মঙ্গলবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৩জেলখানার ভেতরে মেডিক্যাল চিকিৎসাব্যবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল। জেল হাসপাতালের ভঙ্গুর অবস্থা রোগীদের জীবনকে আরো সংকটাপন্নই করে তোলে। পুরো হাসপাতালে সেবা ব্যবস্থার তুলনায় রোগীর আধিক্য এর অন্যতম কারণ। মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে বিছানার কাজ সারা হয়। চারদিকের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। দশ হাজার কারাবন্দির জন্য মাত্র তিনজন ডাক্তার, জরুরি ওষুধের সরবরাহও অপর্যাপ্ত ডাক্তাররা এত ব্যস্ত যে, সহজে তাদের পাওয়া যায় না। জরুরি পরামর্শ থাকলেও ডাক্তারের দেখা মিলতে কখনো কখনো ২/৩ দিন লেগে যায়। এক্স-রে কিংবা প্যাথলজিক্যাল টেস্টের কোনো ব্যবস্থা নেই।
নেই বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শক পর্যায়ের কোনো চিকিৎসক।
এখন আমি বাইরের হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণটা বুঝতে পারছি। আসলে তারা চান, আমরা রোগের যন্ত্রণায় ভুগে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে জেলখানাতেই মারা যাই।
বুধবার ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৪পাকিস্তানে জাতিগঠনের জন্য অবশ্য-প্রয়োজনীয় মৌলিক সামাজিক ও রাজনৈতিক আচ্ছাদন অব্যাহত সামারিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। এর ফলে পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিণত হতে চলেছে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিগত আট বছরের শাসন দেশটিকে আরো দুর্বল ও ধ্বংসের সম্মুখে নিয়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানের পরিস্থিতি আজ এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সামরিক শাসন ছাড়া এ দেশ আর পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আট বছর প্রবাসে নির্বাসিত থাকার পর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দেশে ফিরে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন বেনজীর ভুট্টো।
নির্বাচনে বেনজীরের দল জয়লাভ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও গণতন্ত্র সেখানে বেশিদিন স্থায়ী হবে না এবং যখনই পাকিস্তানকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, তখনই ঘটবে সামরিক হস্তক্ষেপ।
বৃহস্পতিবার ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৫আজ মহান ভাষা আন্দোলন দিবস, শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার সূত্রপাত, ১৯৭১ সালে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে রক্তস্নাত যুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তার ফসল দেখেছি আমরা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম নবম শ্রেণির একজন ছাত্র। তবে আন্দোলনরত সংগ্রামীদের জন্য আমি এক আবেগতাড়িত কৌতূহলে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেলের সামনে বর্তমান শহীদ মিনারের কাছে পুলিশ
ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের সময় আমি বরকত, সালাম ও রফিককে প্রাণত্যাগ করতে দেখেছি। আমি তাদের রক্তে ভেজা আমার শার্ট কায়েতটুলীর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সকলের কাছে ঘটনার চাক্ষুষ বিবরণ দিয়েছি। সেদিন আমিও মারা যেতে পারতাম। চারদিকে অবিরাম গুলিবৃষ্টির মধ্যে আমি ছুটোছুটি করছিলাম নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।
একই দিনে ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমার জীবনে ঘটে কারাবাসের প্রথম অভিজ্ঞতা। আমি তখন ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। বয়স ১৬-এর কাছাকাছি আমি ছিলাম গ্রেফতারকৃত ১১০ জনের মধ্যে সম্ভবত কনিষ্ঠতম। যাদের সাথে আমাকে আটক করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন সিনিয়র ছাত্রনেতা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এসএ বারী এটি ছাত্রলীগের সভাপতি এমএ আউয়াল, ছাত্রশক্তির সভাপতি ফরমান উল্লাহ খান, ইসলামিক ব্রাদারহুডের সভাপতি ইবরাহীম তাহা, এছাড়াও আরো অনেকের মধ্যে আবুল মাল আব্দুল মুহিতও ছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হয়েছিলাম আমরা। সুদীর্ঘ সেই কাহিনী, সব আমার স্মৃতিতে এখনো ভাস্বর। প্রায় এক মাস পরে আমরা সবাই ছাড়া পাই।
শুক্রবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৬দেশ এক মহারাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হলেও দু’টি বড় দল ও নেতাদের মধ্যে ঐক্যের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এখনো বিএনপিকে দোষারোপ করছে। বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি করার সময় শেখ হাসিনারও মুক্তি দাবি করছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা হাসিনার মুক্তি দাবি করার সময় খালেদার নামও উচ্চারণ করেন না।
জনগণ এই পারস্পরিক ঘৃণাবোধের রাজনীতি আর দেখতে চায় না। কিন্তু এই অদক্ষ ও অযোগ্য সরকারের নেতৃত্বও বাস্তব কোনো বিকল্প জনগণকে উপহার দিতে পারছে না।
শনিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৭তৃতীয় বিশ্বে জেনারেলরা সচরাচর সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতার আসনে বসার পর বই লিখতে পছন্দ করেন। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান তার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য পূর্ণ ক্ষমতা নেওয়ার আগেই কাজটি শুরু করেছেন। ঘটনাটি খুবই চিত্তাকর্ষক বটে। বইটি নিতান্তই সাদামাটা ধরনের কেবলমাত্র তার কিছুসংখ্যক বক্তৃতার উদ্ধৃতি সমন্বিত গ্রন্থ, কোনো সারবত্তা নেই বললেই চলে। তবে দামি গ্লসি পেপারে ছাপানো নির্বাচিত সংকলন নামের এই বইটি পড়ার যন্ত্রণা মাথায় নেওয়ার আগেই কতিপয় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে- (১) প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে জনগণের তহবিল থেকে বেতন নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান কি রাজনৈতিক ধরনের এ সরকারি নীতিমালাসংক্রান্ত বই লিখে সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘন করেননি? (২) বই প্রকাশ করতে গিয়ে সরকারি অফিস ও সুযোগ ব্যবহার করে তিনি কি দুর্নীতি করেননি? (৩) বিক্রয়মূল্যবিহীন এই প্রকাশনার জন্য অর্থ সেনাবাহিনী প্রধান কোথায় পেয়েছেন এবং এর জন্য অর্থের যোগান দিয়েছে কে বা কারা? এমনকি জনপ্রিয় একজন লেখককেও বই প্রকাশের খরচ ও তা ওঠাবার মতো একটি প্রকাশক খুঁজে বের করতে অনেক সময় গলদঘর্ম হতে হয়।
আজ ছিল দর্শনার্থীদের আসার দিন। আমরা সচরাচর এমনভাবে তাদের আসার সময় বেছে নিই, যাতে করে উভয় পরিবার পরস্পরের সাথে মিলিত হতে পারি জেলগেটে। এতে করে তৌফিক ছাড়াও আসমা ও দুলির সাথেও দেখা হয়।
রবিবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৮দেশটি যেন পুরোপুরিভাবে পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থাধীনে রয়েছে। কোনো কাজের পেছনে কোনো যুক্তি, নীতিবোধ নেই। সব কাজেকর্মে কেবল ঔদ্ধত্য এবং স্বৈরাচারিতার ছাপ। গতকাল হাসপাতালে কয়েকজনের সাথে কেবল কথা বলার অভিযোগে আমানউল্লাহ আমানকে শাস্তি হিসেবে আজ নারায়ণগঞ্জ জেলে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।
ছয় দিনের এক মহাসফরে ভারত যাচ্ছেন সেনাবাহিনী প্রধান। এই প্রথমবারের মতো একজন সেনাবাহিনী প্রধান যাচ্ছেন ভারত সফরে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। কাজেই এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই স্বাভাবিক। আমি নিশ্চিত যে, ভারতকে উপযুক্ত সেবাদানের প্রেক্ষাপটে সেনাপ্রধানকে নয়া দিল্লিতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হবে।
সোমবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩১৯আমানউল্লাহ আমানকে শাস্তি দেওয়ার সাথে সাথে আমাদের সকলের মেডিক্যাল চিকিৎসাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটা নিতান্তই দুঃখজনক। আমানের সাপ্তাহিক অতিথি দর্শন এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তার সন্তানেরাও তাকে আর দেখতে পারছে না। অথচ তারা কী দোষ করেছিল? এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।
প্র্রথম আলোর মতো উদ্দেশ্যতাড়িত কয়েকটি খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে যে, কারাগারে আটককৃতদের কারাগারের বাইরে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। এটা বলা যাবে না যে, জেলখানার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা অবহিত নন। কিন্তু শুধুমাত্র নিজেদের হীনমন্যতা ও মানসিক দৈন্যের কারণেই তারা এমনভাবে লিখতে পারেন। বিচারাধীন ব্যক্তিদেরও জীবন রক্ষার জন্য সবরকম চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসাসেবা পাওয়া আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে আমার আর হাসপাতালে যাওয়া হয়নি। অসহায় হয়ে ডেপুটি জেলার নাসিরকে তাৎক্ষণিকভাবে একজন ডাক্তার পাঠাবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম গতকাল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ডাক্তার আমার কাছে আসেনি।
বিচারপতি জনাব শাহ আবু নাঈম জরুরি আইনের কতিপয় বিধানকে সংবিধানের আন্ট্রা ভায়ার্স (পরিপন্থি) বলে যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে দিয়েছেন। এভাবে দেশে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধান বলবৎ থাকা সত্ত্বেও দেশের উচ্চতম আদালত সংবিধানকে জরুরি আইনের অধঃস্তন করে ফেলেছে।
এছাড়াও জামিন এবং নিবর্তনমূলক আটকাদেশের ক্ষেত্রেও আপিল বিভাগ একই মনোভাব প্রদর্শন করে সংবিধানের অবমাননা করে প্রাধান্য দিচ্ছে জরুরি আইনকে।
বিগত প্রায় এক বছর ধরে সুপ্রিম কোর্ট পূর্ণ রায় ঘোষণার জন্য নিয়মিত কোনো আপিলের শুনানিই করছেন না। এভাবে আমরা এখন বাস করছি বিচার বিভাগের অন্ধকারতম সময়টাতে। জনগণের অর্থে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান জনগণের স্বার্থের বাইরে হিসাববিহীনভাবে চলতে পারে না এবং বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এ কারণেই দেশের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণ করার জন্য পার্লামেন্টের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার বিধান থাকার বিষয়টি জরুরি। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৯৬ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যমূলক চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এ না হলে বিচার বিভাগ নিজস্ব শক্তিবলে এক স্বৈরাচারী দৈত্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সুবিচারের প্রতীক হওয়ার পরিবর্তে ধ্বংসের বাহক হিসেবে গণতান্ত্রিক একটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বিনষ্ট করে দিতে পারে।
(চলবে..)