× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার , ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি ও পাসিং আউট প্যারেড

মত-মতান্তর

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব
২০ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার
ফাইল ফটো

চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তরে অবস্থিত ভাটিয়ারী এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের রাজকন্যা। অন্যদিকে, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অসমসাহসী যোদ্ধাদের স্মৃতিধন্য অনেকগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে ভাটিয়ারী অবস্থিত। এর পূর্বে অরণ্য ছোঁয়া সীতাকুণ্ড পাহাড়মালার সারি আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের জলের অনুপম হাতছানি। এর মাঝেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত মর্যাদাবান একটি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) অবস্থিত। যেখানে তরুণ ক্যাডেটদের জন্য প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়, যারা আগামী দিনে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিবে।
গত প্রায় চার যুগ ধরে সেনাবাহিনীর জন্য বিচক্ষণ, সুদক্ষ ও কুশলী নেতৃত্ব গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে এই জাতীয় সামরিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনীকে সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষ ও সংগঠিত করার জন্য একটি সামরিক একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৭৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় ময়নামতি সেনানিবাসের ক্ষুদ্র পাহাড় মালার পাদদেশে এ একাডেমি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে, ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি প্রথম শর্ট সার্ভিস কমিশনের ৭০ জন ক্যাডেট নিয়ে বিএমএ তার যাত্রা শুরু করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বিএ-৬৫৬১ কর্ণেল খন্দকার নাজমুল হুদা, বীর বিক্রম, (কুমিল্লা সেনানিবাসস্থ ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার থাকাকালীন অতিরিক্ত দায়িত্ব) বিএমএ- এর প্রথম কমান্ড্যন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এই সময় প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে লেঃ কর্ণেল আব্দুল মান্নাফ (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) একাডেমির প্রাথমিক দিন গুলোতে অসাধারণ অবদান রাখেন। পরবর্তীতে তিনি এই একাডেমির কমান্ড্যন্টের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান বন্দি শিবির থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় (১৯৭৩) তৎকালীন মেজর আব্দুল মান্নাফ সাজানো সংসার ফেলে এলেও সঙ্গে আনেন গুরুত্বপূর্ণ একটি ডকুমেন্ট। তিনি অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে সঙ্গে এনেছিলেন পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ‘এসেসমেন্ট সিস্টেম অফ ক্যাডেটস’ নামের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রেসি (বই)। প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বই পুস্তকের অভাবে অনেকটা এর উপর ভিত্তি করেই ক্যাডেটদের এসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) সিস্টেম গড়ে ওঠে। পাকিস্তান   সেনাবাহিনীতে দুর্ধর্ষ কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষিত মেজর মান্নাফ নিজেও পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির একজন বিখ্যাত প্রশিক্ষক ছিলেন (প্লাটুন কমান্ডার)।
এরপর ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে একাডেমির অবস্থান ও কার্যক্রম চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার ভাটিয়ারীতে স্থানান্তরিত হয়। সাবেক জাতীয় রক্ষীবাহিনীর আঞ্চলিক কেন্দ্রটিকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে মিলিটারি একাডেমিতে রূপান্তর করা হয়। ১৯৭৮ সালে লং কোর্স চালুর মাধ্যমে এখানে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
বিএমএ’ এর মটো বা আদর্শ নির্ধারণ (১৯৭৪) করা হয় ‘চির উন্নত মম শির’। এই অগ্নিগর্ভ কথাটির মধ্যদিয়ে বিএমএ’র আদর্শ ও লক্ষ্য পরিপূর্নভাবে প্রতিফলিত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার মূল প্রতিপাদ্যে কবিতাংশটিতে বাণীরূপ পেয়েছে। অকুতোভয় সৈনিকদের আত্মপ্রত্যয় বোধের প্রস্তুতি স্বরূপ এই একটি মাত্র কথাতেই সর্বাংশে প্রকাশিত হয়েছে। জানা যায় কর্ণেল মান্নাফের মাতা লেখিকা জুবেইদা খানমের চিন্তা প্রসুত ছিলো এই মটো।
বিএমএ বা যে কোন মিলিটারি একাডেমির ক্যাডেটদের কাছে প্রার্থিত ও অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হলো শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ বা পাসিং আউট প্যারেড। এই প্যারেড বিভিন্ন সামরিক ঐতিহ্য, ড্রিল ও জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে থাকে।এই প্যারেডকে প্রেসিডেন্ট প্যারেডও বলা হয়। বৃটেনের স্যান্ডহার্ষ্টে একে ‘সভরেন প্যারেড’ বলা হয়।
বিএমএ’র প্রথম ব্যাচ, শর্ট সার্ভিস কমিশন-১ (এসএসসি-১) এর পাসিং আউট প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঐতিহাসিক প্যারেডের সালাম গ্রহণ করেন ও প্যারেড রিভিউ করেন। জাতির পিতার উপস্থিতি অনুষ্ঠানটিকে আকর্ষণীয়, বর্ণাঢ্য ও স্মরণীয় করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণটি ছিল ক্যাডেটদের জন্য ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ক্যাডেটদের যে উপদেশ দেন তা ছিল যুগোপযোগী, অনুসরণীয় ও দিক নিদের্শনামূলক। সেই সময়ে একজন চৌকশ প্লাটুন কমান্ডার (প্রশিক্ষক) ছিলেন মেজর কাজী শাহেদ আহমেদ (পরবর্তীতে লেঃ কর্ণেল)। এই সেনা প্রকৌশলী ও কর্মবীর, তাঁর আত্মজীবনীতে (জীবনের শিলালিপি) শুন্য থেকে বিএমএ গড়ে ওঠার অসাধারণ কাহিনি চমৎকার ভাবে ও নির্মোহ দৃষ্টিতে বর্ণনা করেছেন।
এবার অন্য এক পাসিং আউটের গল্প। আমার কোর্স ১২তম দীর্ঘ মেয়াদী কোর্স (লং কোর্স)। ১৯৮৫ সালে ১৮ মে অনুষ্ঠিত পাসিং আউট প্যারেডের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের সামরিক জীবন। উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালের ২৭ জুলাই ১২তম লং কোর্সের জন্য নির্বচিত এক ঝাঁক তরুণ (জেন্টলম্যান ক্যাডেট) বিএমএ যোগদান করে। আমরা সবাই তখন দুঃসাহসিক নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী তরুণ। আমাদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো নৌ ও বিমান বাহিনীর ক্যাডেটবৃন্দ যৌথ প্রশিক্ষণে (প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ) অংশগ্রহণ করেছিল। তিন বাহিনীর ক্যাডেট সংখ্যা ছিল ১৫৬ জন।
দুই বছর কঠোর প্রশিক্ষণের পর ১২৪ জন তরুণ সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করে। ১৯ মে আমাদের কমিশন লাভের দিবস (পাসিং আউটের একদিন পর)। সামরিক অফিসারদের স্মৃতিতে মিলিটারি একাডেমির প্রথম দিন (যোগদানের দিন) ও শেষ দিন (পাসিং আউট প্যারেড) চির সবুজ, চির উজ্জল। অনেকটা প্রথম ভালোবাসার মতো।
কর্মদক্ষ সেনা অফিসার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিএমএ-তে একই সঙ্গে চারিত্রিক, সামরিক ও একাডেমিক- এই ত্রিমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমাদের সময় কমান্ড্যান্ট ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সৈয়দ বদরুজ্জামান (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল)। প্রশিক্ষণের বিষয় প্রধান ছিলেন (জিএসও - ১ প্রশিক্ষণ) লে: কর্নেল হাসান মসহুদ চৌধুরী (পরবর্তীতে লে: জেনারেল ও সেনা প্রধান)। এর পর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে এলেন কর্নেল কাজী মাহমুদ হাসান (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)।
 বেসামরিক তরুণদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে পিঠে, সেনা অফিসার রূপান্তরের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন আমাদের প্রশিক্ষকগণ। এরাই ছিলেন আমাদের দ্রোণাচার্য। টার্ম কমান্ডার ও প্লাটুন কমান্ডারগণ ছিলেন আমাদের চোখে সেনা অফিসারের মূর্ত প্রতীক- রোল মডেল।
 
আমাদের প্রথম টার্ম কমান্ডার ছিলেন মেজর আলাউদ্দিন মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ (পরে মেজর জেনারেল)। পরবর্তীতে টার্ম কমান্ডার হন মেজর মিয়া মশিউজ্জামান (পরবর্তীতে কর্ণেল)। একঝাক চৌকশ অফিসার ছিলেন আমাদের ‘গ্রেট’ প্লাটুন কমান্ডারঃ মেজর মুস্তাফিজুর রহমান, মেজর খন্দকার নূরুল আফসার, মেজর আবুল ফাতাহ, মেজর শরিফ উদ্দিন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল),  মেজর রফিকুল আলম (পরে মেজর জেনারেল), মেজর মো: মইনুল ইসলাম (পরবর্তীতে লেঃ জেনারেল), ও মেজর মোস্তফা কামাল ,ক্যাপ্টেন গোলাম সাকলায়েন (পরবর্তীতে মেজর), লে: কমান্ডার হুমায়ুন কবির (পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন) ও ফ্লাইট লে: শেখ মুহাম্মদ শাহজাহান (পরবর্তীতে উইং কমান্ডার)। তাদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানেই আমাদের প্রশিক্ষণ ও গ্রুমিং হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, ক্যাডেটদের জীবনে তাদের প্লাটুন কমান্ডারদের দারুন প্রভাব থাকে । আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ অফিসার ছিলেন মেজর মোহাম্মদ সাদেকুল হাসান রুমি (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল)।
একই সঙ্গে একাডেমিক ট্রার্ম কমান্ডার ও এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ একাডেমিক প্লাটুন কমান্ডারগণ একাডেমিক শিক্ষায় আমাদের আলোকিত করেন। বেশ কঠিন একটি পরিবেশে আমাদের মননকেও শাণিত করেছেন। কঠোর প্রশিক্ষণের সময়, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রনীতির পাঠগুলো আমাদের দিয়েছিলো  চমৎকার খোলা জানালা। এছাড়াও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা, প্রশাসন, সমন্বয়, অস্ত্রপ্রশিক্ষণ, শারীরিক প্রশিক্ষণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছিলাম পেশাগতভাবে অত্যন্ত দক্ষ অফিসার ও বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষক।
 
ডেট লাইন ১৮মে ১৯৮৫। বাংলাদেশে তখন পুস্প উৎসবের গ্রীষ্মকাল। প্রবল এক উত্তেজনায় ভরা ছিল জ্যৈষ্ঠের সেই উজ্জ্বল দিন। সীতাকুণ্ড পাহাড় শ্রেণির উপর সূর্য ততক্ষণে তাপ ছড়াচ্ছে। পাসিং আউট প্যারেডের জন্য বিএমএ কে সাজানো হয়েছে নববধূর সাজে। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালু ও জারুলের রঙিন উচ্ছ্বাসে বর্ণিল হয়ে উঠেছে ভাটিয়ারীর নিসর্গ। দুই বছরের অকল্পনীয় পরিশ্রম ও কঠোর প্রশিক্ষণের পর কমিশন প্রাপ্তি ছিল প্রশিক্ষণরত তরুণ ক্যাডেটদের জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
সকাল সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে ট্রাম্পেটের ধ্বনির মাধ্যমে ক্যাডেটদের মাঠে প্রবেশের আগাম বার্তা জানানো হলো। দীপ্ত ভঙ্গিতে ও বিশেষ স্টাইলে মার্চ করে গ্রাউন্ডে প্রবেশ করলের রিসালদার এডজুটেন্ট (পরে অনারারী ক্যাপটেন) মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। বিএমএ’র ক্যাডেটদের সামরিক বেয়ারিং (চাল চলন) ড্রিল ও প্যারেডের ক্ষেত্রে তার অতি মানবিক দক্ষতা তখন প্রায় কিংবদন্তি। এরপর শুরু হলো প্যারেডের ঐতিহ্যবাহী ধারাবাহিক কার্যক্রম। দক্ষিণ দিক থেকে মার্চ করে আমরা (ক্যাডেটগন) প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করলাম। এ সময় ব্যান্ডে ‘চির উন্নত মম শির’ সুর বাজতে থাকে।
 
আমাদের (বিএমএ’র) কমান্ড্যান্ট ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ বদরুজ্জামান (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল ও প্রয়াত)। উল্লেখ্য তৎকালীন মেজর সৈয়দ বদরুজ্জামান ছিলেন বিএমএ-র প্রথম তিনজন গর্বিত প্রশিক্ষকদের (প্লাটুন কমান্ডার) অন্যতম। রাজপুত্রের মতো ঘোড়ায় চড়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে এলেন প্যারেড অ্যাডজুটেন্ট মেজর সিনা ইবনে জামালী (পরবর্তীতে লেঃ জেনারেল)। আমাদের প্রথম অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন মেজর মিজানুর রহমান তালুকদার (পরবর্তীতে লে: কর্নেল) ।
সকাল আটটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে প্যারেড প্রস্তুত হয়ে ক্যাডেটগণ অপেক্ষা করতে থাকে প্রধান অতিথির আগমনের জন্য। আমরা সকলে খাকি সামরিক পোষাকে শোভিত। মাথায় বিএমএ’র মনোগ্রাম খচিত সবুজ টুপিতে লাল পালক, হাতে রাইফেল।
আমাদের পাসিং আউট প্যারেড রিভিউ করেছিলেন তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম। একাত্তরের নায়কোচিত দুঃসাহসিক এই বিমান সেনার উপস্থিতি এই অনুষ্ঠানকে আরো আকর্ষণীয় ও স্মরনীয় করে তোলে। প্রধান অতিথির মোটর যান থেকে অভিবাদন মঞ্চে অবস্থান নেয়ার সাথে সাথে প্যারেড কমান্ডারের আদেশ ক্যাডেটগণ এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদকে সশস্র সালাম জানান। এ সময় ব্যান্ডে জাতীয় সঙ্গীতের সুর বাজানো হয়। এরপর পর্যায়ক্রমিক চলতে থাকে প্যারেড পরিদর্শন, বিএমএ কালার প্রদান অনুষ্ঠান ও ধীর গতিতে কুচকাওয়াজ। এই সময়ে ব্যান্ডে ধনধান্যে পুস্পে ভরা গানের সুর বাজতে থাকে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বেঃ শপথ অনুষ্ঠান, পুরস্কার প্রদান ও প্রধান অতিথির ভাষণ। সেই দিন প্যারেড গ্রাউন্ডে আমরা শপথ নিয়েছিলাম- প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও আমরা প্রস্তুত থাকবো। আমাদের কোর্সে শ্রেষ্ঠ ক্যাডেট হিসেবে ‘সোর্ড অব অনার’ পেয়েছিলেন ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার মোঃ সিদ্দিকুল আলম শিকদার (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল)।
ভাষণ ও আনন্দ ধ্বনি শেষে প্যারেড অধিনায়ক অনুষ্ঠান সমাপ্তির জন্য প্রধান অতিথির অনুমতি গ্রহণ করেন। আমরা ধীর গতিতে মার্চ করে প্রধান অতিথিকে অভিবাদন জানিয়ে সকাল প্রায় সোয়া নয়টায় পোডিয়ামের দিকে এগিয়ে যাই। আমরা যখন পোডিয়াম অতিক্রম করছিলাম, তখন অর্কেষ্ট্রায় বেজে ওঠে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নসএর  রচিত গান ‘অ্যল্ড ল্যাং সাইন’। সে সুর মনে করিয়ে দেয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরনো সেই দিনের কথা, গানটির  কথা। মূল গানটির ভাবার্থ একই।
পোডিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে পূর্বদিকে নেমেই (ক্যাডেট থেকে) সেনা অফিসার পদে উন্নতি। কি শিহরণময় জাগানো সেই আনন্দ। প্রশিক্ষণের ভয়ংকর কঠোরতা আমাদের সকলের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আনন্দের অতিসয্যে হাতের তরবারী উর্ধ্বে ছুড়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল কেউ কেউ।
 
১৯৭৩ সালের কুমিল্লা থেকে যে বিএমএ’র বিনম্র যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে আজ পূর্ণতা পেয়েছে। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স, উচ্চ শিক্ষার অনন্য সুযোগ, স্বাধীনতা মানচিত্র, বিশ্বমানের ল্যাংগুয়েজ ল্যাবরেটরি ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ সুবিধা সম্বলিত বিএমএ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের সামরিক একাডেমি। শুধু বাংলাদেশ সশস্রবাহিনীর ক্যাডেট নয়, বিদেশী ক্যাডেটসহ নারী ক্যাডেটগণও এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। তবুও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অধিকতর উৎকর্ষ ও উন্নতি অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখাই কাম্য। কারণ বিএমএ এখন বাংলাদেশের গর্ব।
বিএমএ গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সময়ের কমান্ড্যান্ট, ব্যাটালিয়ান কমান্ডার, ডাইরেক্টর অব স্টাডিজ, টার্ম কমান্ডার, প্লাটুন কমান্ডার, এডজুটেন্ট সহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের নিবেদিত প্রান মনোভাব, নিষ্ঠা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে। আজকের এই দিনে তাদেরসহ বিএমএ গড়ে তোলার দুই নায়ক, প্রথম দুই কমান্ড্যান্ট ও আমাদের সময়ের কমান্ড্যান্টঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কর্ণেল খোন্দকার নাজমুল হুদা, বীর বিক্রম, প্রত্যয়ী সেনা কর্মবীর মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নাফ ও চৌকশ পেশাদার মেজর জেনারেল সৈয়দ বদরুজ্জামান এর কথা স্মরন করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়। তারা সবাই আজ জীবনের ওপারে।
 
স্মরণ করি আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া ৯ জন বন্ধুর (কোর্সমেট) কথা। এদের মধ্যে ৪ জন বন্ধু, বিভৎস পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ হয়েছেন। অন্য ৫ জন জীবনের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে চলে গেছেন ওপারে। বন্ধুগণ ওপারে তোমরা ভালো থেকো।  
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শেষ রণাঙ্গন (১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১) ভাটিয়াপাড়া বিজয়ের নায়ক ও বিএমএ’র প্রথম কমান্ড্যাট এর সহধর্মিণী নিলুফার দিল আফরোজ বানু নতুন সেই একাডেমির ফুলের বাগান গড়ে তুলেছিলেন এক পরম মমতায়। জীবনের বিকেল বেলায় নিঃসঙ্গ স্মৃতি রোমন্থনে এই চির সংগ্রামী নারীর মনে হয়, হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া (নভেম্বর, ১৯৭৫) তাঁর জীবন সাথী শহীদ কর্ণেল নাজমুল হুদা হয়তো বিএমএ’র বাগানে এক গোলাপ ফুল হয়ে ফুটে আছে....। আসলে তো তাই। যারা মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, যারা শহীদ, যারা বাংলাদেশের কৃতি সন্তান ও ভালো মানুষ তারা তো সবাই আমাদের বাগানের অনিন্দ্য সুরভিত বর্ণিল ফুল হয়ে ফুটে আছে। তাদের জন্যই তো আমাদের ‘চির উন্নত মম শির’।
বার বার ফিরে যাই বিএমএ, ভাটিয়ারীতে। অযুত স্মৃতির খোঁজে অনাবিল ভ্রমনে। একদা যেখানে ছিল আমাদের প্রিয়তম স্বপ্নের জন্মভূমি। ভাটিয়ারির সবুজ পাহাড়ে খোচিত বিএমএ’র মটো/আদর্শ- এখনও পথ দেখায়। সব সময় পথ দেখাবে।

লেখক: মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বিএমএতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর