মঙ্গলবার ১৮ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫০আমি জেলখানায় আছি ৮ মাস ৪ দিন ধরে। এটা আমার জীবনের দীর্ঘতম সময়ের জেল। এরশাদের সামরিক শাসনামলে আট মাসের কিছু কম সময় জেলখানায় জীবন কাটে আমার। তারপর বিনাশর্তে আমাকে মুক্তি দেয়া হয়। দেশে জরুরি আইন বহাল না থাকলে যে কোনো আইনেই হোক, আমাকে কারাগারে বন্দি করে রাখা সম্ভব ছিল না। অন্ততঃপক্ষে জামিনে হলেও আমি মুক্ত থাকতাম।
প্রথমে আমার বিরুদ্ধে দেওয়া হলো মাদকের মামলা। হাইকোর্ট তার ওপর স্থগিতাদেশ দিলে আমাকে পাঠানো হলো ডিটেনশনে। আদালতের রায়ে ডিটেনশন অবৈধ ঘোষিত হলে আমার বিরুদ্ধে দেয়া হলো আয় ও সম্পদ সংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা।
সেই মামলাটিও হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত ঘোষণার পর আমাকে জেলখানায় আটক রাখার আর কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু জরুরি আইনের দোহাই দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আমার জামিনের আদেশ রদ করে দেয় যার জন্য আজো দুঃসহ সময় কাটাতে হচ্ছে জেলে।
আমি জানি না, কতদিন আমাকে এই অবস্থায় জেলখানায় দিন কাটাতে হবে।
বুধবার ১৯ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫১সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীকে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। সে জামিন পাবার পরও স্পেশাল জজ ফিরোজ খান গত ১১ দিনেও তার বেইল বন্ডে স্বাক্ষর করেনি। যদিও এটি মাত্র কয়েক মিনিটের কাজ। আসলে নির্লজ্জ ও বেহায়া কর্তাদের নির্দেশে আরেকটি মামলায় তাকে জড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সময় নেওয়ার জন্যই ইচ্ছে করে এই দেরি করা হচ্ছে।
উচ্চতম আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত পর্যন্ত বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের মাত্রা সকল সীমা অতিক্রম করে গেছে। আপিল বিভাগে বিচারকদের মধ্যে কোনো একাত্মবোধ, সাহস, নৈতিকতা ও আন্তরিকতা না থাকায় তারা জরুরি আইনকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই অরাজকতা।
গণতন্ত্র ও জরুরি অবস্থা পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সংবিধান বলবৎ রয়েছে ততদিন পর্যন্ত সংবিধানকে সংরক্ষণের স্বার্থে জরুরি আইনের একচ্ছত্রতায় বাধা দেওয়ার ব্যাপারে বিচার বিভাগ তার এখতিয়ার করতে পারে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার ২০ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫২কাজ ও খাদ্যের অভাবে কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও উপকূলস্থ বিশাল এলাক, দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। তার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও নয়া দিগন্ত, মানবজমিন, আমার দেশ, যায়যায়দিন, নিউ এইজ ও সপ্তাহিক জনতার চোখ-সহ কোনো কোনো পত্রিকায় গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের দুর্দশাসম্বলিত সংবাদের কিছুটা হলেও প্রকাশ করা হচ্ছে।
শুক্রবার ২১ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৩আজ ঈদ-উল-আজহা, মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবের দিন। এ দিনে কোরানের নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (রাঃ)-এর অনুসরণে মুসলমানেরা বিশেষ মোনাজাত ও পশু কোরবানিতে অংশ নেয়। মহান আল্লাহর নির্দেশের বশবর্তী হয়ে এদিন হযরত ইব্রাহিম (রাঃ) তার নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
কিন্তু আজও আমাদের অন্যান্য কয়েদির সাথে ঈদের জামাতে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
আমাদের পরিবারের জন্য ঢাকায় এ বছর কোনো কোরবানি দেওয়া হয়নি। কারণ, ঈদ উদযাপনের জন্য ঢাকায় কেউ নেই। গ্রামের বাড়িতে যথারীতি একটি গরু কোরবানী দিয়ে তার মাংস গ্রামের গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হবে। আমি নিজে এখন আছি মহা আর্থিক সংকটে। আমার সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে- আমার কিছু নিকটাত্মীয়কে প্রতি মাসে এবং ঈদের সময় বাড়তিভাবে যে আর্থিক সাহায্য করে থাকি এ বছর আমার অন্তরীণাবস্থার কারণে আমি তাদের সাহায্য করতে পারিনি। ফলে ঈদের এই আনন্দ মৌসুমে আর্থিক সংকটের কারণে তারা আরো বেশি দুরবস্থার শিকার হয়েছে। তাছাড়া আমার সবচেয়ে বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তার দোয়া লাভ থেকেও আমি আজ বঞ্চিত। তবে আমার আত্মীয়স্বজনেরা আমার মনকে প্রফুল্ল রাখার জন্য ভিড় করে নানারকম খাবার নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। হাসনা, আমান ও আনাকে বিশেষভাবে মিস করেছি।
এ ধরনের অনুষ্ঠানে প্রত্যেকবারই সকলকে সাথে নিয়ে আমরা সবাই আনন্দঘন সময় কাটিয়েছি।
শনিবার ২২ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৪আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী, ১৯৭২ সালের এই দিনে আমার সাথে বিয়ে হয়েছিল হাসনার। আমরা একসাথে কাটালাম ৩৫ বছর। সে বছর আমার বিয়ে ছিল রাজধানী ঢাকার একটি বহুল আলোচিত উৎসব। ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পরম আন্তরিকতার সাথে প্রায় আধঘণ্টাব্যাপী মোনাজাত করেছিলেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় বাবা। এর একদিন পর গুলশানের বাসার পাশের একটি মাঠে আয়োজিত ওয়ালিমা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। দেশের স্বনামধন্য সকল ব্যক্তিত্ব উভয় অনুষ্ঠানে এসে আমাদের আশীর্বাদ দিয়েছিলেন।
আমাদের সকল উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, সাফল্য ও ব্যর্থতায় আমি ও হাসনা পাশাপাশি থেকে আমার ছেলে আসিফের মৃত্যু, আমানের প্রতিবন্ধিতা, আনার সীমাবদ্ধতা এবং আমার সকল অন্তরীণাবস্থার যন্ত্রণা সবকিছু ভাগাভাগি করে দিন কাটিয়েছি। হাসনার ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ত্যাগ, ভালোবাসা ও দুঃসময়ে সন্তানসহ পরিবারের প্রতি তার আন্তরিকতাবোধ আজো আমাকে আবেগাপ্লুত করে দেয়। দুঃসহ সময়গুলোতে হাসনার সুস্থির দৃঢ়চিত্ততা আমাদের একসাথে থাকার অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। আমাকে একদিন চলে যেতে হবে, কিন্তু আমান ও আনার পাশে থাকার জন্য হাসনার আরো বহুদিন বেঁচে থাকার প্রয়োজন। আল্লাহ যেন আমার এই ইচ্ছা পূরণ করেন।
রবিবার ২৩ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৫১৯ ডিসেম্বর বুধবার তিনজন আর্মি মেজরের নেতৃত্বে একটি দল বিনা নোটিশে এবং আদালতের কোনো নির্দেশ ছাড়াই আবার আমার চেম্বারে এসে ঢোকে। এডভোকেট আজিজুল হককে তারা তার বাসা থেকে ডাকিয়ে আনে। তারা হাসনা, আমান ও আনা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য খুঁজে বের করার জন্য আমার সকল ফাইল, কাগজ, দলিল, কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক তছনছ ও জব্দ করে। আমাকে বলা হয়েছে যে, আমাকে গ্রেফতার করার পর থেকেই তারা অনবরত টেলিফোন করে চেম্বারের সকলকে আমার আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো সহযোগিতা না করার জন্য হুমকি দিয়েছে।
সোমবার ২৪ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৬১৯ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর মেজররা আমার চেম্বারে অবস্থান করেছে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। তারা সমস্ত ভাউচার, গত ২০ বছরে মাস্টার ফাইলে রক্ষিত সমস্ত চিঠিপত্র প্রায় তিন হাজার পৃষ্ঠার কাগজপত্র পরীক্ষা করেছে। তারা সবকিছুর ফটোকপি করে দিতে চেম্বারের লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছে ও পরে এসে তারা তা নিয়েও গেছে। ওরা সাথে করে নিয়ে গেছে আমার ফেলোশিপ সংক্রান্ত সকল ফাইল ও আমার ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র যার সাথে আমার বিরুদ্ধে আনীত মামলার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।
উপরন্তু, আমি তো তাদেরই জেলখানায় অন্তরীণাবদ্ধ। তাদের যেকোনো প্রশ্ন থাকলে সরাসরি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেই চলে। পুরো উদ্দেশ্যই হলো, আমাকে অপদস্থ ও নাজেহাল করা, নিজেদের আত্মসন্তুষ্টি ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করা।
মঙ্গলবার ২৫ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৭থাইল্যান্ডে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে প্রধানমন্ত্রী থাকসিনকে অপসারণ করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করার ১৮ মাস পরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ নির্বাচনে থাকসিনের দল জয়ী হয়েছে। বিদেশে পলাতক অবস্থায় নির্বাসিত থাকসিন সামরিক বাহিনী সমর্থিত দলকে পরাজিত করেছেন। তুরস্কেও পরাজিত হয়েছে সামরিক বাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দলের।
জনগণ সবসময়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু একই সাথে তাদের জীবনও বয়ে চলে স্বাভাবিক গতিতে। তারা ব্যস্ত থাকে নিজেদের কাজে-কর্মে, যেসব দুর্নীতির সাথে নিত্যদিন তাদের পরিচয় সেগুলোতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এলাকার সাধারণ লোকজন সাধারণত তাদের নেতাদের দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বিবেচনা করে না এবং যতদিন যাবৎ নেতা তাদের দুঃখ-সুখের খবর রাখেন, রাস্তাঘাট, মন্দির, মসজিদ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা উন্নয়নের জন্য কাজ করেন, গরিব দুঃখীদের সাহায্য করেন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিপদের দিনে তাদের কাছে থাকেন, তাদের সাথে নেতিবাচক কোনো আচরণ না করেন, ততদিন পর্যন্ত। জনগণও অকাতরে তাদের সমর্থন দিয়ে যান। হাসিনা ও খালেদা উভয়ে লক্ষ লক্ষ জনগণের কাছে নেতৃত্বের আদর্শ স্থানীয়া এবং তাদের জনগণ কখনোই দুর্নীতিবাজ বলে মনে করে না। অন্ধভাবেই জনগণ তাদের শ্রদ্ধা এবং সমর্থন জানিয়ে থাকে।
থাইল্যান্ডের ঘটনাবলী উল্লেখ করে দৈনিক মানবজমিন এক নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছে, ‘সুস্পষ্ট সতর্কবাণী। মেসেজ ইজ ক্লিয়ার।’
বুধবার ২৬ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৮সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। ভয়ানক ধরনের এক ডায়রিয়া, পাশাপাশি জঘন্য ধরনের বমি আমাকে দারুণভাবে কাহিল করে ফেলেছে। পা দুটো জমে শক্ত হয়ে গেছে, সাথে অসহ্য ব্যথা। সকালের দিকে একজন ডাক্তার এসে কিছু ঔষধ দিয়ে গেছে। গোটা দিন কাটিয়েছি বিছানায় শুয়ে আমার স্বাস্থ্য এমনিতেই খুব ভঙ্গুর, ফলে এই অসুখ আমাকে আরো বেশি পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। আমি জেলে আসার পর শরীরের ওপর এটাই প্রথম আঘাত।
বৃহস্পতিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭ দিন ২৫৯আজ আমার প্রিয়তমা আম্বিয়া খাতুনের মৃত্যুবার্ষিকী। মাইজদী কোর্টের নামী একজন মোক্তারের কন্যা, যিনি ছিলেন বাংলার সুবিখ্যাত বারো ভূঁইয়ার বংশধর, আমার মা ১৪ বছর বয়সে আমার বাবার সাথে দুই পরিবারের আলোচনাক্রমে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। আমার মা স্কুলে লেখাপড়া করেছিলেন কেবল চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত। কিন্তু বাসায় প্রাইভেট টিউটরের কাছে তিনি কোরআন শরীফ, উঁচু ক্লাসের বই পড়া ও লেখার কাজ শিখেছিলেন।
আমার মা জন্ম দিয়েছিলেন ১৮ জন সন্তান-সন্ততি। এদের মধ্যে ৬ জন জন্মের সময় বা জন্মের পরপরই মারা যায়। বাকি ১২ জনকে একই সাথে তিনি লালন-পালন করেছেন, পাঠশালা থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পড়িয়েছেন, তাদের খাওয়া-দাওয়া, কাপড়চোপড়ের ব্যবস্থা করেছেন, পড়াশোনার খোঁজখবর রেখেছেন যাতে একদিনের জন্যও কারো পড়াশোনা নষ্ট না হয়। আমাদের প্রতি তার অসামান্য আত্মত্যাগ, স্নেহ-ভালোবাসা, যত্ন ও আন্তরিকতার কারণেই আজ আমরা এই পর্যায়ে উপনীত হতে পেরেছি।
আমার বাবার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রেখে যাওয়া কায়েতটুলীর বাসায় এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। সে সময় হাসনা ও আমানের সাথে আমি ছিলাম কক্সবাজার। খবর পাওয়ামাত্র আমি ও আমান তাকে সমাধিস্থ করার জন্য সেখান থেকে দ্রুত গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। সেখানে আমার বাবার পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
অসীম দুঃখময়তার সাথে যখন আমার দিনগুলো কেটে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে এলো আরেক দুঃসংবাদ। ডিআইজি এসে আমাকে সংবাদ দিলেন যে, আমার তৃতীয় জ্যেষ্ঠ ভাই মাসুদ সেজদা’ ইন্তেকাল করেছেন। দু’বছর ধরে কঠিন রোগে তিনি ছিলেন শয্যাশায়ী। বিগত কয়েক মাস ধরে তিনি ছিলেন একরকম অর্ধমৃত।
(চলবে...)