× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬০) /‘রাজনীতিবিদরা জেলখানায় যে যন্ত্রণায় ভোগেন, তাদের পরিবার ভোগেন আরও বেশি’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৭ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার

শনিবার ৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৩
পুত্র আমান ও কন্যা আনা’র ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজ বিষণ্নতায় আমার মন ছেয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই ৩১ বছরে পা দেয়া আমানের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রয়োজন একটি আশ্রয়ভিত্তিক জীবন। তার পক্ষে কখনোই আত্মনির্ভরশীল জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না। সে এখনো বাংলা লিখতে বা পড়তে পারে না। প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কারো সাহায্য ছাড়া সে ইংরেজিও লিখতে বা পড়তে পারে না। অংকের ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই। মেধার যে কোনো বিচারে এবং মানদণ্ডে সে একজন প্রতিবন্ধী। আমরা বেশিদিন বেঁচে থাকবো না।
আমাদের মৃত্যুর পর ওর দেখাশুনা করবে কে? কীভাবে, কতদিন সে টিকে থাকতে পারবে? আমানের কথা মনে এলেই অবিরাম, অনিয়ন্ত্রিত অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে যাই আমি।

শনিবার ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৪
সরকারের সমস্ত ব্যর্থতার দায়ভার ব্যক্তিগতভাবে সেনাবাহিনী প্রধানের ওপর বর্তায় এবং ইতিহাস এজন্য তাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজ প্রধান বিচারপতির ভূমিকার উন্মোচন ও প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ব্যাংকে টাকার তারল্য দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। আমানতের পরিমাণ কমছে। বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যবসায় স্থবির হয়ে যাওয়ায় কোনো উদ্যোক্তা এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার জন্য এগিয়ে আসছেন না।

সোমবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৫
রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা সরকারি কর্মকর্তা যেই হোন না কেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পাবার পর মুহূর্তে জরুরি বিধির ১৬(২) ধারার বদৌলতে আবার জেলগেটে তাদের গ্রেপ্তার করার প্রক্রিয়া আসলে এ সরকারের ফ্যাসিস্ট চেহারাই উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। কাজেই এখন আর আইনের শাসন চলছে না, চলছে আইনশূন্যতা। সরকারের গ্রহণযোগ্যহীনতাই এটা এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
ঢাকা নগর কর্পোরেশনের একজন নির্বাচিত কমিশনার ও বিএনপি নেতা আবদুল কাইউম কারাগারে অন্তরীণাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পরিবারবর্গ সন্দেহ করছেন যে, জেল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবই তার মৃত্যুর কারণ।
রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তারে নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিএনপি যুব সংগঠনের সক্রিয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে আটক করা হয়েছে।

শনিবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৬
গতরাতে আমি চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখলাম আমার বাবাকে। বন্দিকালীন দ্বিতীয়বারের মতো স্বপ্নে দেখলাম তাঁকে। অত্যন্ত যত্ন ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে বাবা একজন বুজুর্গ ব্যক্তিকে খাবার পরিবেশন করছিলেন। অলি বা আউলিয়া মাপের সেই বুজুর্গ ব্যক্তি বসেছিলেন ঘরের মেঝেতে। আমার মনে এ নিয়ে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
এতরাতে আবার আমাদের ওপর জেল কর্তৃপক্ষ স্টিমরোলার চালিয়েছে। হঠাৎ করেই একদল সশস্ত্র পুলিশ আবির্ভূত হয়েছে কয়েকজন অফিসার নিয়ে। কয়েক ঘণ্টা ধরে প্রত্যেকটি সেলের তালা খুলে তারা প্রতিটি জিনিসপত্র তন্ন তন্ন করে তল্লাশি শুরু করে। কারণ হলো, নাজমুল হুদা ও এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কাছ থেকে তারা মোবাইল ফোনের সন্ধান পেয়েছে এবং সে কারণে সবাইকে নতুন করে তল্লাশি করা হচ্ছে। কেবলমাত্র পুরনো ও বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত আমার সহকারী সেবক জিয়াউদ্দিন ছাড়া সকল মেটকে প্রত্যাহার করা হয়েছে, গোটা দিন সেলগুলোর পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাকর। ওদের আচরণে আমরা সবাই ছিলাম ক্ষুব্ধ। আমাদের জন্য এটা ছিল চরমভাবে বিব্রতকর ও অপমানজনক।

বুধবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৭
আমি জেলখানায় আছি আজ প্রায় দশ মাস। বিচার নেই, জামিন নেই, নেই স্বাধীনতা। হাইকোর্টের দেওয়া তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর জামিন আপিল বিভাগ রদ করে দেয়নি। এর একমাত্র কারণ তৌফিক একজন রাজনীতিবিদ নন। এতে আপিল বিভাগের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রমাণ মিলে। তবে এই খবরে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট। আশা করি অচিরেই তৌফিক বেরিয়ে যেতে পারবে।

বৃহস্পতিবার ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৮
আজ হান্নান শাহ্ জামিনে মুক্তিলাভ করে অনেকগুলো কাগজের শিরোনামে এসেছেন। গতবার জামিন পাওয়ার পরমুহূর্তে বানোয়াট একটি চাঁদাবাজির মামলায় অভিযুক্ত করে আবার আটক করা হয়েছিল তাকে। শুধুমাত্র নাজেহাল করা এবং দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট- দেশের নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, যতদিন জরুরি অবস্থা বহাল থাকবে ততদিন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নেই। তারা দ্রব্যমূল্যের আরো ঊর্ধ্বগতি ও অধিকতর মুদ্রাস্ফীতির ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যা গরিব জনগণের ভোগান্তিকে আরো বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে।
দ্বিতীয় একটি বই লেখার পাশাপাশি আমি ইতিমধ্যেই শেষ করে আনা প্রথম বইটির টাইপ করা পাণ্ডুলিপি সংশোধন করতে মনস্থ করেছি। কিস্তি আকারে খণ্ড খণ্ডভাবে সেগুলো আমার কাছে আসছে। আমার সেক্রেটারি অশোক বাবু অতি সন্তর্পণে চেম্বারে বসে থেকে গোপনে সেগুলো টাইপ করে বিভিন্ন লুকোনো কায়দায় আমার কাছে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছেন। এজন্য তাকে প্রচুর ঝুঁকি নিতে গোয়েন্দা বাহিনীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও নিয়মিত তল্লাশিকে অতি সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে। সৌভাগ্যবশত যখন তাদের অনেকে আমার ব্যাগ তল্লাশি করে তখন তারা বোঝে না এতে কি রয়েছে। বেশির ভাগ সময়ই তারা ভাবে এগুলো আমার মামলাসংক্রান্ত কাগজপত্র। এখন পর্যন্ত আমার পাণ্ডুলিপির আগমন-নির্গমন একরকম উপদ্রববিহীনভাবেই চলছে। আশা করি এগুলো ধরা পড়বে না।

শুক্রবার ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩০৯
বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার ফলে সৃষ্ট খাদ্য সংকটকালে ভারত সরকার বেশ কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যে বাংলাদেশকে ৫ লাখ টন চাল পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলে সবাই একে বৃহৎ প্রতিবেশীর শুভেচ্ছার অভিব্যক্তি বলেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুত খাদ্যের এক টনও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি। সুতরাং সংবাদপত্রগুলোর উপসম্পাদকীয় কলামে অনতিবিলম্বে প্রতিশ্রুত ৫ লাখ টন চাল সরবরাহের জন্য দাবি জানিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে করিৎকর্মা ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী উদ্ভূত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা না খেয়ে কি আপনাদের খেতে দেবো?” অনেকেই বলেছেন, এটা এক রাষ্ট্রের প্রতি অন্য রাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিশ্রুতির একটি বরখেলাপ। কেউ কেউ একে কূটনৈতিক অশিষ্টাচার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমি মনে করি, এর কোনোটাই ঠিক না। আসলে ভারত তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে উপযুক্ত কোনো মূল্য দেয় না। কাজেই এ ধরনের প্রতিশ্রুতি রাখা না রাখার পরোয়া তারা করে না। একমাত্র বিষয় হলো, মজুতদাররা জানতে পারছে যে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাল খুব শিগগিরই বাজারে আসছে না। কাজেই খোলাবাজারে চালের দাম আরো বাড়বে।

শনিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১০
সদম্ভ পদচারণায় টাস্কফোর্সের সদস্যরা আবার প্রবেশ করেছে আমার চেম্বারে, কোনো কোর্ট অর্ডার কিংবা জব্দ তালিকা না দিয়েই তারা নিয়ে গেছে আরো অনেকগুলো ফাইল, দলিলপত্র ও ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র। আমান ও আনাসংক্রান্ত ফাইলগুলোও তারা নিয়ে গেছে। তারা আমার গ্রামের বাড়িতেও গিয়ে নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ও বাড়ি মাপজোখ করে গেছে। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তুলেছেন। গত ১০ মাসে দেশে কোনো হরতাল, ধর্মঘট, ঘেরাও বা রাজনৈতিক সংঘাত হয়নি। এরপরও দেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়নি কেন বা জনগণ খুশি নয় কেন? ২০০৬ সালে
প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মূদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশ, আমন চালের দাম ছিল প্রতিকেজি ১৮ টাকা। এখন এর দাম ৩৮ টাকা, মূদ্রাস্ফীতি ১১ শতাংশ, প্রবৃদ্ধির হার নেমে গেছে ৫ শতাংশেরও নিচে, দুর্নীতির মাত্রা রয়ে গেছে আগের মতোই।

রবিবার ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১১
বিএনপি’র চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে বলে দিয়েছিলেন, কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি’র প্রতিনিধিত্ব করবেন কারা। কিন্তু ‘রাজনৈতিক ধরনের অজুহাতে জেল কর্তৃপক্ষ সে চিঠি পাঠাতে অস্বীকার করেছেন। কর্তৃপক্ষের এ অস্বীকৃতিই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তা করা হয়েছে। জেলের ভেতরে নিজ নিজ কক্ষে  মোবাইল ফোন রাখার অপরাধে নাজমুল হুদা এবং আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।

সোমবার ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১২
সরকারের ভীতিপ্রদর্শন, আতঙ্ক, নির্যাতন ও অত্যাচারের প্রক্রিয়া একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের নতুন নতুন কাহিনী বিভিন্ন সূত্রে আমার কাছে আসছে। এদের মধ্যে কোনো কোনোটা একেবারে অবিশ্বাস্য! এগুলো সব লিখতে গেলে কয়েক শ’ পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। সরকারের মধ্যে কি দয়ালু, সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল ও মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন একজন লোকেরও অস্তিত্ব নেই? নিষ্ঠুরতা এই সরকারের একটি পরিচিত চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি জানতে পারলাম হাসনার শরীর ভালো যাচ্ছে না। পায়ে ও কোমরে ব্যথা অনুভব করছে। অন্য সবকিছুর চাইতে আমি বেশি বিব্রতবোধ করি এই ভেবে যে, হাসনাকে ধার করে জীবন চালাতে গিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। আনা এবং আমান তাদের খাবার, কাপড়চোপড়, গোসল, বেড়ানো, সবদিক দিয়ে ওর ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। হাসনা যদি ব্যথার জন্য নড়াচড়া করতে না পারে তাহলে বাচ্চাদের কি অবস্থা হবে? প্রত্যেক দিন পার হয় আর আমি হাসনার ধৈর্য, ত্যাগ ও সহ্য শক্তির প্রশংসা করি। মা হিসেবে তার প্রথম সন্তানের মৃত্যু তার হৃদয়ে যে গভীর ক্ষতের স্পর্শ রেখে গেছে তা অনুধাবন করার মতো ক্ষমতা অন্য কারো নেই। এমনকি আমারও নেই।
রাজনীতিবিদেরা জেলখানায় থেকে যে যন্ত্রণা ভোগ করেন, তাদের পরিবারবর্গের যন্ত্রণা নিঃসন্দেহে তার তুলনায় অনেক বেশি।

(চলবে..)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর