শনিবার ৮ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩১দেশের উচ্চতম আদালত থেকে সংবিধানের ওপর জরুরি ক্ষমতা আইনকে (১১ নং ধারা) অগ্রাধিকার দিয়ে জামিন প্রদানে অস্বীকৃতি, জামিন স্থগিতকরণ করে গোটা জাতিকে হতাশায় নিমজ্জিত করা হয়েছে। বিচারকরা এখন তাদের শপথগ্রহণের সময় দেওয়া জাতির সংবিধানকে সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যার ফলে সরকারের এজেন্টদের হাতে এখন জরুরি ক্ষমতা আইন নির্বিচারে ব্যবহার করে নির্যাতন, অবৈধ গ্রেফতার, নাজেহালকরণ ও অত্যাচারের লাইসেন্স তুলে দেওয়া হয়েছে।
দুই ছেলেকে নিয়ে আমার বোন নাফিসা আমাকে দেখতে এসেছিল। হাসনার সাথে কথা বলার পর ওদের সম্পর্কে অনেক খবর আমাকে দিয়েছে। হাসনা ও সন্তানেরা এখন কুশলেই আছে।
রবিবার ৯ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩২সরকার সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনসহ সারা দেশে বার এসোসিয়েশনগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, অথচ গতবছরেও সর্বত্র যথারীতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যারা একবার বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে, নেমে গেলে বাঘ তাদের খেয়ে ফেলবে এই ভয়ে তখন তারা আর বাঘের পিঠ থেকে নামতে পারে না। সেই ভয়ই এখন বাসা বেঁধেছে সরকারের মনে। এই নির্বাচন এখন তাদের ওপর দেখা দিয়েছে এক হুমকি হিসেবে।
ভারত কেবল বাংলাদেশে ৫ লাখ টন চাল পাঠানোর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু চালের দাম টনপ্রতি ১৫০ ডলার বাড়িয়ে ৬৫০ ডলারে উন্নীত করেছে। এখন এ দামে আমদানি করা হলে খোলাবাজারে চালের দাম উঠে যাবে কেজি প্রতি ৪৮ টাকায়।
এতে বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের সাথে লেনদেনে এ সরকার পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এরপরও সরকারের দিনকাল চলছে কোনোরকমের জবাবদিহিতা ছাড়াই।
সোমবার ১০ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩৩জেলখানা ও হাসপাতালে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাত্রা আরো একদফা বাড়ানো হয়েছে। এবার রান্না ও খাবার সরবরাহের ওপর নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। হঠাৎ করেই চৌকা বা কিচেন বন্ধ করে দিয়ে সমস্ত বাবুর্চি ও হেলপারকে সূর্যাস্তের আগেই নিজ নিজ সেলে ফিরে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার অর্থ হলো, এখন থেকে কন্টেইনারে করে খাবার সরবরাহ করা হবে বিকালের দিকে এবং রাতে খাওয়ার সময় অবধি সে খাবার ঠা-া ও গন্ধময় হয়ে যাবে। আর সেই খাবারই আমাদের খেতে হবে।
আমার বিগত ৪২ বছর যাবৎ চলে আসা চেম্বার, দেশের অন্যতম বৃহৎ ও ব্যস্ততম ছিল, এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। আমাকে গ্রেফতারের পর আমার সবগুলো ব্যবসায়িক ক্লায়েন্ট ভয়ে চলে গেছে এবং আমার অনুপস্থিতিতে আজিজুল হক, ব্যারিস্টার খোকন ও অন্যান্য জুনিয়রের হাতে এখন আর মামলা নেই বললেই চলে। তারাও এখন জীবিকার স্বার্থে স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা করছে বলে ফার্মের কোনো আয় হচ্ছে না। রাজস্ব বোর্ডের অনুমতিক্রমে আমার সংসারের খরচ হিসেবে ফ্রিজ করা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিমাসে যে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে তার পুরোটাই খরচ হয়ে যাচ্ছে চেম্বারের ভর্তুকি হিসেবে। পরিবার দেশের বাইরে বলে এই পুরো টাকাই আমি ফার্মকে বাঁচানোর জন্য দিয়ে দিচ্ছি। অথচ আগে অবস্থা ছিল এর উল্টো। আমি প্রতিবার জেলে কিংবা সরকারে থাকার সময় ফার্ম থেকে পরিবারের চলার জন্য পর্যাপ্ত টাকার যোগান দেওয়া হতো। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকটে পরিস্থিতি হয়তো আরো সঙ্গীন আকার ধারণ করবে।
মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩৪গত এক সপ্তাহের বেশি সময় যাবৎ আমার মূত্রনালীতে ব্যথায় কাতর থাকার পর চিকিৎসার জন্য শেষ পর্যন্ত গতকাল আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। প্যাথলজিক্যাল টেস্টের জন্য নার্স এসে রক্ত ও প্রস্রাব নিয়ে গেছে। কোনো ওষুধ দেয়নি। অর্থাৎ আরো বেশকিছু সময় ভুগতে হবে আমাকে।
পত্রিকায় খবর আসছে কোরআন শরীফে পরিষ্কার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে সরকার পুত্র-কন্যাকে সম্পত্তির সমান অংশীদার করার উদ্যোগ নিয়েছে। ক্ষমতালোভীরা এখন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছে। তাছাড়া সংবিধানের ৫৮(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে এ ধরনের সংবেদনশীল নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে। হাত দেওয়ার কোনো এখতিয়ারই এ সরকারকে দেয়া হয়নি।
বুধবার ১২ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩৫আমার বন্দি জীবনের প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আমার যে ক্ষতি হয়েছে কেবল তা নিয়েই একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যরে বই লিখে ফেলা যায়। সংক্ষেপে বলা যায়:
১. চোখবাঁধা অবস্থায় রিমান্ডে থাকাকালীন আমার ওপর অন্ধকূপে যৌথবাহিনীর সদস্যদের ৫ দিন অত্যাচার, নির্যাতন, অপমান ও নাজেহালকরণ।
২. পরিবারের সাথে থাকতে দেয়ার অধিকারচ্যুত করে আমার সন্তানদের বিচ্ছিন্ন রাখার ফলে তাদের ওপর মানসিক প্রতিক্রিয়া।
৩. বিদেশে পরিবারবর্গের চরম আর্থিক সংকট এবং মনোযাতনা। এমনসব লোকজনের কাছ থেকে টাকাপয়সা ধার করে জীবন ধারণ করতে হয়েছে। যাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য কোনোদিন নিতে হবে তা ভাবতেও পারিনি।
৪. স্ত্রীর সাথে বসবাস করার অধিকারবঞ্চিত আমানের মনোযাতনা।
৫. গুলশানের বাড়ি সম্পর্কে পত্রিকায় অসত্য ও বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করে আমার চরিত্রহনন এবং বাড়ির নিরাপত্তা বিঘিœত করা।
৬. বিনাবিচারে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রেখে আমার ওপর মানসিক নির্যাতন।
৭. আমার ল’ চেম্বার ও আইন ব্যবসা ধ্বংসকরণ।
৮. আমাকে গ্রেপ্তারের পর থেকে এক থেকে দেড় কোটি টাকার পেশাগত আয় থেকে আমাকে বঞ্চিত রাখা।
৯. ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করায় আমার চরম আর্থিক সংকট, পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য অভাবের কারণে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার করে চলতে বাধ্য করা।
১০. পিতার কাছ থেকে, আমানের মতো প্রতিবন্ধী সন্তানকে স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত রাখা।
১১. চরম দুর্দশাগ্রস্ত প্রিজন ভ্যানে চড়িয়ে যাতায়াতে বাধ্য করাসহ আমার ওপর জেল কর্তৃপক্ষের অপমান, নির্যাতন, বঞ্চিতকরণ ও নাজেহালকরণ ঘটনাসমূহ।
১২. আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অসত্য ও বানোয়াট খবর পত্রিকায় ছাপানো ও টেলিভিশনে প্রচার করার ফলে চরিত্রহনন ও মানসিক যন্ত্রণা।
এরপরও কেবল আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং অন্য আরো অনেকের চাইতে ভালো অবস্থায় রাখার জন্য আমি আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩৬এতদিন যাবৎ আমার একটি পা ছিল ফোলা। কিন্তু আজ দু’টো পা-ই মারাত্মকভাবে ফুলে গেছে। কোনো ব্যথা না থাকলেও এটি খুবই অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর। জেল ডাক্তার রোগের কোনো কারণ খুঁজে বের করতে পারেননি। ফলে কোনো ওষুধপথ্যও দেননি। আমার মানসিক যন্ত্রণা চলছেই।
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩৭স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কয়েকটি সংবাদপত্রে সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে তছনছ করার অভিযোগ এনে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে আমার ওপর অন্তরীণাদেশ ও নির্যাতনের বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু অবৈধ এই সরকারের তাতে কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না। মূলত এসব প্রতিবেদনের কোনো প্রতিক্রিয়া সরকারের ওপর পড়ে না এবং ক্ষমতাসীন সরকার প্রায়ই এগুলোকে অবজ্ঞা করে এড়িয়ে চলে। এছাড়া ক্ষমতায় যে ধরনের সরকারই আসীন থাকুক না কেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতেও এসব প্রতিবেদন কোনো পরিবর্তন বা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল সরকারই এসব। প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে এবং এসব রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে।
আমাকে নিয়ে আমার ছবিসমেত লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক জন পিলজার-এর একটি লেখা আজ মানবজমিন পত্রিকায় পুনঃমুদ্রণ করা হয়েছে।
শনিবার ১৫ মার্চ ২০০৮ দিন ৩৩৮এ সরকারের আমলে গত ১৪ মাসে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা দেশের ৩২ বছরের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এ সরকার জাতিকে একটা বিষয় শিখিয়ে দিয়েছে। যে, ভবিষ্যতে কোনো সরকার যদি একজন প্রধান বিচারপতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তাহলে আদালতের মাধ্যমে তারা যে কোনো ধরনের বিচার বিভাগীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে পারে।
আজ ছিল দর্শনার্থী দিবস। স্টাফ শহীদ ও ফরিদকে সঙ্গে নিয়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক ম্যানেজার আমার ভাই শাকের এসেছিল আমাকে দেখতে। তারা বললো, সর্বস্তরের জনগণ এখন সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। অর্থনৈতিক যে কোনো স্তরেরই হোক না কেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি স্থান-কাল-পাত্রভেদে সকল নাগরিকের ওপর একটা বড় আঘাত হেনেছে। জনগণের জন্য কিছু না করায় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও তারা ক্ষুব্ধ।
(চলবে..)