে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের সবরকমের সুযোগ আমি আবার হারালাম।
নতুন নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তি, যাই বলা হোক না কেন, একরকম হঠাৎ করেই ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে, জামায়াতের ডা. আবু তাহেরকে কুমিল্লায় এবং আরো চারজন বিশিষ্ট নেতাকে অন্যান্য জেলখানায় বদলি করা হয়েছে।
(চলবে..)