রবিবার ৪ মে ২০০৮ দিন ৩৮৮১৯৭২ সাল নাগাদ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার ছিল ৭৮ শতাংশ, ২০০৬ সাল নাগাদ তা কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল ৪০ শতাংশে। এ ছিল একের পর এক ক্ষমতাসীন সরকারের সমবেত প্রচেষ্টার ফল। অন্যভাবে বলা যায়, প্রায় ৪ কোটি লোককে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে টেনে তুলে তাদের জীবনযাত্রার মান ক্রয়ক্ষমতা ইত্যাদি উন্নত করে তোলা হয়েছিল। অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হচ্ছিল দ্রুতগতিতে। এ অর্জনে সময় লেগে গিয়েছিল ৩৪ বছর।
সংবাদপত্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদের মতে দেশের ৮০ ভাগ লোকের অবস্থা আবার ফিরে গেছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। আমি আশা করবো যে, এটি সঠিক হিসাব নয়। তবে যে কোনো হিসাবের ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে বলা হয় যে, দেশের ৬০ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, যেখানে ২০০৬ সালে ছিল ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি অতিরিক্ত লোকের অবস্থা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে এবং তা ঘটেছে।
বিগত একবছরের অবৈধ, দায়িত্বজ্ঞানহীন শাসনামলে যার প্রধান কারণ ছিল খাদ্য সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মহীনতা, নতুন কর্মসংস্থানের অভাব, চাকরিচ্যুতি, বিনিয়ােগ ও উৎপাদনজনিত ক্ষতি, নিমতর ক্রয়ক্ষমতা এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি।
সেনাপ্রধান যখন জনগণকে ভাতের বদলে আলু খাবার পরামর্শ দিলেন, তা কেবল জনগণের মধ্যে রোষই সঞ্চারিত করেনি, বরং তাকে ‘গোল আলু, মি. পটেটো ইত্যাদি নামে অভিহিত করে বিভিন্ন কায়দায় হাস্যরসেরও খোরাক জুটিয়েছিল। তিনি নিজে বাসায় কেবল আলু খাচ্ছেন কি না এ নিয়েও হাস্যরস করা হতো। ফলে তার মুখ থেকে এ ধরনের বাক্য নির্গমন একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কথা বলার সময় জেনারেল হয়তো বুঝতে পারেননি যে, চালে প্রোটিনের পরিমাণ আলুর চাইতে প্রায় তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ এককেজি চালের প্রোটিন পেতে হলে কাউকে তিন কেজি আলু খেতে হবে। চিকিৎসকরা বলেন যে, কেউ যদি প্রধান খাদ্য হিসেবে আলু গ্রহণ করেন তাহলে দুই মাস পর আর তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারবেন না।
সোমবার ৫ মে ২০০৮ দিন ৩৮৯দেশে আর সুষম ভাবধারার গণতান্ত্রিক একটি পরিবেশ ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। হয়তো দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কিন্তু তারপরেও দুর্বল ও নতজানু একটি সরকারই দেশ পরিচালনা করবে। আমার মতো ৭০ বছর বয়স্ক একজন রাজনীতিকের জন্য রাজনীতির দিন শেষ হয়ে আসছে। ক্যাঙ্গারু কোর্টে আমার সাজা হোক আর না হোক আমার ভাগ্যে সহজে জামিন জুটবে না। কাজেই আপাতত আমার মুক্তি পাবারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে রাজনীতি এক নতুন গতিধারায় অনুপ্রবেশ করছে। এতে গুণগত পরিবর্তন আনার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কৌশলগত প্রেক্ষিতেই এখানকার রাজনীতি পরিচালিত হবে। বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা আর ফিরে আসবে না। এক সরকার হবে তার বিগত সরকারের চাইতে নিকৃষ্টতর এবং প্রজাতন্ত্র ক্রমশ তার রাজনৈতিক শক্তি হারাতে থাকবে। ক্রমশ পরিপূর্ণ সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার জাতীয়তাবাদী সচেতনতা ও আকাক্সক্ষার বিলুপ্তি ঘটতে থাকবে। আমি আশা করবো আমাদের দেশের জনগণ তা হতে দেবে না।
মঙ্গলবার ৬ মে ২০০৮ দিন ৩৯০আমি আবার গিয়েছিলাম হাসপাতালে। ডাক্তাররা এখনো আমার পা ফোলার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। কার্ডিয়াক বিভাগে নিয়ে গিয়ে আমাকে ইসিজি করানো হয়। তার ফলাফলে কোনো খুঁত পাওয়া যায়নি। রক্ত পরীক্ষার পরেও কোনো কিছুতে গরমিল দেখা যায়নি। যাইহোক, প্রফেসর আব্দুল্লাহ নতুন ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন যা আমি নিজের খরচে ডা. হেলালের মাধ্যমে বাইরে থেকে আনিয়েছি। জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ঐসব ওষুধের জন্য অনুরোধ জানানো হতো নিরর্থক।
২০০৭-২০০৮ সালের আয়কর পরিশোধ করার জন্য আমার ওপর কর কর্তৃপক্ষ ২২,২৮,৩৭৪.০০ টাকা ধার্য করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ টাকা পরিশোধের জন্য আমার ফ্রিজ করা চারটি স্থায়ী আমানত খুলে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি ডেপুটি কমিশনার অব ট্যাক্সেস-এর বরাবর একটি পে অর্ডার আমার অনুস্বাক্ষরসহ পাঠাতে চাইলে জেল কর্তৃপক্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমার স্বাক্ষর সত্যায়িত করেনি এবং তা আইএফআইসি ব্যাংকে পাঠায়নি। এতে আমি মর্মাহত হয়েছি, কারণ এ টাকা অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে সরকারি তহবিলে। প্রজাতন্ত্রের কাছে আমি যে কর দেনা রয়েছি তা পরিশোধ করতে না দিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ এক ধরনের অপরাধ করেছেন। এতে একদিকে আমাকে নাজেহাল করা হয়েছে, অন্যদিকে সরকারকে আমার প্রদেয় কর থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা এককথায় অসহনীয় একটি ধৃষ্টতা।
ডা. হেলালের মাধ্যমে হাসনার কাছ থেকে লম্বা একটি ই-মেইল পেয়েছি। অনেক প্রচেষ্টার পরে শেষ পর্যন্ত কোনোরকমে সে আনার বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশনের টাকা যোগাড় করতে পেরেছে
বুধবার ৭ মে ২০০৮ দিন ৩৯১কেবলমাত্র আমাকে নাজেহাল করার জন্যই জেল কর্তৃপক্ষ এখন বলছেন যে, কর পরিশোধ করার জন্য স্থায়ী আমানত জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আসতে হবে ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের অফিসের মাধ্যমে। তা কি করে সম্ভব? এফডিআর আয় ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের চাইতে অনেক উঁচু প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাকে কর পরিশোধের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। আমি জেলখানা থেকেই সরকারের প্রাপ্য কর পরিশোধ করার জন্য চেষ্টা করছি অথচ এরাই তা আমাকে করতে দিচ্ছে না। এক কর্তৃপক্ষ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পাওনা আদায় করতে চায়, অথচ আর এক কর্তৃপক্ষ, সামরিক প্রশাসন বাধা দেয় যাতে আমি কর পরিশোধ করতে না পারি। অথচ জেলখানার অভ্যন্তরে আমি অসহায়। এখন আমি কী করতে পারি এবং কার কাছে যেতে পারি সাহায্যের জন্য? জেল কর্তৃপক্ষকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা ক্রমাগতভাবে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে, কর দেওয়ার বিষয়টি ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। অথচ আমি তাদের জেলখানাতেই আছি। এই বেপরোয়া কাজকর্মের পক্ষে তারা আমাকে কোনো আইন কিংবা নির্দেশনামাও দেখাতে পারেনি।
শহীদ প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে জেলখানার বাইরে গেটে অপেক্ষা করেছে যাতে করে সে জেল কর্তৃপক্ষের সত্যায়িত করা এফডিআর জমা দেওয়ার জন্য কর কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই তাকে ফিরে যেতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ৮ মে ২০০৮ দিন ৩৯২আপিল বিভাগ তার অন্য একটি রায়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের দেওয়া একটি সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছিল যে, জরুরি আইন জারি করার আগে দায়েরকৃত কোনো মামলা জরুরি আইনের আওতাধীনে বিচারযোগ্য হবে না। অথচ এখন আপিল বিভাগ বলছে যে, তা বিচারযোগ্য হবে। এভাবে আবার নতুন করে জরুরি আইনকে স্থান দেওয়া হয়েছে সংবিধানের ঊর্ধ্বে। এর আরো অর্থ দাঁড়ায় এই যে, জরুরি আইনে কেউ দ-িত বা সাজাপ্রাপ্ত হলে তার আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি জামিন পাবেন না বা কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। দেশের উচ্চতম আদালতের কাছে জনগণের অধিকার সংরক্ষণের এটি একটি বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি এখানে চূড়ান্তভাবে হরণ করা হয়েছে।
শুক্রবার ৯ মে ২০০৮ দিন ৩৯৩এখন চলছে সংলাপের প্রহসন। একদিকে কতিপয় রাজনীতিকের ওপর ফৌজদারি মামলা, আবার অন্যদিকে একই রাজনীতিবিদের সাথে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করে সরকার এক অসম্ভব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন গ্যাটকো মামলায় কথিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে মান্নান ভূঁইয়া, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ ও সাইফুর রহমানসহ আটজন সাবেক মন্ত্রীকে অভিযুক্ত করেছে। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এখন আবার তারা জেনারেল মইনের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন। প্রকারান্তরে যারা খালেদা জিয়াকে পরিত্যাগ করে দলত্যাগী হওয়ার জন্য তাদের প্ররোচিত করেছিলেন, আজকে তারাই তাদেরকে দুর্নীতির মামলায় আসামি করেছে।
শনিবার ১০ মে ২০০৮ দিন ৩৯৪একজন বন্দির জন্য দর্শনার্থীদের আসার দিনটি সবসময়ই আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি রিচার্ড বাউচার এখন ঢাকায়। তিনি অবিলম্বে জরুরি ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো সামরিক শাসনকে সমর্থন দেবে না। এগুলো আসলে এক ধরনের রুটিনমাফিক মন্তব্য এবং লোকজনকে তারা দেখাতে চান যে, তারা গণতন্ত্রের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবে তারা তা নিজেরাই বিশ্বাস করে না, কারণ অবৈধ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ও অন্যান্য কাজকর্ম আগের মতোই চলমান রয়েছে। আগামীকাল সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করলে তারা তারস্বরে তার প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে অনতিবিলম্বে তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার প্রত্যাশা ব্যক্ত করবেন অথচ অন্যদিকে সামরিক সরকারের সাথে তাদের যোগাযোগ ও লেনদেন আগের মতোই নির্বিঘœ থেকে যাবে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে একক শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের স্ববিরোধী ও দ্বিচারী নীতিমালা পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের ওপর চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
রবিবার ১১ মে ২০০৮ দিন ৩৯৫নাইকো দুর্নীতি মামলার চার্জশিটের কপি আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। আমি এতে খালেদা জিয়ার সাথে একজন সহ-অভিযুক্ত। ফৌজদারি মামলায় যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত করার সবচাইতে জরুরি বিষয় হলো অভিযোগ প্রমাণ করার উপযোগী দলিল বা সাক্ষ্য। এই মামলায় সাক্ষীর বিবৃতিও দাখিল করা হয়নি। দাখিলকৃত চার্জশিটে কোনো সাক্ষীর নাম নেই এবং আইন মন্ত্রণালয় থেকে জব্দ করা কোনো দলিলপত্র ও ফাইলের জব্দ তালিকাও সংযোজন করা হয়নি। তাহলে এ মামলার কারণ ও উদ্দেশ্য কী? কেবলমাত্র নাজেহাল করার জন্য মামলাটিতে আমাকে জড়ানো হয়েছে।
সোমবার ১২ মে ২০০৮ দিন ৩৯৬দিনের বেলায় বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। আবার জেনারেটরও কাজ করে না। তা চলে কেবল রাতে। অসহ্য গরম, কিন্তু এ ব্যাপারে কি কিছু করার নেই। তালপাতার তৈরি হাতপাখাই তখন একমাত্র ভরসা।
আমার সেলকক্ষে পূর্বমুখী একটা বিরাট জানালা থাকায় কমপক্ষে আমার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হয়। প্রতিদিনকার নতুন ও সতেজ, দ্যুতিময় সূর্য যখন পরিষ্কার দিগন্তে ভেসে ওঠে তখন আমি দূরান্তে কৃষ্ণচূড়ার পুষ্পরাজিতে সেই সূর্যের উদীয়মান আভা বিকিরণে বিমোহিত হই। ঠিক তার পাশে দাঁড়ানো রয়েছে একটি নারকেল গাছ। সদ্য বিকশিত নারকেলমালা যেন মিষ্টি পানি বিতরণের জন্য অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে। প্রকৃতির এসব মনোরম শোভা দেখতে দেখতে এ প্রকোষ্ঠ ছেড়ে বাইরের মুক্ত আবহাওয়ায় বিচরণ করার জন্য আমার পাগল মন তখন আরো বেশি আকুল হয়ে ওঠে।
একবছরের বেশি জেলে থাকার পর প্রথমবারের মতো আমি কারা প্রহরীদের শ্যোনদৃষ্টি এড়িয়ে হাসনা ও আনার কাছে লেখা দু’টি চিঠি জেলখানার বাইরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি।
(চলবে..)