মঙ্গলবার ১৩ মে ২০০৮ দিন ৩৯৭দুর্নীতি দমন কমিশন এক বিপুল পরিমাণের বিভ্রান্তিকর ও মনগড়া ব্যক্তিগত পারিবারিক-পেশাগত-সামাজিক-রাজনৈতিক খরচ অন্তর্ভুক্ত করে আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে। এসব অনুমাননির্ভর হিসাব ও কাগজপত্রের জন্য আইন ও বিধির কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। কোনো অনুমোদিত ফর্ম ব্যবহার করা হয়নি বা এর জন্য আমাকে পূর্বাহ্নে কোনো নোটিশও প্রদান করা হয়নি। এফআইআর দাখিল করার পর আমি তা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন পেশ করেছিলাম এবং সে অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ একটি রুল ইস্যু করে এফআইআর-এর কার্যকারিতা স্থগিত করে দিয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের জারিকৃত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ স্থগিত করে দেয়। আমি ভেবেছিলাম যে, তদন্তের পরে বেআইনি বিধায় ঐসব অনুমাননির্ভর ‘ব্যয়ের’ হিসাব উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং আমার বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিট দাখিল করা হবে না। কিন্তু প্রকারান্তরে দেখা এ ব্যয়ের হিসাব কেবলমাত্র আমার বিরুদ্ধে মামলা দাঁড় করার জন্য আরো বাড়ানো হয়েছে যা আইনের পুরোপুরিভারে এখতিয়ারবহির্ভূত। তারা এ কারণে এমনটি করেছে যে, তারা বুঝতে পেরেছে এছাড়া তারা সম্পত্তি ও ব্যয়ের তুলনামূলক অনুপাতের কোনো মামলা আমার বিরুদ্ধে সাজাতে পারছে না, কারণ আমার আয়ের পুরোটাই ছিল বৈধ আয়, যা আমদের সম্পত্তির চাইতে প্রায় ৪ কোটি টাকা বেশি।
এই নাজেহালমূলক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ ও বেআইনি চার্জশিট আইনের দৃষ্টিতে কোনোদিন গ্রাহ্য হতে পারে না।
গতরাতে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন এবং তার বক্তব্য ছিল হতাশাব্যঞ্জক। ভাষণে তিনি কখন জরুরি আইন প্রত্যাহার করা হবে, সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের দিন তারিখ কিংবা দুই নেত্রী ও অন্যান্য রাজনীতিকের মুক্তির ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত দেননি। কেবল একটি বিধিনিষেধ শিথিল করে তিনি ঢাকার বাইরে সীমিত পরিসরে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি দিয়েছেন, যা অবশ্য ইতিমধ্যেই ঘোষণা করার কথা ছিল। আসলে তাকে যা বলতে বলা হয়েছে, ঘোষণায় তিনি শুধু তাই বলেছেন এবং এর বাইরে একটি কথাও বলেননি। তিনি বলেছেনÑ সংলাপের কথা, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শুধু জনগণের দৃষ্টিকে অন্যত্র নেওয়া, নিজেদের জন্য আরো সময় ও সুযোগ সৃষ্টি করা এবং নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে আরো বিলম্বিত করা।
বুধবার ১৪ মে ২০০৮ দিন ৩৯৮আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একসাথে অনেক অসুখ আক্রমণ করেছে আমাকে। আজকাল সময়ে সময়ে রাতের বেলা আমার দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে অবশ হয়ে যায় ও তাতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। আল্লাহর ওপর আমার রয়েছে পরিপূর্ণ আস্থা এবং আমি তার কাছে আরো ধৈর্যশক্তি কামনা করি।
জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে দুই নেত্রীর মুক্তি না দেওয়া অবধি প্রধান দুই দলের তথাকথিত রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেওয়া একেবারেই উচিত হবে না। প্রধান দুই দল ঐক্যবদ্ধভাবে এই দাবিতে অনড় থাকলে রাজনৈতিকভাবে সেটাই হবে একটি সঠিক কৌশল, এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারের পতন ঘটবে এবং জনগণ জরুরি আইনের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু আমি জানি যে, আওয়ামী লীগ তাতে রাজি হবে না। তারা অন্য কৌশল অবলম্বন করছে। তারা চান যখনই হোক, এ সরকারই যেন নির্বাচন পরিচালনা করেন।
বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০০৮ দিন ৩৯৯আওয়ামী লীগ সংলাপে যাওয়ার শর্তে শেখ হাসিনার মুক্তি দাবি করেছে। দেখা যাক তারা এ দাবিতে অটল থাকে কিনা? তবে এতে বোঝা যাচ্ছে যে, জরুরি আইন প্রত্যাহার না করা হলেও তারা সংলাপে অংশ নিতে রাজি, যদিও গতকাল পর্যন্ত তাদের গলার সুর ছিল ভিন্নতর।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন জনগণের সাংবিধানিক অধিকার উপেক্ষা করে জরুরি ক্ষমতা আইনে গ্রেফতারকৃত যেকোনো নাগরিকের জামিন না দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়ে জনগণের জামিনের অধিকার হরণ করার প্রতিবাদে দুই ঘণ্টা আপিল ডিভিশন বর্জন করেছে। যেসব আইনজীবী একদিন ছিলেন আইনের শাসন, মানবাধিকার ও সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে সোচ্চার, তারা আজ কোথায়? জনগণ আশা করেছিল যে, ড. কামাল হোসেন, আমীরুল ইসলাম, রোকনুদ্দিন মাহমুদ এই দাবিতে রুখে দাঁড়াবেন। কিন্তু তাদেরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কি সাহস হারিয়ে ফেলেছেন?
শুক্রবার ১৬ মে ২০০৮ দিন ৪০০এখন পর্যন্ত আমি আমার আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার অধিকার পাইনি। জরুরি আইনের আওতায়ই বিচারকেরা কারো প্রভাবমুক্ত থাকলে এবং আমার আয় ও সম্পত্তির ওপর দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলার ন্যায্য বিচার হলে আমি অন্য কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতাম না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচার শেষ হলে, ক্যাঙ্গারু কোর্টের রায়ে অন্য সবার যে দণ্ড ও সাজা হয়েছে, বাদবাকি সবার জন্য তাই হবে এবং ওরা তা-ই করার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করছে। যাই হোক না কেন, আমি সুবিচারের জন্য আমার লড়াই চালিয়ে যাবো। আমি নিশ্চিত, মহান আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করবেন।
শনিবার ১৭ মে ২০০৮ দিন ৪০১কয়েক মাস আগেই আমাকে লেখার জন্য কাগজ সরবরাহ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আজ কোর্ট ফাইল না রাখার ওপর একটি নির্দেশ এসেছে। কাজেই আমার মামলার কাগজপত্র সংরক্ষণের জন্য আমি আর কোনো ফাইল ব্যবহার করতে পারবো না। আমরা কি একটি উন্মাদ সরকারের পাল্লায় পড়েছি?
আমার সাথে পরামর্শের জন্য ব্যারিস্টার খোকনকে জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে আদালত থেকে একটি সিদ্ধান্ত আনতে হয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কতটুকু সুযোগ আমাকে দেওয়া হয়েছে? আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার জন্যও শেষ পর্যন্ত কোর্টের শত ঝামেলা পেরিয়ে আমাকে আদালত থেকে নির্দেশ জারি করাতে হলো কেন?
রবিবার ১৮ মে ২০০৮ দিন ৪০২জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমার সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছে। একই রাজস্ব বোর্ড ২০০৭-২০০৮ সালের কর পরিশোধের জন্য আমাকে ২২ লাখ ২৮ হাজার তিনশত ৭৯ টাকার ৪টি স্থায়ী আমানত অবমুক্ত করে দিয়েছিল। এ টাকা এখন আর আমার নয়, সরকারের। তবুও আমি আমার কর পরিশোধ করতে পারছি না। সমস্ত কাগজপত্র ডেপুটি কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে সেগুলো জেল কর্তৃপক্ষের বরাবরে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি তাতে সাড়া দেননি। চূড়ান্ত নাজেহাল করার এটি আরেকটি নমুনা। কিন্তু রাষ্ট্রকে এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে। প্রকারান্তরে এ হচ্ছে রাষ্ট্রকে অবমূল্যায়ন করার শামিল। আমি আগেই বলেছি যে, বর্তমান সরকার হচ্ছে একটি মস্তকবিহীন, নেতৃত্ববিহীন ও দিকনির্দেশনাবিহীন সরকার। যে সামরিক কর্তৃপক্ষ জেল কর্তৃপক্ষের কাজকর্ম তদারক করছেন তাদের মাথায় এটা ঢোকেনি যে, এই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আমাকে নাজেহাল করার চাইতে রাষ্ট্রের জন্য অর্থসংস্থান করে দেওয়ার কাজটি আরো বেশি জরুরি।
সোমবার ১৯ মে ২০০৮ দিন ৪০৩রাজনৈতিক দলগুলোকে ফাঁদে ফেলার জন্য যখন সংলাপের নাটক তোড়জোড় করে চালানো হচ্ছে তখন অন্যদিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াও চলছে সমান গতিতে। হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রহিত করে দেওয়ার পর আদালত থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত বার্জ মাউন্টেড পাওয়ার প্ল্যান্ট মামলার চার্জ গঠন করা হয়েছে। কাজেই ক্যাঙ্গারু কোর্ট থেকে এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাজার আদেশ একরকম অবধারিত। তার সাজার মেয়াদ হবে দুই বৎসরের বেশি, কাজেই তিনিও আর সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্যাটকো ও নাইকো মামলাও অচিরেই শুরু হবে। একবার চার্জ গঠন করা হলে দণ্ড ও সাজা একরকম নিশ্চিত।। মতিউর রহমান নিজামী ও শামসুল ইসলাম এই সেল-এ আমাদের সাথেই আছেন। এম.কে. আনোয়ারকে এখনো আনা হয়নি। মান্নান ভূঁইয়াও জেলে। তবে তাকে রাখা হয়েছে অন্য একটি সেলে।
বিভ্রান্তিকর সংলাপের নামে সরকার এক অদ্ভুত ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, সরকার সমস্যার সমাধান চান না। নিজেদের স্বার্থপ্রণোদিত উদ্দেশ্যে তারা রাজনীতিবিদদের সাথে খেলায় মেতেছেন।
মঙ্গলবার ২০ মে ২০০৮ দিন ৪০৪রাজনীতিবিদদের যে হারে নির্যাতন ও নাজেহাল করা হচ্ছে তার যেন আর শেষ নেই। আজ শেরেবাংলা নগরে ক্যাঙ্গারু কোর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের চড়ানো হয়েছিল একটা সীটবিহীন প্রিজন ভ্যানে। মাথার উপরে ছাদের সিলিং-এ লাগানো লোহার রড ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঙা রাস্তার খানাখন্দ পেরিয়ে ঝুলতে ঝুলতে এক পাশ থেকে অন্য পাশে বারবার কাত হয়ে একে অপরের ওপর ঢলে পড়ে এক জীবনের ওপর এক ধরনের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে অবর্ণনীয় এক কষ্টের মধ্য দিয়ে আমাদের চলতে বলা হয়। জঘন্যতম ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অমানবিক আচরণের এ ছিল এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আমি যেতে অস্বীকার করি এবং ভ্যান থেকে নেমে গিয়েছিলাম। অন্যরাও ঠিক তাই করেছেন। ভ্যানের গার্ড ও জেল কর্তৃপক্ষের সাথে এ নিয়ে আধঘণ্টার বেশি সময় তর্কবিতর্ক চলে। বেসামরিক পোষাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের লোকেরা তখন খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন। শেষ পর্যন্ত গুটিকয়েক প্লাস্টিকের চেয়ার এনে আমাদের কোনোরকমে বসতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ।
বুধবার ২১ মে ২০০৮ দিন ৪০৫আজ একজন স্পেশালিস্টের সাথে পিজি হাসপাতালে আমার জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। খুব সহজে এই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না এবং জেল কর্তৃপক্ষের তা ভালো করেই জানা ছিল। ছোট একটা কাগজে নিয়মমাফিক আমাকে একটা নোট লিখে তৈরি হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জেলগেটে গেলে আমাকে এক খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে বলা হলো যে, আজ আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ পর্যাপ্ত গার্ডের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এ ধরনের হাস্যকর আচরণের কোনো জবাব নেই। আমাদের দেশ এতো সভ্যতাবর্জিত নয়, অথচ যত দুঃখজনকই হোক না কেন দিনে দিনে তাই হতে চলেছে।
একজন শীর্ণকায় সামরিক ব্রিগেডিয়ার, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস, অনেক মাস পরে আজ জেল পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আরো কতিপয় বিধিনিষেধ আরোপ করে গেছেন। আমাদের বলা হলো যে, এখন থেকে আমরা আর বাইরের ছোট্ট বাগানটিতে যেতে পারবো না এবং সেখানে সবাই মিলে বসতে পারবো না এবং কিচেন থেকে আমাদের সকল বাবুর্চি ও হেলপারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হলো যে, আইজির নির্দেশে তা করা হয়েছে। এ ঘটনা আমাকে জার্মানির নাৎসি ক্যাম্পে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের কাহিনী মনে করিয়ে দেয়।
গতকাল বিএনপি তাদের নেতাদের মুক্তির দাবিতে রোজা রেখেছে ও নামাজ পড়েছে এবং আওয়ামী লীগের লোকেরা আয়োজন করেছে গণঅনশনের। ক্ষমতায় যাওয়ার মাত্র দুটি সোজা সরল রাস্তা রয়েছে। একটি হলো, বন্দুকের নলের জোরে এবং আরেকটি হলো, রাজপথে জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে। কাজেই সংলাপ হলো, আসলে জনতার সাথে পরিহাস করে একটি আই ওয়াশের প্রচেষ্টা মাত্র।
(চলবে..)