× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মওদুদ আহমদ যখন রিমান্ডে (৬২) / ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া একবার ব্যাহত হলে তা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়’

বই থেকে নেয়া

স্টাফ রিপোর্টার
২৯ মে ২০২১, শনিবার

বুধবার ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩২১
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া উভয় নেত্রীই দূরদৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে রাজনীতি করেন। তাদের পারস্পরিক রাজনৈতিক ঘৃণাবোধ এবং অসহনীয়তার ফলে জাতিকে প্রচুর খেসারত দিতে হয়েছে। তাদের এককেন্দ্রিক ও ব্যক্তিনির্ভর শাসনকে অনেকে সুশাসনের অন্তরায় বলে মনে করে। আমার প্রত্যাশা একদিন তারা এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসবেন এবং জাতিকে গণতন্ত্রের অনুপ্রেরণা সম্বলিত প্রাতিষ্ঠানিক গুণাবলী উপভোগের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবেন। এই ধরনের সম্পর্কে যদিও খালেদা জিয়া তুলনামূলকভাবে উদার ও সহনশীল, কিন্তু শেখ হাসিনা একেবারে অসহনশীল এবং কঠোর অবস্থান নিয়ে চলেন।

সেনাবাহিনী প্রধানের সরকারও রাজনীতিবিদদের আক্রমণ করে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা করছে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে টুকরো করার প্রচেষ্টা নিয়ে নিদারুণ অনৈতিক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। মান্নান ভূঁইয়া ও সাইফুর রহমানকে বিএনপি’র মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর এবার তারা বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি নামক প্রকল্পে অবৈধভাবে একটি চীনা কোম্পানিকে ঠিকাদারি দেওয়ার অভিযোগে খালেদা জিয়ার সাথে সেই একই সাইফুর ও মান্নানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছে। এই মামলার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে, এই সরকারের কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দিকদর্শন নেই এবং তাদের সহযোগী শক্তিগুলোর সাথে অনৈতিক আচরণেও তারা বিন্দুমাত্রও দ্বিধাবোধ করে না।
আমি ভাবছি আজ সাইফুর রহমান ও মান্নান ভূঁইয়া তাদের অন্তরে কি অনুভব করছেন? এই নৈতিকতাবর্জিত বিশ্বাসঘাতক সরকার আওয়ামী লীগের অন্তত চারজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং আমির হোসেন আমুকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্ররোচিত করেছে, কিন্তু একপর্যায়ে আবার তোফায়েল ও তার পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও এনেছে। সেনাপ্রধানের সরকার এভাবে চরমতম রাজনৈতিক দুর্নীতির পরিচয় দিয়েছে।

বৃহস্পতিবার ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩২২
বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে অবৈধ সামরিক সরকারের চক্রান্ত অনুযায়ী কোণঠাসা করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন তাদের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে সাইফুর রহমান ও হাফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন অংশকে বিএনপি’র প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আহ্বান জানানোর বিষয়ে ড. কামাল হোসেন হাইকোর্ট ডিভিশনে উত্থাপিত মামলায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছেন। এতে করে রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার জন্য জেনারেল মঈনের সরকার যে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছেন, তার সাথে ড. কামাল হোসেনের সম্পৃক্ততার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন ও নির্বাচন কমিশন যেখানে সাইফুর রহমানের পক্ষ নিয়ে তাকে বিএনপি’র প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করছেন, সেখানে সরকার স্বয়ং খালেদা জিয়ার সাথে সাইফুর রহমানকেও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি প্রকল্পের মামলায় সহ-অভিযুক্ত করে পরস্পর বিরোধী ঘটনার অবতারণা ঘটিয়েছেন।

শুক্রবার ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ দিন ৩২৩
আমার পরম পূজনীয় বাবাকে এবারের জেলজীবনে তৃতীয়বারের মতো স্বপ্নে দেখলাম। অথচ জেলে আসার আগে স্বপ্নে বহু বছর তাকে দেখিনি। স্বপ্নে বাবা আমাকে জানালেন যে, বেলা ২টা থেকে ৩টার মধ্যে তিনি সবাইকে কোলকাতায় আমাদের দাদাজী, বিশিষ্ট ওলী হজরত মাওলানা মোহাম্মদ সফিউল্লাহর দরবারে নিয়ে যাবেন। আমার বাবা ছিলেন দাদাজীর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ১৯২১ সালে তিনি দাদাজীর সঙ্গে একসাথে হজব্রত পালন করেন। আমি সবসময় দাদাজীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করি। আমরা সবাই তার গভীর আশীর্বাদে সিক্ত।
মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ১২ শতাংশ, চালের কেজি ৩৮ টাকা, আটা ৪৫ টাকা এবং ডাল প্রতিকেজি ৯২ টাকা। গরিব লোকজন এখন যাবে কোথায়? বাঁচবে কীভাবে?

শনিবার ১ মার্চ ২০০৮ দিন ৩২৪
দু’দিন অপেক্ষায় বসিয়ে রাখার পর আমার প্রস্টেট সমস্যা দেখার জন্য অবশেষে গতকাল জেল হাসপাতালের ডাক্তার হাবিব আহসান এসেছিলেন। কিন্তু সাধারণ পরামর্শ দেওয়া ছাড়া তার করার কিছু ছিল না। কারণ যথার্থ ওষুধ দেওয়ার আগে রোগ পরিনির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ছাড়া তার কিছু করার উপায় ছিল না। তিনি বললেন, বিশেষজ্ঞ দিয়ে দেখানোর জন্য পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করে তিনি একটা নোট পাঠাবেন। গত ২৪ ঘণ্টায়ও তিনি কোনো রিপোর্ট দেননি এবং আমি মূত্রাশয়জনিত ব্যথায় কাতরাচ্ছি।
আমানের শ্বশুর, জোরাহর বাবা সামসুল হক আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন একজন ব্যক্তি।

রবিবার ২ মার্চ ২০০৮ দিন ৩২৫
ছয় মাসের একটি ফেলোশিপে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিতে হাসনা ওয়াশিংটন পৌঁছেছে। আমার মনে হচ্ছে, যুক্তরাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হাসনা আমার কাছ থেকে আরো দূরে চলে গেল। এখন আমান ও আনাকে নিজেদের মতো করে থাকতে হবে। ওর অর্থনৈতিক সমস্যা হয়তো কিছুটা কাটবে, তবে সন্তানদের জন্য তার ধারকর্জের পালা চলতেই থাকবে।
যৌথবাহিনীর সদস্যরা যখন আমাকে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নিয়ে যায় তখন তারা অভিযোগ এনেছিল যে, বিদেশে আমার অনেক অর্থ সঞ্চিত রয়েছে। আমি বিদেশি কোনো অর্থের উৎসের কথা স্বীকার না করায় কদর্য ভাষায় তারা আমাকে অপমান করেছে। এখন আমার রাগে ক্ষোভে চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা হয়, তারা গিয়ে দেখুক অর্থের অভাবে আমার পরিবার এখন কী ধরনের জীবন অতিবাহিত করছে?

সোমবার ৩ মার্চ ২০০৮ দিন ৩২৬
জনৈক মেজর রেদোয়ানের নেতৃত্বে টাস্কফোর্সের একটি দল, যারা ১২/৪/২০০৭ তারিখে আমার বাড়িতে প্রথমবারের মতো চড়াও হয়েছিল, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা সম্পত্তি ও আয়বিষয়ক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দেখা করতে এসেছিল আমার সাথে। আমি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্বলিত নোটিশ ও আমার আইনজীবীর উপস্থিতিতে লিখিতভাবে অভিযোগ খ-ন করার অধিকার সম্পর্কিত আইনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। এই কারণে মামলা তদন্তকালে তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। তারা আর ফিরে আসেনি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী শুনানির কোনো সুযোগও আমাকে তারা দেয়নি।
একজন খুনি, ধর্ষণকারী বা সন্ত্রাসীরও জামিন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু জরুরি ক্ষমতা আইনে আমাদের তাও নেই।
সরকারের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল প্যারোলে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গেছেন। এরআগে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এবার তিনি তাদের নেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা সংকুচিত করার জন্য দলে সংস্কারবাদীদের তালিকায় আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে যুক্ত হলেন।

মঙ্গলবার ৪ মার্চ ২০০৮ দিন ৩২৭
সুপ্রিম কোর্টের মান ও মর্যাদার অবক্ষয়ের পরিমাণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সংবাদপত্রে ও অন্যান্য সূত্রের খবর অনুযায়ী সরকার তাদের অপছন্দের ১৮ জন বিচারককে ইস্তফা দেওয়ার জন্য একটি তালিকা তৈরি করেছেন আর ইস্তফা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট বিচারকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এক চা চক্রে যেতে, কিন্তু পদত্যাগে অস্বীকার করায় শেষ পর্যন্ত এই দুরভিসন্ধিমূলক অভিযানের প্রতিবাদে গণঅসন্তোষের মুখে সরকার পিছু হটে গেছে। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের একজন স্থায়ী বিচারপতিকে কেবলমাত্র প্রেসিডেন্টের সুপারিশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অপসারিত করতে পারে, তবে তা হতে হবে কেবল শারীরিক অসামর্থ্য বা তার বিরুদ্ধে আনীত গুরুতর অসদাচরণের কারণে, যা প্রমাণ করা একটি অত্যন্ত দীর্ঘ প্রলম্বিত প্রক্রিয়া। তাই বিচারকরা নিজেদের আত্মমর্যাদা রক্ষার বিবেচনায় প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এরআগে বিচার বিভাগ ও বিচার প্রশাসনের স্বাধীনতার ওপর এ ধরনের নগ্ন হস্তক্ষেপ ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।
আমি নিজেকেই অভিশাপ দেই যখন আমি দেখি যে, আমার কারণেই আমান তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে পারছে না। সে একজন অতি সাধারণ, নিষ্পাপ, খাঁটি ও ফেরেস্তাতুল্য সন্তান।

বুধবার ৫ মার্চ ২০০৮ দিন ৩২৮
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে। এমনকি আওয়ামী লীগও এখন যদি নির্বাচিত সরকার হিসেবে ক্ষমতায় অভিষিক্ত হয়, তাও হবে অনির্বাচিত ও জবাবদিহিতাবিহীন একটি সরকার ব্যবস্থার চাইতে ভালো। জীবনযাত্রার প্রতি পর্যায়ে এখন চলছে চরমতম অস্বাভাবিকতা। এ অস্বাভাবিকতা যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই মঙ্গল।

বৃহস্পতিবার ৬ মার্চ ২০০৮ দিন ৩২৯
আজকেও আমাকে চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে নিয়ে যেতে অস্বীকার করা হয়েছে। আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলেও জেল কর্তৃপক্ষ আমার হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া একবার ব্যাহত হলে তা ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আর এরইমধ্যে অবৈধ সরকারের অব্যাহত শাসন প্রক্রিয়া চলে, জাতি প্রত্যক্ষ করে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের মতো উত্তাপ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে, শেখ হাসিনাকে চিকিৎসার অজুহাতে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে বিরোধী দলের বিক্ষোভ স্তিমিত করা হয় এবং প্রধান বিচারপতি জামিন স্থগিত করে নাগরিক ও জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করে গোটা জাতিকে করেন যন্ত্রণাবিদ্ধ।

শুক্রবার ৭ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩০
জরুরি ক্ষমতা আইনের ১১নং বিধি ব্যবহার করে আপিল বিভাগ তিন বছরের সাজা প্রাপ্ত মানবাধিকার আইনজীবী সিগমা হুদা এবং তরুণ ব্যারিস্টার হেলালের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া জামিন রদ করে দিয়েছে। তবে এর জন্য একটি পথ উন্মুক্ত করে রায়ে বলা হয়েছে যে, অল্পতর সময়ের জন্য সাজা এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই জামিন বিবেচনা করা যেতে পারে। এখন দুজনকেই নতুন করে জামিন পাওয়ার জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনের দ্বারস্থ হতে হবে।

(চলবে...)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর