× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৫৩) /‘গণতন্ত্র এখন আর জরুরি বলে বিবেচিত হচ্ছে না’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২০ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার

রোববার ৯ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪১
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকল শিক্ষক আটককৃত শিক্ষক ও ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে আগামীকাল কালো ব্যাজ ধারণ করবেন ও অংশ নেবেন এক মৌন মিছিলে। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি মানা না হলে তারা কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। রাজশাহীতে ইতিমধ্যেই ২ বছরের জন্য সাজাপ্রাপ্ত ৪ জন অধ্যাপকের বিষয়ে আর কোনো নতুন সংবাদ নেই। আজ ছাত্রসমাজ ও সরকার এভাবে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছেন। এ যুদ্ধে সরকারের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের ইতিহাসের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। ইতিমধ্যে সরকার পরিস্থিতি শুধু ঘোলাটেই করে যাবে।

সোমবার ১০ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪২
সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের কর্মসূচি আপাতত দু-সপ্তাহের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার আবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, আটককৃত সকল শিক্ষক ও ছাত্রকে মুক্তি দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ভিত্তিতে রাজশাহীতে অন্তরীণাবদ্ধ চার শিক্ষককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আমি এ নিয়ে সঠিকভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম। এই ইস্যুতে সরকার কত না কিছুই বলেছিল। একলাখ লোকের বিরুদ্ধে এই বলে মামলা দায়ের করা হয়েছে যে, এ ছিল সরকার উৎখাতের একটি আন্দোলন! সেনাবাহিনী প্রধান বলেছে, এ আন্দোলনের পেছনে রয়েছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদেরা, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার দাবি ছিল শিক্ষকেরা পেছন থেকে এই আন্দোলন পরিচালনা করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এ ব্যাপারে ভারতীয় দূতাবাসের সাথে যোগসাজশ করেছিলেন। এখন তাদের এতসব উচ্চবাচ্যের ও অ্যাকশনের ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

কতিপয় গ্যাস ফিল্ড অনুসন্ধানে বিদেশী কোম্পানীকে ছাড় দেওয়ার অভিযোগে নাইকো মামলায় প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আরেকটি এফআইআর দাখিল করা হয়েছে। এতে অভিযোগ আনা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। একজনের দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় আরেকজনকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার অনুমোদনক্রমে নাইকোর সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন এবং খালেদা জিয়া পরবর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এর ওপর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। মজার ব্যাপার হলো কাকতলীয়ভাবে এ মামলায় আইন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে খালেদা জিয়ার সাথে আর আমার ভগ্নিপতি তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব হিসাবে শেখ হাসিনার মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এতে করে শুধু এই সরকারের দেউলিয়া ও অন্তঃসারশূন্যতাই প্রমাণিত হয়। এই চুক্তিতে যদি কাল্পনিকভাবে ২৩ হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতিই সাধিত হয়ে থাকে তাহলে বর্তমান সরকার এখনো এই চুক্তিকে বাতিল করছে না কেন?

মঙ্গলবার ১১ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৩
জেলখানার ভেতরে যে কত রকমের দুর্নীতি প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করছে কয়েদীদের কাছ থেকে তার সবিস্তার বিবরণী পাওয়া যায়। প্রতিটি স্তরে প্রতিটি পর্যায়ে এর অবস্থান। এর আগে জেলে থাকাকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে এ বিষয়ে আমি আমার আত্মজীবনী চলমান ইতিহাসে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছি।
এ সরকারের দু’জন ব্যক্তি অত্যন্ত বড় গলায় কথা বলছেন। তারা হলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, যদিও এ দু’জনেরই সবচাইতে কম কথা বলার কথা। তাদের স্ববিরোধী বক্তব্য এবং কথাবার্তার সঠিক মূল্যায়নে যুক্তিহীনতা ও দ্বিচারিতা জনগণের সামনে এখন উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান ছাড়া এ দু’জনকেও জাতির অসামান্য ক্ষতিসাধনের কারণে একদিন চরম মূল্য দিতে হবে।

বুধবার ১২ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৪
বন্দুকবাহী সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তুলেছে। নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেছেন তারা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সকল শিক্ষক ও ছাত্রের মুক্তি না দিয়ে গতকাল ঢাকার আদালত ৮ জন অধ্যাপক ও ১৫ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে জরুরি আইন ভঙ্গ ও আন্দোলন করার অপরাধ সম্বলিত অভিযোগ দায়ের করেছে। আসলে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ছিল পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য সময় নেওয়ার একটি প্রচেষ্টামাত্র যাতে করে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যেকার পুঞ্জীভূত বিক্ষোভকে আপাতভাবে প্রশমিত করে রাখা যায়।
কেবলমাত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র হওয়াতেই বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে বাংলাদেশ হলো একটি ভঙ্গুর (vulnerable) ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই ধারণা ভারতীয় মনোভাবেরও অনুকূলে। গণতন্ত্র এখন আর এখানে জরুরি বলে বিবেচিত হচ্ছে না। ইসলামী জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটনই মনে হয় তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।

বৃহস্পতিবার ১৩ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৫
চিকিৎসার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে।
রাজশাহীতে সামরিক বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষকদের মামলায় অব্যাহতি দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য যেভাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হচ্ছে, এ হলো তার আরেক বাস্তব উদাহরণ। এক মামলায় সাজা, সাথে সাথে আরেক মামলায় অব্যাহতি।
সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির অনুমোদন ব্যতিরেকেই শেখ হাসিনার মামলা স্থানান্তরের ব্যাপারে আপিল বিভাগ নিজেদের এখতিয়ার বিসর্জন দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া সিদ্ধান্তকে রদ করে দিয়েছে। তাহলে আর বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের অর্থ কি দাঁড়ায়? আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনের চাইতে ব্যক্তির প্রাধান্যই বিবেচিত হতে দেখা যাচ্ছে। মাজদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের যে ভিত্তি গাঁথা হয়েছিল এই পরিস্থিতি সেই চেতনার সার্বিকভাবেই পরিপন্থী।

শুক্রবার ১৪ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৬
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, আমাদের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দিন। জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে পাকিস্তানী ঘাতকদের হাতে নিহত সেসব বুদ্ধিজীবীদের কথা স্মরণ করবে যাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ।
আমরা গণতন্ত্র ফিরে পেলেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তাতে কোনো লাভ নেই। বিগত তিনটি গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে প্রশাসনকে দলীয়করণ করার প্রতিযোগিতায় যতটা ব্যস্ত থেকেছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণে ততটা মনোযোগী হয়নি। এবার গণতন্ত্র ফিরে আসার পর একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেলে তা হবে গোটা জাতির জন্য দুঃখবহ।
আজ এই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা মনে প্রাণে কামনা করি যে, এ ধরনের পরিস্থিতির অবতারণা আবার ঘটবে না।

শনিবার ১৫ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৭
কোনো আইনজীবী আমার সাথে দেখা করতে আসতে পারেনি। গত ২রা ডিসেম্বর থেকে আমাকে আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করা হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। দর্শনার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট দিনে অন্যরা এসেছিল দেখা করতে।
সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে ২২ তলাবিশিষ্ট র‌্যাংগস ভবনের ৬টি তলা ভেঙে ফেলার সময় অদ্যাবধি আটজন শ্রমিকের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ অকুস্থলে যাননি কিংবা নিহতদের জন্য সমবেদনা জানাননি।

রবিবার ১৬ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৮
৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এই দিনে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তার স্বাধীনতা। আমরা একে বলি বিজয় দিবস, জাতির জীবনে গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন।
আমি অবৈধ ও অসাংবিধানিক এই সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার ওপরে মূলত দেশের বাইরে প্রচারের জন্য একটি ১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রথমত, এটি পৌঁছাতে হবে বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে এবং একই সাথে রাজধানীতে অবস্থানরত সকল বিদেশী রাষ্ট্রদূত, সংবাদপত্র, বিশিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিদের কাছে। তারেক রহমানের নেটওয়ার্ক মনে হলো এক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী এবং সে স্বেচ্ছায় তার নিজস্ব চ্যানেলে বিশ্বব্যাপী প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে। আমি হাসনার কাছেও একই কপি পাঠিয়েছি। আমি জানি, সে সানন্দে এ নিয়ে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে  কাজ কয়ে যাবে। প্রতিবেদনটি একটি সহজ পাঠযোগ্য তথ্যভিত্তিক দলিল যা পড়লে দেশের কতটুকু ক্ষতিসাধন করেছে এই বর্বর সরকার তা সম্যকভাবে উপলব্ধি করা যাবে।

সোমবার ১৭ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৪৯
হঠাৎ করেই একজন প্রিজন অফিসার আমাদের ঘরের দরজা-জানালা থেকে সমস্ত পর্দা খুলে ফেলার হুকুম জারি করেছেন। ফলে আমাদের ছোট্ট প্রকোষ্ঠটিতে যৎসামান্য যে প্রাইভেসি ছিল শেষ পর্যন্ত তা-ও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরাও এ নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য। কারণ, যেকোনো আদেশের বিরোধিতা করার অর্থ হলো শাস্তি স্বরূপ তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা থেকে দূরবর্তী কোনো জেলখানায় স্থানান্তরিত করে দেওয়া যা আমাদের কেউই চাইবো না। এখন থেকে দরজার বাইরে দাঁড়ানো গার্ডরা আমরা ভেতরে কী করছি তার ওপর ২৪ ঘণ্টা নজর রাখতে পারবে, এমনকি গোসল করার বা কাপড় বদলানোর সময়ও আমাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার কোনো উপায় রইলো না। তাছাড়া এই ভেজা, স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের ছোট্ট ঘরটিতে শীতের তীব্রতার সময় পর্দা ছাড়া আমাদেরকে আরো কষ্টে সময় পার হতে হবে।
আসলে এ ছিল আমাদের প্রতি তাদের আমানুষিক ও নির্দয় আচরণেরই একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কোনো স্পষ্ট কারণ ছাড়াই আমাদের ওপর চলছে এ ধরনের নির্যাতন ও অপমান। ফলে আমি দরজা ও জানালার জন্য নতুন বানানো পর্দাগুলো নামিয়ে ভাজ করে একটা সুটকেসে ভরে রেখে দিলাম বিছানার নিচে। কারণ, আমার বোন ও অন্যান্যদের কাছে লজ্জাবশত আমি দুঃখবশ এই ঘটনা জানাতে পারবো না।
কোনো কারণ ছাড়াই শুক্রবারে জুমআর জামাতে আমাদের অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে।
আমাকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। পুরনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা প্রিজন ভ্যানে অত্যন্ত কষ্টকর ভ্রমণ হলেও এর ফলে আমি কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও সাময়িক মুক্তির কিছুটা স্বাদ পাই।

(চলবে...)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর