বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০০৮ দিন ৪০৬আমি হাসপাতালে ছিলাম। ফোলা পা ছাড়াও গত চার রাত ধরে মাঝে-মধ্যে আমার পা দু’টো হাঁটুর নিচ থেকে যেন অবশ হয়ে যায়। সাথে সাথে প্রচ- ব্যথা পায়ের পাতা পর্যন্ত। মাঝে-মধ্যে মনে ভয় জাগে আমি বোধহয় মারা যাচ্ছি। ফিজিক্যাল মেডিসিনের প্রফেসর মাইনুজ্জামানের কাছে আমাকে রেফার করা হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে এই নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসক খুবই মনোযোগ দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করেছেন। কয়েকটা শারীরিক ব্যায়ামের নমুনাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
আজ থেকে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হয়েছে। তবে এ ধরনের সংলাপ কখনোই সফল হয় না।
দুই পক্ষই কিছুটা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। তবে শেষে গিয়ে ফল হয় খুব সামান্যই। অন্যদিকে অব্যাহত থাকে জনগণের ভোগান্তি।
শুক্রবার ২৩ মে ২০০৮ দিন ৪০৭দিন আসে দিন যায়। সকালে আসে, তারপর দিন মিলিয়ে যায় ধূসর সন্ধ্যায়। রাতের পর অভ্যুদ্বয় ঘটে নতুন দিনের। ঠিক এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমার জীবনের শেষ পর্যায়ের দিনগুলো। কিন্তু সবরকম অসহায় বন্দিত্বের মধ্যেও স্বস্তির কিছুটা প্রলেপ মাখানো থাকে। শুধু তা আহরণের ক্ষমতা আয়ত্ত করে নিতে হয়। আমি আমার এবাদত ও লেখালেখির মধ্য দিয়ে তা আহরণ করার চেষ্টা করছি। অবশ্য লেখালেখিটাও এক ধরনের এবাদতই বলা চলে। এর মধ্য দিয়েই আমি আল্লাহ্র কাছে তার অশেষ দয়া ও করুণাভা-ার থেকে ক্ষুদ্রতম এক অংশ আহরণের প্রত্যাশা করি। এই শান্তি ও স্বস্তির মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমার সত্যিকারের মুক্তি।
শনিবার ২৪ মে ২০০৮ দিন ৪০৮আজ পূর্ণ হলো আমার জীবনের ৬৮তম বছর। আমার বাবার রেখে যাওয়া একটা চিরকুট থেকে মাত্র কদিন আগে আমি জেনেছি যে, আমার আসল বয়স এখন ৭১। অর্থাৎ আমি জেনেছি ১৯৩৭ সালে ২৪ মে, ১৯৪০ সালে নয়। কোলকাতার দেবেন্দ্র ম্যানসনে আমার জন্য একজন হিন্দু ধাত্রী লক্ষ্মীমাসির হাতের স্নেহস্পর্শ পেয়ে। বাড়িতেই আমি দেখেছিলাম আলোকিত পৃথিবীর মুখ। আমার আরো কয়েকটি ভাইবোনের জন্ম হয়েছে লক্ষ্মীমাসির স্নেহস্পর্শে।
ব্যারিস্টার মোজাম্মেল হোসেন সুদূর লন্ডন থেকে এসেছিলেন আমাকে দেখতে। কিন্তু ভুল এক অজুহাতে তাকে আমাকে দেখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অজুহাত ছিল তিনি একজন বিদেশি। আসলে রঙ অত্যন্ত ফর্সা এবং ভালো বাংলা বলতে জানে না বলেই এই অজুহাত খাড়া করা হয়েছিল। অথচ মনেপ্রাণে তিনি একজন খাঁটি বাংলাদেশি। আমি যখন তাকে আনার জন্য একটা খবর পাঠিয়েছি ততক্ষণে দীর্ঘসময় গেটের বাইরে অপেক্ষা করে তিনি চলে গেছেন।
আমার সমস্ত রিট আবেদন ও ভবিষ্যতে কোন কোন রিট পেশ করা হলো তা নিয়ে পরামর্শের জন্য আদালতের অনুমতি নিয়ে ব্যারিস্টার খোকন এসেছিল। জরুরি আইনে আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেন আমি কোনো পরিস্থিতিতে সরকারকে চ্যালেঞ্জবিহীন অবস্থায় ছেড়ে না দিতে মনস্থ করেছি। রাজনীতিবিদেরা যখন জেলে থাকেন তখন কেবল একজনের ওপর তারা সত্যিকারের আস্থা রাখতে পারেন এবং তিনি হলেন স্ত্রী। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে হাসনার অনুপস্থিতিতে আমাকে নির্ভর করতে হচ্ছে খোকন ও শহীদের ওপর।
রবিবার ২৫ মে ২০০৮ দিন ৪০৯আমার ২৭ বছরের বেশি সময়ের একান্ত সহচর আইনজীবী এডভোকেট আজিজুল হক শেষ পর্যন্ত আমার ও আমার ’ল ফার্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আমাকে গ্রেপ্তার করার পর থেকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা ক্রমাগত তাকে চাপ ও হুমকি দিয়ে আসছিল। শুধু তাকে নয়, তার সঙ্গে তার স্ত্রীকেও অব্যাহতভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল যে, সরকারের সাথে সহযোগিতা না করলে তাকে স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের সকলকে ফৌজদারি মামলায় জড়ানো হবে। আমি তাকে আমার সাথে দেখা করার জন্য পরপর তিনটি চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু তিনি কোর্ট, জেলখানা বা হাসপাতালে কোথাও আমার সঙ্গে দেখা করেননি। আমি সবই বুঝি, তাকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। কিন্তু বিষয়টি ছিল আমার জন্য ভীষণ বেদনাদায়ক ও ক্ষতিকর।
সোমবার ২৬ মে ২০০৮ দিন ৪১০টাকা-পয়সার প্রতি আমার কখনো লোভ ছিল না এবং দুর্নীতিমূলক আচরণ আমি সবসময় এড়িয়ে চলেছি। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীসহ অসংখ্য উচ্চপদে আসীন থাকাকালীন আমি কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারতাম। যে কেউ সাহায্যের জন্য এলে আমি সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, তা সে যত ছোট বা বড়ই হোক এবং কোনোদিন অর্থের বিনিময়ে কোনো কাজ করিনি। অন্যদিকে প্রতিবার সরকারি দায়িত্ব পালনকালে এবং জেলবন্দি থাকার সময় আমি আমার সুপ্রতিষ্ঠিত আইন ব্যবসায় থেকে সরে আসার কারণে আমি বিরাট অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। রাজনীতির জন্য, বিশেষ করে নির্বাচনের সময় যখনই আমার অর্থের প্রয়োজন হয়েছে, আমার কতিপয় শুভাকাক্সক্ষী আমার সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন। অথবা আমি নিজেই তাদের সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু সেসব সাহায্যের সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সার অবৈধ লেনদেন বা কাজ ও সুুযোগ পাইয়ে দেওয়ার কোনো সম্পর্ক কোনোকালেই ছিল না।
সারা জীবন আমি আমার এই ঐকান্তিকতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। এ কারণেই আমার ওপর যে কোনো আঘাত এলে তা প্রতিহত করার মতো সৎসাহস আমার আছে এবং আমি কঠোরভাবে তার মোকাবিলাও করেছি। শেষ পর্যন্ত আমি টিকে থাকতে পেরেছি ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমি নিয়ন্ত্রিত একটা সীমারেখা বজায় রাখতে পেরেছি। আমি কিংবা আমার ভাই-বোনদের কেউ কোনোদিন কোনো ব্যবসার সাথে জড়িত হইনি বা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সুপ্ত অংশীদার নই। আইন পেশা হলো আমাদের আয়ের একমাত্র উৎস। সঙ্গে আছে বাসাভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয়। আমাদের একমাত্র বাড়িটি, গুলশানে যা আমেরিকান সরকারের কাছে তাদের ডেপুটি চিফ অব মিশনের জন্য ভাড়া দেওয়া আছে, তা আমি সরকারি পদে যোগ দেওয়ার আগে ১৯৭৭ সালে নির্মিত। বাড়িভাড়ার প্রাপ্ত আয় থেকে ১৯৯৪ ও ১৯৯৭ সালে আমি দু’টি ফ্ল্যাট কিনেছি এবং সে বছরকালেও আমি সরকারি কোনো পদে ছিলাম না। ১৯৯৪ সালে আমি ছিলাম বিরোধীদলীয় একজন সংসদ সদস্য এবং ১৯৯৭ সালে আমি এমনকি সংসদ সদস্যও ছিলাম না। তাছাড়া ১৯৭৪-৭৫ সালে সাভারে আমি ৫ বিঘা জমি কিনেছি বিঘা প্রতি ৩ হাজার টাকায় ও ১০ কাঠা কিনেছি টঙ্গীতে কাঠা প্রতি ১২ হাজার টাকা। সেও অনেকদিন আগে আমার সম্পত্তির তালিকা এখানেই শেষ। আমার সম্পদের চাইতে আয় বরাবরই অনেক বেশি রয়েছে।
মঙ্গলবার ২৭ মে ২০০৮ দিন ৪১১২০০৭-০৮ অর্থবর্ষে ২২, ২৮, ২৭৯ টাকার আয়কর সংক্রান্ত জটিলতার রহস্য আমার সামনে দিনে দিনে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও যৌথবাহিনীর মধ্যে চলছে একটা ঠা-া লড়াই। রাজস্ব বোর্ড আমার টাকা সরকারি কোষাগারে সরাসরি জমা দিতে চাইছে, আর যৌথবাহিনী টাকা আদায়ের জন্য আমার আইএফআইসি ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের নগদায়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এতে ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই, কারণ তারা টাকা না তুললে আমার প্রাপ্য সুদের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে এবং আমার জন্য ভালোই হবে। এখন প্রশ্ন হলো- রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং যৌথবাহিনী কি একই সরকারের অধীনে নাকি তিনটি পৃথক সরকারের অধীনে কাজ করে? ট্যাক্সের টাকার মালিক কি সরকার নাকি ব্যক্তিবিশেষ? এজন্যই আমি বলি এই সরকার মস্তকবিহীন, সমন্বয়হীন ও ভারসাম্যহীন একটি সরকার।
বুধবার ২৮ মে ২০০৮ দিন ৪১২তথাকথিত সংলাপ শুরু হয়েছে, অথচ প্রধান তিন দলের নেতা হাসিনা, খালেদা ও নিজামী রয়েছেন জেলে। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলোর জন্য। সরকারি এজেন্সিগুলার পক্ষ থেকে তদবির করা হয় যাতে করে তাদের সাজা দিয়ে দেওয়া যায় ও তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। এ কারণেই দল তিনটির করণীয় ছিল সংলাপে অংশ না নেওয়া। অংশ না নিলে তারা কেবল নেতাদের মুক্তিই নিশ্চিত করবেন না, জরুরি আইন উঠিয়ে দিয়ে নির্বাচনের একটি সঠিক দিনক্ষণ স্থির করে জাতিকে তারা অবৈধ সরকারের হাত থেকে রেহাইও দিতে পারতেন। সংলাপে অংশ নিলেও তা থেকে অদূর ভবিষ্যতে তাদের কোনো লাভের আশা নেই।
এটা এমন এক ধরনের সরকার, যাকে কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ ধরনের সরকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের উদ্দেশ্য যদি সৎ হতো এবং নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য যদি তাদের থাকতো তাহলে সবচাইতে প্রাথমিক পূর্বশর্ত হতো একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সংলাপ অনুষ্ঠানের আগেই সকল রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিয়ে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতার আবহ সৃষ্টি করা। রাজনীতিবিদদের ওপর সবরকম অত্যাচার-নির্যাতন ও মামলা দায়ের বন্ধ করেও দিতে পারতো তারা। ১৯৬৯ সালের গোলটেবিল বৈঠকের আগে কিন্তু ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার ও সকল রাজনৈতিক নেতার মুক্তি দিয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন।
গতকাল ও আজকের সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, দুর্নীতি দমন কমিশন তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি মামলা চূড়ান্ত করেছে, এম.এ. জলিলের বিরুদ্ধে মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে এবং কর্নেল অলি ও মেজর হাফিজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। কাজেই শুধু রাজনীতিবিদেরাই এখন জেলে নেই, যারা রয়েছেন তারা তো থাকবেনই উপরন্তু সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে যারা একদিন সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধেও এখন। একের পর এক দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
তথাকথিত এই সংলাপ আসলে আরেকটা রাজনৈতিক চালবাজি মাত্র।
বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০০৮ দিন ৪১৩শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে যে, শেখ হাসিনাকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি না দিলে তারা সংলাপে যাবেন না। খালেদা জিয়া ও নিজামীর পক্ষে বিএনপি-জামায়াত একই অবস্থান নিয়েছে। এখন আমাদের দেখতে হবে দলগুলো, বিশেষ আওয়ামী লীগ তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে কি না।
পূর্ণ রায় দেওয়ার পর এখন দেখা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো মামলায় আপিল বিদ্যমান জরুরি আইনের আওতায় জামিনদানের প্রক্রিয়া কিছুটা শিথিল করেছে। তা অন্তত মন্দের ভালো।
শুক্রবার ৩০ মে ২০০৮ দিন ৪১৪সালের এই দিনে প্রেসিডেন্ট জিয়া নৃশংসভাবে নিহত হন। তার উত্থান ছিল আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচাইতে যুগান্তকারী ঘটনা। তার সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার কয়েকটি বইয়ে তার সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছি আমি।
কাল ছিল প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমিনের শেষ কার্যদিবস। আমার স্মৃতি আনুসারে তিনিই হলেন একমাত্র বিচারপতি যাকে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন কোনো আনুষ্ঠানিক বিদায় জানায়নি। একজন প্রধান বিচারপতির কাছে এর চাইতে অপমানজনক আর কী হতে পারে? আসলে বিদায় জানানোর প্রতি এই বিমুখতা জনগণের চরম ক্ষোভ ও বিদ্বেষেরই প্রতিফলন।
আমাদের বিচার বিভাগের ইতিহাসের সবচাইতে কলঙ্কময় অধ্যায়টি লিখে বিচারপতি রুহুল আমিন বিদায় নিয়েছেন ।
দুর্নীতি দমন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। সরকার তার মাইনাস-টু অভিযানে সমর্থন জানানোর জন্য যাদের কাছে তদ্বির করেছিল এবং সমর্থন আদায় করেছিল তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার আরেকটি প্রত্যক্ষ নজির হলো এটা। এ থেকে অবশ্য আরও প্রমাণিত হয় যে, তোফায়েল আহমেদ শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাননি।
(চলবে..)